আমার পতির কান্ডকীর্তির কথা কি আর বলব। আগেই তো আপনাদের সাথে পরিচয় হয়েছে ।চেহারা দেখলে মনে হবে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না ,কিন্তু তলে তলে সব বোঝে ও আদায় করে নেয় ষোলআনা।একদম স্বার্থপরের চূড়ান্ত। অবশ্যি পুরুষেরা হয়ই ওরকম-জানা কথা।কেইবা কম আর কেউ বেশী। বাইরেই যতটুকু তফাত-এইতো।
এই যে দেখুননা, ঘরের বউ বটে আমি, তাও ঘর বার দুটোই তো সামলাতে হয়। এই যুগে কি আর একজনের ইনকামে চলে নাকি চলা সম্ভব? তা- আমি যদি মেয়ে হয়ে ওর মত দশটা পাঁচটা অফিস করি আবার বাড়িতে এসে সব বুয়াগিরিও আমাকেই চালাতে হয় , তখন বাবু সাহেব একটু যদি আমাকে সাহায্য করেন তো কি ওনার পৌরষ্যত্বে হানি হবে নাকি? বিয়ের সময় তো বলেছিল আমার জন্য সব করতে পারে।চাই কি আকাশের চাঁদও এনে দেবে- মুখ ফুটে বলাটাই যা বাকি।
আর এখন-অন্তত ছেলেমেয়ের পড়াটা তো একটু ভালো করে দেখাতেই পারে, এতেও কি গড়িমসি! বাচ্চাদের পড়াতে যেমন ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে হয় বাচ্চাদের বাবাকেও পড়াতে বসানোর জন্য ও-ইরকমই ঝ্বক্কি সামলাতে হয়।অথচ এ আর এমন কি কাজ। আসমা, মৌরী আপা, পাশের বাড়ির শাহিন ভাবি প্রত্যেকেরই ছেলেমেয়েদের বাবারাই তাদের পড়া দেখিয়ে দেয়।
এই যুগে একটু ভাগযোগ করে কাজ না চালালে কি একা একজনের পক্ষে সব ম্যানেজ করা সম্ভব ? এমনি এমনি তো আর ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না ওগুলো।আর আমার মুনীর শীলাটা যেমন পাজি ফাঁকিবাজ তাদের বাবাটাও সে-ইরকম। আমার কপালেই যে সবসময় এরকম কেন জোটে!
কাজের লোকটা পর্যন্ত বদের হাড়ি । অথচ শীলা আপা, আলেয়া ভাবী, নিশাতের কাজের লোকগুলো কত কাজের , একেকজন কতদিন ধরে আছে, রীতিমত ঘরের লোকের মত আপন, বিশ্বস্ত। বাড়িতে গেলেই কি সুন্দর হাসিমুখে চা নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসে, একবার বলতেও হয় না। আর আমার গুলো -হুঁ তাহলেই হয়েছে। নিজে হাঁকাহাকি ডাকাডাকি করে না মরলে নিজে থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলেও খাওয়াবে না।
আর ফাঁকতাল পেলেই চুরি করে ছোট খাট জিনিস হাপীশ করবে। তাও না হয় মানা যেত - চূপিসারে হাত দিয়ে সুযোগ পেলেই তরকারিটা ভাজিটা হালুয়াটা মুখে পুরে দেবে। কিসের নাকি কিসের হাতে কে জানে। এই মাত্রই হয়ত ঐ হাতে করে নাক খু্টে এসেছে। অথচ খাবার তো কম দেই না, এবং আমরা যা যা খাই তার একট ভাগ ওকে না দিয়েও খাই না। এমনকি কুচো চকলেটটা পর্যন্ত না। শীলাটা খুব খায় ,একদম চকলেটের পোকা ও এবং খেলে একটুকরা সুফিয়াকে না দিয়ে তো খায় না।
তারপরেও এই অবস্থা । হুঁ পড়তো ঐ রকম কোন বাসায় ....এরকম কিছু তো জীবনেও চেখে দেখতে পারতোই না , পাবার মাঝে কয়েক হালি বাড়ির বেগমসাহেবার কিলচড় তাহলে বুঝতো মজা। আমাকে ভালো মানুষ পেয়ে উল্টো ঢিট করছে।আমার সব দুঃখের কথা ভাই আর আপনাদের কি বলব?
তা ঘরের নিজের সাহেবের কোন খেয়াল আছে আমার যে পরের মেয়ে দেখবে, খবর রাখবে? তার কি দায় পড়েছে? এই যে সাহেব অফিস থেকে আসলেন তো হল , ধড়াচুড়া ছেড়ে খালি কতক্ষণে স্পোর্টস চ্যানেলটা নিয়ে পড়বেন তার অপেক্ষামাত্র। দায়সাড়া ভাবে কি দুদন্ড বাচ্চাদের একটু কি না কি পড়া দেখিয়ে খালাস।
এই তোদের তো বুঝিয়ে দিলাম , এবার নিজে নিজে পড়।
আমি তো রান্না ঘর থেকেই সব শুনতে পেয়েছি। এই হচ্ছে ফাঁকি দেবার প্রথম ধাপ। ব্যস বাপ একটু ছেলেমেয়ের চোখের সামনে থেকে সরলেই হয়েছে, মুনির-শীলাকে আর পায় কে। একটা বইয়ের ফাঁকে একটা সায়েন্স ফিকশন নিয়ে পড়েছে, অন্যটা মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত। এসব আমি এই খানে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই টের পেয়েছি। ওর বাপকে বুকিঝুকি যতই দেক না কেন আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া অত সোজা না, ....হুম কেননা মায়েদের মাথার পিছনে অদৃশ্য কয়েকজোড়া কাজ করে , শুধু সামনের একজোড়ার ভরসায় থাকলে এ সংসার চলতে পারতো? কবেই তো উচ্ছন্নে যেত।
বিশেষ করে যেসব নমুনা নিয়ে চলতে হয় ..থাক আর কথাটা শেষ করলাম না। বুঝে নিন।
অগত্যা বাধ্য হয়েই আবার হাক দেই হারুনকে, তা সাহেবের খেলাতে ডুবে গিয়ে দীন দুনিয়ার কোন খেয়াল থাকলেতো।একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বললে তবে যদি কান দিয়ে কিছু ঢোকে।
সবার ফ্যামিলিতে বাবারাই সব পড়া দেখে ,কতভাবে হেল্প করে বউদের তোমাকে দিয়ে কোন কাজটা হয় ? কেন এই যে ওদের নিয়ে স্কুলে , তারপর কোচিং থেকে প্রাইভেট টিউটর দৌড়াই আর তুমি সামান্য একটু পড়াটা বলে দেবে, আর একটু সামনে স্রেফ কিছুক্ষন বসে থাকবে- যাতে ওরা ঠিকমত পড়ে- এতটুকুও করতে পারো না। তোমাকে দিয়ে আর কি হবে? এত স্বার্থপর তুমি যে বউকে কোন কাজেই এতটুকু সাহায্যও করো না। বাড়িতে ফিরলেই দুম করে খালি টিভির সামনে ..। কেন সারাদিন অফিস ফেরত আমার কি ইচ্ছে হয়না একটু টিভি দেখি? তাও তো কড়াই খুন্তি নিয়ে সোজা রান্না ঘরের দোজখের মধ্যেই ঢুকতে হয়। আর তুমি এই সামান্য কাজটাও করতে পারো না। সংসারে একটু দ্বায়িত্ব নিতে শেখো, খালি অফিস ঘর বার করে এযুগে চলে না।
কেন আমাদের সময় তো এতসব প্রাইভেট কোচিং কিছু ছিল না, বাবা কখনো এক অক্ষরও আমাকে ধরে শেখান নি, তাতে কি আমার পড়া হয়নি?
ঐযুগ আর নেই বুঝলেন, ঐ দিন বহু আগে চলে গেছে। এখন কোচিং আর টিউটর না হলে ভালো করা দূরে থাক পাশই যে করবে না। তুষার, শামার, নওশীনের , জুয়েলের কত উদাহরন দাও, জানো ওরা দিনে কত ঘন্টা পড়ে? কতটা সময় কোচিং ক্লাসে কাটায়? এই যে স্কুলের জন্য সকালে বের হয় বাড়িতে ফেরে রাত নটায় । ভালো কি এমনি এমনি হয় নাকি?যত গুড় তত মিষ্টি, বুঝলে?
তো পড়ে কখন?সারাদিন তো বাইরে বাইরেই যায়।হারুনের নির্বোধ প্রশ্নে
আমার মেজাজ চড়তে থাকে।
কখন আবার?বাড়িতে ফিরে, তাও রাত তিনটার আগে ঘুমায় না, বুঝেছো? সকালে স্কুলে যাবার আগে আবার ঘন্টাখানেক পড়ে তবে যায়।ওরা তোমার ছেলেমেয়েদের মত ফাঁকিবাজ না, খুব সিরিয়াস, একদম ফালতু কাজে সময় নষ্ট করে না। বাজে তর্ক রাখো। ছেলেমেয়ে শুধু আমার না, তোমারও । তাই কথা না বাড়িয়ে অন্তত একটু পাশে বসে থেকে আমাকে উদ্ধার দাও।
এইতো....এই সব করতে করতে কোন সময় যে ঘুমানোর সময় হয়ে যায়...। এই তো কামলা খাটা , দিনরাত ঘানি টেনে চলা। রুটিনবদ্ধ জীবনে আমার নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই।তাও কি শান্তি আছে দুই দন্ড?
খেটেখুটে অনেক রাতে ঘুমাতে আসলাম , দেখি ফ্যানটা পুরো বন্ধ করে দিয়েছেন সাহেব।
এই তো হালকা শীত , তার মধ্যে আবার ফ্যান পুরো বন্ধ করলে কেন?
আমার গরম লাগছে, বলে ফ্যান চালু করলাম আমি ।
এই দারুন শীতে তোমার গরম লাগে? আমি তো ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি , বলে হারুন আবার দিলো ফ্যানটা অফ করে।
কিভাবে তুমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছ? আমি শুধাই। বাইরেরে এই ধরাচূড়ার নিচেও তো অন্তত পাঁচটা আছে?
ফ্যান চলে আবার।
নাহ, চারটা। হারুন আমার নিদারুণ ভুলটা তাৎক্ষনিক সংশোধন করে দেয়।কথার সাথে সাথে হাতও চালায়।
ফ্যানটা ফের অফ হয়।
আমি চোখ কপালে তুলি। এই সামান্য শীত- পড়েছে কি পড়ে নি তার মধ্যেই বাইরেরটার নিচে আরও চার চারটা পড়েছো তাও তোমার শীত লাগে? আরও তো দিন পড়েই আছে। তোমার এখনে না থেকে সাহারাতে গিয়ে দেখা উচিত।
তাই তো দেখছি।
ভুরু কুঁচকাই আমি।
আরে ঐ যে টিভিতে রোজই সাহারা খাতুন দর্শন হচ্ছে তো । তার কথা কাজে বঙ্গদেশই সাহারা হয়ে উঠলো বলে।
হুম ভেরী ফানি । ওর কথা কুটচালে আমার কোন ভাবান্তর হয় না। ক্লাউন একটা ।আবোলতাবোল কথায় আমাকে ঘোরাবে কিন্তু মর্জি বজায় রাখবে নিজেরটাই।
নিজে তো একগাদা চাপিয়েছো। তারপরে এই নামমাত্র শীতে ফ্যান বন্ধ। আমর কথাটা তো ..এমন স্বার্থপরকে কি আর বলবো। একটুও ভেবে দেখা নেই। সারাদিন অফিস থেকে এসে ঘরের হাঁড়ি ঠেলি ঐ আগুনের মত হয়ে থাকা চিলতে বদ্ধ রান্না ঘরটাতে ।শীতকাল হবে তোমাদের জন্যে। আমার তো বছর ভর কপালে এক বৈশাখ মাসের খর তাপ ছাড়া আর কিছু নেই। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারবো না?
কামলা খাটতে এসেছি নাকি তোমার সংসারে?
বলে এবার ফ্যানটা একেবারে সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটিতে চালিয়ে দেই। এতটা আমার দরকার ছিল না। নিজেরই এখন একটু শীত শীত করছে। কিন্তু মস্ত্বিস্কের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে জ্বলে ওঠা অগ্নি নির্বাপনের দরকার ছিল।
ব্যস এখানেই কথা বন্ধ। আপাতত গৃহ তাপমান বিষয়ক আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে আমাদের মাঝে।
কাকাডাকা ভোরে পরদিন যথারীতি ঘুম ভাঙে আমার। সব বাড়ির মতই এ বাড়িরও সবচেয়ে আগে ওঠা বান্দা আমিই -বাড়ির "গৃহকর্ত্রী"। অ্যালার্মেরও দরকার হয় না এখন -এমনই সুদীর্ঘ পাকা অভ্যাস আমার দেহযন্ত্রে।
উঠে .......কি দেখলাম জানেন? ফ্যানটা- যথারীতি বন্ধ-ছেলেদের কাছ থেকে এ ছাড়া আর কি আশা করা যায়- জন্মগত সেলফিশ এরা- ঘরে বাকি মানুষগুলোকে থোরাই কেয়ার। নিজে আগে ভালো থাকতে হবে ,তারপর পরের চিন্তা। সুতরাং হারুনের এ আচরন আমার কাছে প্রত্যাশিত- ই ছিল।মাথায় চনাৎ করে রক্ত চড়ল। এই আত্নকেন্দ্রীক লোকগুলোর জন্য খামখা খেটে মরার কোন কারন হয়?
যা একেবারেই আশ্চর্য- নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হারুনের গায়ের রোমশ মোটা কম্বলখানা দিয়ে আমার আগাগোড়া সযত্নে ঢাকা দেওয়া, যেটা কাল ছিল আমার কর্তাসাহেবের গায়ে। যিনি এখন বিনা কম্বলে কুকড়ী মুকরীতে অঘোর ঘুমে নিমগ্ন।
অবশ্যি এই কম্বলটা আমাদের দুজনের জন্য বেশ ছোট-ই হবে। আমার নিজের শীত কম থাকায় বড় কম্বলটা এখনো নামাই নি। নামিয়ে রোদে দিতে হবে-বহুদিন ধরেই তো আলমারীতে -ভ্যাপসা গন্ধ হয়েছে-ও জিনিস শতেক কাজের ভিড়ে নামাব নামাব করে শেষমেষ আর নামানো হয় নি।
আর অ-বশ্যিই সাথে আমার আরও মনে পড়ল- কাল শেষ রাতের দিকেই হবে- বেশ শীত শীত লাগছিল। প্রয়োজনের চেয়ে বেশী জোরে ফ্যান ছাড়ার ফলাফল আরকি।অমন শীতে ভালো করে ঘুমানো যায় নাকি? ঘুম ঘুম ভাবে টের পেয়েছিলাম খুট করে বাইরের একটা আলো জ্বলে উঠলো। বাথরুমে যেতে উঠেছিল বোধহয় হারুন। আমি গুটি শুটী মেরে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করেছিলাম। আরামদায়ক না হোক ঘুমে ফের তলিয়ে যেতে দেরী হয় নি আমার।সারাদিন খাটলে এটা একটা পজিটিভ দিক- ঘুমে অন্তত সমস্যা হয় না।
নির্ঘাত ফিরে এসে শীতে কুকড়ে ঘুমানোর চেষ্টা রত আমাকে কম্বলটা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল হারুন...। নিজে এখন শীতে কষ্ট পাচ্ছে। কান্ড দেখছেন মানুষটার, না হয় দুজনেই কোনমতে শেয়ার করেই ঘুমাতাম। এখন এমন শীতে ....এমনিতেই তো আমার চেয়ে অনেক বেশী শীত কাতুরে, এভাবে ঘুমাচ্ছে- ঠান্ডা না লেগে যায়, এমনিতেই ওর ঠান্ডার ধাত।একটুতে উনিশ বিশ হলো কি বিশাল ঠান্ডা লাগিয়ে ঘরে বসে থাকবে। আমি পা টিপে টিপে উঠে ওকে ভালো করে গায়ের কম্বলটা খুলে ঢেকে দিলাম। আরাম করে কিছুক্ষণ অন্তত ঘুমাক বেচারা। রাতে বেশ কষ্ট করেছে।
আমার অনেক কাজ, আর আয়েশ করে শুয়ে থাকার অবসর নেই-সবে তো আরও একটা দিনের শুরু হল মাত্র।কর্মব্যস্ত আরও একটা জমজমাট দিন।
বহু কাজ জমে আছে, বিল দিতে হবে, বাজার শেষ হয়ে গেছে, আমান স্যারের বেতন....।আর হ্যাঁ, সালেহা মামীকে আজ স্কয়ারে দেখতে যেতেই হবে।লম্বা লিস্ট কাজের।তবে মনে মনে পণ করলাম আর কোন কিছু করা হোক আর না হোক , বড় কম্বলটা আজই নামাতে হবে। কয়েকেদিন ধরে আকাশ মেঘলা মেঘলা করছে, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে লাগলাম, আজ যেন রোদ ওঠে ।