র্যাকেটটা শক্ত করে হাতে বাগিয়ে ধরে নায়ীমা। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় র্যাকেটের উপর বসে থাকা হাতের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে।কতক্ষণ ধরে সে খেলছে তার সে সময়ের জ্ঞান নেই । এই অতিলৈকিক জগতে সময়ের সম্ভবত কোন অর্থও নেই। এমনকি তার নিজের অস্ত্বিত্বেরই হয়তবা কোন অর্থ নেই- কেবল খেলা, খেলেই যাওয়া, জয়ের উত্তুঙ্গ বাসনায়।আর অন্য সব কিছুই সম্পূর্ণ অবাস্তব, অর্থহীন ও অবান্তর।ভূতলে যেন একমাত্র সত্য এই টেনিস কোর্ট, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দুই প্রতিদ্বন্ধী আর তাদের এই অকল্পনীয় অদৃষ্টপূর্ব দ্বৈতযুদ্ধ।
কিন্তু আসলেই কতক্ষণ পার হয়েছে এখানে আসার পর থেকে? ছয়ঘন্টা, আটঘন্টা ...???টেনিস খেলা দীর্ঘদিনের পোক্ত শরীর তার, তাই স্ট্যামিনা আর যে কারোর চেয়ে বেশী ,তাই বোধহয় এতক্ষণ ধরে বিরতিহীন খেলে যেতে পারছে।কিন্তু এ তো শুধু একটা সাধারন টেনিস ম্যাচ খেলার উত্তেজনা নয়, এ যে তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জও , তাই অপরিমেয় জয়েচ্ছ্বার কাছে শরীরের পরাজয় ঘটেছে, সময় হার মেনেছে, বহুক্ষণ খেলেছে সে ঠিক , জানে না আরও কতক্ষণ খেলে যেতে পারবে অবিরাম। কিন্তু মনোশক্তির প্রেরণায় ওকে এখনও উজ্জীবিত করে চলেছে, ক্লান্তির লেশমাত্রও ও অনুভব করছে না এখনও। আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্যি কথা।
ওপাশ থেকে ''নায়ীমা''র পাঠানো বলটাতে সপাটে র্যাকেটের বাড়ি মারে নায়ীমা। দুজন অপরাজেয় খেলোয়াড়ের এই দারুন কাঙ্খিত দ্বৈরথের দর্শক হতে পারলে কত শত টেনিস ভক্ত হয়ত সারা জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে বাগিয়ে নিত একটা মহামূল্যবান টিকেট আর এখন এই ম্যাচের দর্শক মাত্র গোটাকতক ভবঘুরে নাম না জানা পাখির দল। যারা সম্ভবত টেনিস ইতিহাসেরই সর্বশ্রেষ্ঠ ম্যাচটির মর্ম একেবারেই বুঝতে অক্ষম। কোন মানুষের চর্মচক্ষু এই দুজন কিংবদন্তির খেলা আজ অব্দি দেখেনি আর দেখবেও না ভবিষ্যতেও কখনোই।
টেনিসে অবিশ্বাস্য এক রেকর্ডের মালিক নায়ীমা। আজতক অপরাজিত সে খেলায়, এ রেকর্ড টেনিসে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আর কারোরই নেই। সে যে কোন টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া মাত্র শুধু রানার্সআপ পজিশনে নিয়েই মানুষের জল্পনা চলে,একেবারে পারফরমেন্সের তুঙ্গে অবস্থান এখন তার। এখনও যথেষ্ট তরুনী সে , কিন্তু কিংবদন্তী হয়ে উঠে তার ছায়ায় ঢেকে দিয়েছে আর আর বাকি সবাইকে, সামনের দিনগুলোতে হয়তোবা এ ছায়া আরও বিস্তীর্ণতায় ঢেকে দেবে অনাগত প্রজন্মকেও যারা এখনও টেনিসের তীব্র প্রতিযোগীতার ময়দানে সবে এখনও আসি আসি করছে।সবাই যেমন মানে তেমনি সে নিজেও- তার এ আধিপত্য সহজে যাবার নয়, সে অপ্রতিদ্বন্ধী। কিন্তু সত্যিই কি? আজ অন্তত ক্ষণে ক্ষনে শংকা নায়ীমার মনের কোনে চুপিসাড়ে উঁকি দিয়েই যাচ্ছে। নিজের সাথে লড়াই করে কে কবে জিততে পেরেছে? তীব্র জিগীসার মাঝে থেকে থেকেই প্রাণপণে দমিয়ে রাখা এ প্রশ্ন ওর মনে ওর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ভেসে উঠছে।
কম সাক্ষাৎকার দিতে হয়নি জীবনে ওকে। প্রতিটা ট্রফি হাতে নেবার পর মিনি সাক্ষাৎকার দিতে হয়,মাঝে সাঝে ওকে একটা প্রশ্ন শুনতে হয়েছে-আজকের অদম্য অজেয় নায়ীমার সাথে যদি খেলার লড়াই চলতো কৈশোরের সমানই অদম্য নায়ীমার , কে জিততো তাহলে? এ প্রশ্নটা ফানি , স্রেফ ফান করার উদ্দেশ্যেই করা, জবাব কেউ জানে না, জানা অসম্ভবও বটে, জানতে আসলে কেউ চায়ও না।
সপ্রতিভ নায়ীমা প্রতিবারই হাসিমুখে উত্তর দিয়েছে, তাহলেও নায়িমাই জিততো।
ফান করে বলা প্রশ্নের ফানি উত্তর নয়, এবার ওর সামনে সুযোগ সেই প্রশ্নের সত্যকার জবাব জানার। কিন্তু সে কি সুযোগ নাকি শঙ্কা?প্রশ্নটা থেকে থেকে ওর ভেতরটা কাঁপিয়ে দিতে থাকে।পরাজয় মানতে পারে না সে , পরাজয় মানতে জানেও না - ঠিক তেমনি তার সামনে থাকা নায়ীমারও বেলাতেও তো একথাটা খাটে।এ লড়াইয়ে নায়ীমাই জিতবে ঠিক -কিন্তু কোন জন, একজন নায়ীমাকে তো হারতেও হবে। সে নিজে হারার কথা মনে আনতে পারে না, এ জয় তার জীবন , জিততেই হবে তাকে। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও।প্রয়োজনে শরীরের শেষ বিন্দু সামর্থ্যটা দিয়ে হলেও। জানার উপায় নেই সামনে থাকা অপর নায়ীমার কথা, কিন্তু তারও মনের ভাব যে একই তাতে সন্দেহ নেই, হার স্বীকার তারও কল্পনার অগোচর।
এবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের খেলা শেষে এক বিশেষ বিনোদন অপেক্ষায় ছিল বিজয়ী নায়ীমার জন্যে,চীনা বংশোদ্ভূত অসি বিজ্ঞানী ড: ইউজিনের নবতম অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার একটা ফ্লায়িং সসার, আলোর প্রায় সমান গতিতে চলতে সক্ষম।একেবারে মুভিতে দেখা ভিনগ্রহী যে এলিয়েনদের আকাশচারী অত্যাধুনিক মহাযানগুলো যুগে যুগে মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে তারই অবিকল বাস্তব রূপ যেন। এর আগে এরকম একটা কিছুর উদ্বাবনের কল্পনার দৌড়টা ছিল শুধুমাত্র ফিকশনবিহারী লেখকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সেই অমূল্য আবিষ্কারের একটা রাইডের দারুন সৌভাগ্য হওয়ায় নায়ীমার উল্লাস ছিল মাত্রা ছাড়া। কেনই বা না হবে, এ ভাগ্য এখন পর্যন্ত দুনিয়াতে যে গুটিকতক লোকের হয়েছে সে যে তাদের মাঝে একজন হবে।
ড: ইউজিন তার বিশেষ ভক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রীয় অনেক প্রটোকলের বেড়াজাল পার হয়ে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই প্রিয় খেলোয়ারটির একান্ত মনোবাসনা পূরণের এ ব্যবস্থা করেছিলেন।তখন এক দারুন সৌভাগ্যের ক্ষণ বলে মনে হলেও এখন বোঝে, কি কুক্ষণেই না সে চড়ে বসে ছিল সসারটাতে!গোড়াতে সবকিছুই ঠিক চলছিল, তারপর হঠাৎ প্রবল বেগে একটা ধাক্কা লাগা যেন অদৃশ্য কোন কিছুর সাথে- তারপর আর কিছু তার মনে নেই । জ্ঞান ফিরে এখানে আবিষ্কার করে সে নিজেকে।কোন জায়গা তা জানে না,অনেকক্ষণ ইতস্তত উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে হাঁটতে এক কিশোরীর দেখা পায় নায়ীমা।মুখে একটা রুমাল বেঁধেছে সে,মুখের নিচের অংশটা প্রায় ঢাকা পড়েছে তাতে, একমনে তন্ময় হয়ে বল আছড়ে আছড়ে র্যাকেট ঘুরিয়ে মেরে চলেছে সামনে থাকা এক মস্ত বড় পাঁচীলের দিকে। এ ওর নিভৃত নির্জন একাগ্র অনুশীলন। দেখে কি যেন মনে পড়ে নায়ীমার। অনেক দিন আগে - যখন তার ছিল না ঝলমলে টেনিস চ্যাম্পিয়নের তকমা, নিজস্ব কোচ,রাশি রাশি ডলারের প্রাইজমানি, শুধু ছিল দরিদ্র বাবার দেয়া একটা মাত্র পুরোনো র্যাকেট আর অনেক অনেক বড় বড় স্বপ্ন তখন সেও এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রাকটিস চালাতো একা একা , নিঃসঙ্গ - একমাত্র সাথী ছিল তার বুকভরা উচ্চাশা। চ্যাম্পিয়ন স্টেফিগ্রাফ, নাভ্রাতিলোভার মত নয়, তার চেয়েও বড় কিছু করার দুঃসাহসিক স্পর্ধা রাখতো সে মনে। এক আকাশের চেয়েও বড় স্বপ্ন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা খোলা আগুনঝরা আকাশের নিচে কি অমানুষিক পরিশ্রমের দিন গুলোই না সে তখন পার করেছে!
পাশেই দাঁড়িয়ে মেয়েটার খেলা দেখছে নায়ীমা, আর এসব ভাবনা অযথাই মনে আসছে ওর, কিন্তু আশ্চর্য মেয়েটার কিন্তু আর কোন দিকে কোন খেয়াল নেই। টেনিস খেলোয়াড় হবার সাধনা তার কিন্তু টেরও পায় নি বিখ্যাত টেনিস সেলিব্রটি নায়ীমা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ওর খেলা দেখছে।যার দর্শন লাভ করতে পারলেও লোকে জীবন স্বার্থক মনে করে তার এমনকি উপস্থিতিও যেন ধর্তব্যের মাঝেই আনছে না এই পুঁচকে মেয়েটা। সজোরে র্যাকেট চালিয়ে চলেছে সে। ওর দিকে দেখতে দেখতে ওর পরনের পোশাকগুলোও কেমন কেমন চেনা চেনা মনে হতে লাগলো নায়ীমার, এখানের পুরো দৃশ্য -এই সব কিছু যেন টিভিতে দেখা কোন রিপ্লের মত, মূলটা আগেই অন্য কোথাও দেখা হয়ে গিয়েছে ওর। তা কি করে হয় ? এখানে এর আগে তো সে কখনোই আসে নি, আর এই মেয়ের সাথেও যে এর আগে তার কখনোই দেখা হয়নি- নিশ্চিত সে।
আর এই মুখের আধখানা ঢেকে রাখা ?নায়ীমার মনে পড়লো ওর কৈশোরে একটা এ্যাডভেঞ্চার সিরিজ দেখাত টিভিতে, দূর্দান্ত পপুলার ঐ সিরিজের নায়কের অনুকরনে সে এরকম করে মুখে একটা রুমাল বেঁধে রাখত অনেক সময়, এমনকি খেলার সময়ও।এর জন্যেই কি এ দৃশ্যটা ওর কাছে এত চেনা মনে হচ্ছে? নিজের কিশোরীবেলার পুরনো স্মৃতির ছায়া আছে বলে?কে জানে হতেও পারে হয়তবা।
সে যাই হোক চিরকালের টেনিসপ্রেমী মনে মেয়েটির একাকী খেলা দেখতে দেখতে নায়ীমারও অদম্য তৃষ্ঞা জাগলো ওর সাথে এক হাত খেলে নেবার। যদিও একটা অখ্যাত সাধারন কিশোরীই সে, বেশীক্ষণ ওর সামনে টিকতে পারবে না তা সে জানে, কত রথী মহারথীই তো পারে নি,আর এ ... তাও অশেপাশে আর কাউকে না পেয়ে ওর সাথেই একদান খেলে নিতে ইচ্ছে জাগলো ওর।
কিন্তু মেয়েটির সাথে খেলা শুরু হবার পরে অল্পদন্ডেই বুঝতে পারে নায়ীমা কি ভুল তার হয়েছে। কোন প্রতিপক্ষকেই যে ছোট করে দেখা যায় না, অপরাজেয় হতে হতে সে কবে যেন একথা ভুলে গিয়েছিল। এই মেয়েটি তা ওকে আবারও মনে করিয়ে দিল। কিছু কিছু জিনিস অনভ্যাসেও ভুলে যাওয়া ঠিক নয়- পুরানো সত্যটাও ওর ফের মনে পড়ে গেল এই সুবাদে।
সে যাই হোক এই পুঁচকে কোথাকার অখ্যাত কোন মেয়ের কাছে নায়ীমা অন্তত হেরে যেতে পারে না -তা সে যত ভালো খেলুড়েই হোক না কেন। চলতে লাগলো খেলা , কিন্তু কোন মীমাংসা হবার নাম নেই তার।তারপর সময় কোনদিক দিয়ে কোনদিক দিয়ে পার হয়ে গেল- স্রেফ হুশজ্ঞান রইলো না ওর। উঁহু ভুল বলা হলো , মাঝে একবার ছন্দপতন হয়েছিল ওর, বাতাসের ঝাপটায় বা এমনিতেও হয়ত ঢিলে হয়ে এসেছিল কিশোরীর মুখে বাঁধা রুমাল খন্ড, বিরক্ত কিশোরী পুরো বাধামুক্ত করে একপাশে ছুঁড়ে ফেলেছিলো মুখের আধ- আবৃত করে রাখা আবরণীটা।ওটা পড়ে যেতে নায়ীমা স্তম্ভিত হয়ে আবিষ্কার করেছিল ওর সামনে দাঁড়ানো , এযাবতকালের মুখোমুখী হওয়া ওর সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নয় - সে ও নিজেই।অবিকল সেই মুখ , সেই চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা যা তখন থেকে নায়ীমাকে অপ্রতিদ্বন্দী অজেয় করে রেখেচে আজতক, যার সামনে নির্মম ভাবে বধ হয়েছে নেটের অন্য পাশে খেলুড়ে অন্যপক্ষ- খ্যাত অখ্যাত সব ক্রীড়ানকেরাই। হতচ্ছাড়া সসার ওকে একেবারে ওর কিশোরীবেলায় ফিরিয়ে এনেছে- সে নিজের জায়গাতে ত নয়- ই, এমনকি নিজের সময়টাতেও নেই। আতংকিত নায়ীমা চিন্তা করারও সময়টুকু পায় না, ওপাশ থেকে ধেয়ে আসা বল রিটার্ন করে- যেভাবেই ও এখানে আসুক না কেন, ফেরার উপায় করার চিন্তা করার আগে তাকে এ ম্যাচটাই আগে জিততে হবে।
সামনের নায়ীমা ওকে নিশ্চিতই চিনতে পারে নি,হাবেভাবে চরম নির্বিকারত্বই তার প্রমান।ধাক্কাটা মনে মনে তাই কেবল আজকের নায়ীমাই খেয়েছে।চিনতে না পারারই ত কথা , সে আগের দারিদ্রপুষ্ট এক রুগ্ন কিশোরীর সাথে আজকের অতিসফল অতিবিখ্যাত নারীমার বাহিরও যে পুরো পরিবর্তিত। তাছাড়া ঐ সময়টা অতিক্রম করে এসেছে বলেই সেই পুরনো নায়ীমাকে ও চেনে , কিন্তু আজকের চ্যাম্পিয়ন নায়ীমার তখন তো কোন অস্ত্বিত্বই নেই, তাই সদূর অতীতের নায়ীমা তাকে চিনবে কি করে?
সেই কিশোরীর ছায়াটুকুও আজ তার চেহারার কোথায় নেই সত্যি, কিন্তু আগের নায়ীমার অস্তিত্ব যদি কোথাও থেকে থাকে তা শুধু আছে তার মনের মাঝে থাকা সেই একই রকম জিগীসায়, বিজয়ী হবার ,নেটের অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটিকে ছিড়েখুঁড়ে একেবারে শোচনীয় বিধ্বস্ত করে দেবার ইচ্ছার মাঝে। কালের পরিক্রমায় ও সাফল্যের গতিচক্রে তখনকারও এবং এখনকারও নায়ীমার কোন চুলপরিমান তফাত হয় নি শুধু এইএকটা ব্যাপারে।নেটের অপর প্রান্তে যে-ই থাক না কেন স্রেফ জয়ই তার উদ্দেশ্য- খ্যাতি নয়, অর্থ নয় , এমনকি ট্রফিটাও নয়, স্রেফ বিজয়টাই থাকে তার মোক্ষ। টেনিসের প্রতি এতই নিখাদ, নিঃস্বার্থ উজার করা নিবেদনই হয়ত ওর আজকের নায়ীমা হয়ে ওঠার পেছনের গোপন রহস্য।
এই কি কারন যে কারনে নায়ীমা তার সামনে থাকা অন্য নায়ীমাকে কিছুতেই হারাতে পারছে না? নিজের সাথে নিজের লড়াই কি এভাবেই তবে অমীমাংসিত রয়ে যাবে ?হয়ত নিজের সাথে বলেই তারা দুজন এখনও কেউ কাউকে পেরে উঠছে না এত লম্বা সময় পার হয়ে যাবার পরেও- এ যেন নিজের সাথে নিজেরই ছায়ার মল্লযুদ্ধ চলছে। সে যাই হোক নায়ীমা কিছুতেই হারবে না, হারতে পারে না সে- সেই শুরু থেকে ছোট বড় নির্বিশেষে সব প্রতিদ্বন্ধীর বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত যে মনোভাব নিয়ে সে খেলে এসেছে,লড়ে এসেছে, এবং জিতে ফিরেছে-আজও সেভাবেই সে খেলবে এবং জিতবেও , জিততেই হবে তাকে।তার অজেয় খেতাব সে হারাতে পারে না।এই বিজন জায়গায়- যেখানে- যদি হারেও তার সেই হার লোকচক্ষুর চিরঅন্তরালেই থেকে যাবে-কেউ জানতেও পারবে না কখনো -তাও , সেখানেও সে নিজের কাছে হার মানতে একদম নারাজ।
কিন্তু সে কি ভুলে গেছে কার সাথে তার এবারের খেলা? তার সামনে যে আছে সেও তো নায়ীমাই , সে ছাড়া আর অন্য কেউই তো নয়। তারও তো নেটের এ প্রান্তে থাকা নায়ীমার মত একই রকম প্রচন্ড জয়ের উদগ্র বাসনা। সেও তো অপরাজেয় , আজ পর্যন্ত হারের মানে জানা নেই যার।তাই সেও এর শেষ দেখেই ছাড়বে। তাই খেলা চলতে থাকে , চলতেই থাকে ওদের। দিগন্তরেখা ঝাপসা হয়ে ওঠার আভাস কেউ কি টের পায় কি না বোঝা যায় না। একে একে জ্বলে উঠতে থাকা সান্ধ্য বাতির টিমটিমে আলোতেও কোনমতে চালিয়ে যেতে থাকে ওরা-এমনই অবিশ্রাম অবিরত এ খেলা। তবে ঘন্টার কাটা সরে যাওয়ার সাথে সাথে নায়ীমাকে বিন্দু বিন্দু অবসন্নতা ঘিরে ধরতে থাকে , অতি সঙ্গোপনে । অকল্পনীয় উদ্যমে সে লড়াই চালিয়েছে এতক্ষণ পর্যন্ত, যা অন্য কোন সাধারন অবস্থায় তার পক্ষে চালানো সম্ভব হতো না। শুধু মানসিক শক্তি দিয়েই সে এতক্ষণ অবিরাম খেলে চলেছে।শরীরের দাবিকে পুরোমাত্রায় অগ্রাহ্য করে দিয়েছে। বিশ্রাম চাওয়ারও অবকাশ মাত্র সে তাকে দেয় নি। কিন্তু সব কিছুর শেষ হয়,মানুষের শক্তিরও তো একটা চূড়ান্ত সীমা আছে।তাকে লঙ্ঘন করা সম্ভব না কারো পক্ষে। তার শক্তিরও তিল তিল করে সেই শেষের বিন্দুটির দিকে যাওয়া ইঙ্গিত পায় নায়ীমা। তার সামনের নায়ীমারও দেহে কি তারও মত ক্লান্তির আভাস? থাকারই কথা, ও ত সে নিজেই, এবং একজন মানুষ - সীমার অধীন যার সামর্থ্য।তা ওর মত অবস্থায় আসলেও অবশ্য জানা যাবে না ।কেননা -যত ক্লান্তিই ওকে ঘিরে ধরুক না কেন, তা ঝেড়ে ফেলে সর্বশক্তি দিয়ে শক্তিমতীর বর্হিভিনয়ে সে এই প্রান্তে থাকা নায়ীমার মতই রিটার্ন করে চলবে- যতকক্ষ সাধ্যে কুলায়। অন্যপাশের জনও সে অভিনয় করবে, যতই দুর্বল হোক না কেন - ঘুণাক্ষরে প্রতিদ্বন্দ্ব্বীকে জানতে দেবে না নিজের লেশমাত্র দূর্বলতাও- তা অন্তত নিশ্চিত দুপক্ষেই। এ খেলা দৈহিকের সাথে সাথে মাইন্ড গেম, মানবিক শক্তির সাথে মানসিকের যুগলবন্দী।
মানবদেহের শেষ শক্তির সীমাকেও অতিক্রম করে খেলে চলেছে নায়ীমা কিন্তু আর বুঝি পারে না- নিজে স্পষ্ট টের পায় সে।শেষ সীমাটা কখন আসবে , কি ই বা তার ফলাফল হবে তা ওর অজানা।কিন্তু তার আসার সঙ্কেত বোঝে সে। নিজের হাত পা- যেন তারা আর তার নিজের নয়। কলের দম দেওয়া পুতুলের মত শুধু মনের অদৃশ্য তাড়নায় নড়ে যাচ্ছে- দম এই ফুরালো বুঝিবা। শরীরের প্রতিটা গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে মারণযন্ত্রণা অনুভব করে চলেছে সে । ওগুলো যেন জান্তব শব্দে গুঙিয়ে ওকে থামতে আকুতি জানাচ্ছে ওকে- আর না ,তাও থামার জো নেই নায়ীমার। দূরে থেকে ভেসে আসা সসারের মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায় সে- কিভাবে কিভাবে এ হল জানা নেই- কিন্তু এ তারই সেই সসার, ওকে নিতে এসেছে ফিরিয়ে - পরিষ্কার বোঝে সে। কেউ বলে দেয় নি , কিন্তু নায়ীমা বোঝে ওটার কাছে শক্তি থাকতে পৌঁতে পারাই এখান থেকে তার মুক্তির একমাত্র উপায়।না হলে চিরজীবন আটকা পড়ে থাকতে হবে এই অতীতে আবদ্ধ হয়ে।কিন্তু এই খেলা ফেলে সে ওখানে এখন পৌঁছাবে কিভাবে? সে হারবে না এ ম্যাচে, হেরে সে এখান থেকে যাবে না , যেতে পারে না,এখানে খেলা ফেলে সে ফিরে গিয়ে চ্যাম্পিয়নের মুকুট আর পরতে পারবে না, ঐ ভান তার পক্ষে করা একান্তই অসম্ভব।ফিরতে হবে, এবং তা হবে ম্যাচটা জিতবার পরেই শুধু। কিন্তু জেতার আগেই না চির ঘুমে শয্যায় ঢলে পরতে হয় তাকে?......... শরীরের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে জান্তব সুরে ব্যাথা ,মুখে রক্তের চিহ্ন।কোনমতে পুরো শরীরের পরতে পরতে অব্যাখাত বেদনা নিয়েও এত ক্ষণ রিটার্ন করছিল নায়ীমা।কিন্তু আর বুঝি পারে না..। শেষ সময়ের আর বুঝি দেরী নেই...। অপর পাশ থেকে ধেয়ে আসা বলটা বাকি অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি দিয়ে ফের ওপাশে পাঠায় সে, শেষ বিন্দুটিও খরচ হয়ে গেছে এখন,মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে আগে টের পায় সসারের শব্দ ক্রমঃশই নিকটবর্তী হচ্ছে....।