পুরুষজাতিকে তুষ্ট করা বেশ মুশকিল কাজ - যত যাই বলুন না কেন। আমার সাহেবটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কোন ব্যাপারেই তার কোন শোকর নেই। সবচেয়ে বেশী বেগ পেতে হয় ওর জন্য কিছু কিনতে গেলে। ঈদ বা এরকম কোন ব্যাপারে এসব দ্বায়িত্ব সব সময় বেচারী বউয়ের উপরই পড়ে- এই- ই নিয়ম। যেতই হবে এবং যেতে হবে আমাকেই ।
শুনুন ঈদের সাধারন চালচিত্র। মিশন পাঞ্জাবি ক্রয়। কিনতে গেলাম। গোটা এলিফেন্ট রোডটা চক্কর দিলাম। দামের দিক থেকে নিচ দিয়ে আরম্ভ করা আরকি। নাহ, সব কমন ডিজাইন। বাবুর নাকটা উঁচু , ওটাকে আরও তীক্ষধার করার সুযোগ দেয়া যায় না।
এই জ্যাম ঠেলে এধার ওধার করা চারটিখানি কথা না , তাও গেলাম এবার বসুন্ধরায় -কলেকশানটা বেজায় কম, দামটাও বনে না।
এবার গেলাম গুলশানে।দোকানের শান বাড়াচ্ছে সারি সারি সাজানো পাঞ্জাবিগুলো , কিন্তু দুই বাচ্চার বাপ আমার বরকে এইসব ঝাকানাকা বলিউডি লেবাসে চিন্তা করতে গেলেই আমার হৃদকম্প হয়। দামের দিকে তাকালেও বিশেষ ভরসা হয় না বলাই বাহুল্য। আরও গোটা কতক মার্কেট বেহুদা ঘুরলাম। রফা হলো ধানমন্ডিতে গিয়ে। বড়মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা সামনে ধরে জিঞ্জেস করলাম ,' কিরে পছন্দ হয়?'
মেয়ে এত ভাগদৌড়ে কাহিল, অবস্থা দেখে কিছু বোধহয় আশ্বস্ত হয়, কেননা এতক্ষনে তাও একটা কিছু "কিঞ্চিত ' বোধকরি আমার মনে ধরেছে। মায়াই হয় ওর দিকে তাকালে। লেস চুড়ি ফিতার বা সালোয়ার সুটের দোকানে না ঘুরে এইসব পুরুষালি পোষাকের দোকানে ঘুরতে কার ইচ্ছে হয়? ওর বয়সে আমার তো মোটেই ইচ্ছা হতো না। সব গুলো একই রকম মনে হত, সেই একই স্টাইপ, ডোরা নকশায় ছেলেদের ড্রেসগুলির একের সাথে অন্যের তফাতটা শুধু রঙের। প্রসঙ্গত বলে রাখি চুপিচুপি, এখনও আমার তাই মনে হয়। তবে কিনা আমার সাহেবের জন্য আমাকে তো আসতেই হয়।এবং তাকে প্রতিবারের মত এবারও খুঁত ধরতে দিতে আমি নারাজ। বেস্ট ইন বেস্ট টাই আমার চাই-ই চাই। প্রভাইডেড আমার পকেট উড অ্যাকসেপ্ট ইট।
সে যাই হোক মতামত জানতে চাইলে মেয়ে সজোরে ও সোৎসাহে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে, এতখানি আগ্রহের সাথে যে আমার কাছে ওটা একটূ বাড়াবাড়িই মনে হয়- সম্ভবত সে এই বোরিং শপিং থেকে উদ্ধার পেতেই বেশী আগ্রহী, একটা ভালো পাঞ্জাবি পছন্দ করার দিকে ওর অতটা আগ্রহ নেই।
সে যাই হোক কপাল ঠুঁকে নিয়ে নেই। আর বাবা পারব না।বহুত ত দেখলাম।আর কত?
বাড়িতে এসে নিতান্ত উদাসীন ভাবে - যেন ওর মতামতে আমার কি আসে যা্য় এমনভাবে হারুনের সামনে পাঞ্জাবিটা মেলে দেই ।
' দেখ তোমার জন্য এটা কিনলাম ।'
আমার পতি সস্নিগ্ধভাবে সরু চোখে আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
' মাপে হবে কি আমার?'
এটা তার কমন প্রশ্ন - প্রতিবারের সিলেবাসে থাকেই থাকে।
'না হবে না কেন? গতবারের চেয়ে তোমার একটু ভূঁড়ি বেড়েছে বটে তাও হয়ে যাবে -আমি সিওর।'
'নাহ একটু খাটো হয়ে গেছে।'
'হুঁ তুমি তো মুনির শীলার মত গ্রোয়িং চাইল্ড - বছর বছর তোমারও আগের বছরের চেয়ে বড় মাপের টা লাগবে !'
'ডিজাইনটা বেশীকমন । ঐদিন দেখলাম ফিরোজ এরকম একটা পড়েছে।একেবারে এটার ডুপ্লিকেট কপি মনে হল , কেবল রংটা আলাদা। '
আমি এতগুলো মার্কেট খুঁজে একটা পেয়েছি ,এবারে ঈদের নিউ ট্রেন্ড- তোমার ফিরোজ সাহেব না কে একজন এই জিনিস পেল কোথ্থেকে? অসম্ভব ব্যাপার - এই জিনিস আমি এত জায়গায় ঘুরে একটা মাত্র বের করলাম। পছন্দ নাহলে এবার থেকে নিজেই কিনে নিয়ো।টাকা দরকার হয় আমি দেব।নিজে কষ্ট করে এনেও দেব আবার এত কথাও শুনব -এ হবে না।'
এই খানেই কবি নীরব - এই চ্যালেঞ্জে জয় তার পক্ষে সম্ভব নয়।পাঞ্জাবির দোকানে দোকানে ঘোরাটার এনার্জিতে হারুনের কুলাবে না। এর চেয়ে ফেসবুকে ঘন্টা ঘন্টা আড্ডা দেয়াটাই তার বেশী পছন্দের।
'বড় বেশী ফ্যাকাশে , সাদামাটা, বেশী রংগিলা, মেয়েলী রকমের চকমকে ...........।প্রতিবারই তার স্টকে বিশেষনের কমতি নেই।সে আলাদা কথা।
'আচ্ছা দামটা কতো লাগলো?'
'তুমি আন্দাজ করো ত'
আমার দ্বিগিজ্বয়ী মুচকি হাসি, দামের দিক দিয়ে অন্তত সে আমকে কিছু বলতে পারবে না।সে মামলায় আমিই জিতেছি।
'চারশ? কত আর হবে।'
আমার এবার ধৈর্যচূতি হয়, এটার দাম পনেরশো টাকা। নিজে ত বাজারে যাও না গেলে বুঝতে, এর নিচে পরার যোগ্য কিস্যু পাওয়া যায় না।
হারুন রীতিমত আর্তনাদ করে ওঠে। 'এই চিজটির দাম প-নে-র শো টাকা, হায় হায় ডাহা ঠক খেয়েছো তুমি।'
'টাকা পয়সা থাকলেই কি নষ্ট করতে হবে নাকি, তাও আবার একটা পাঞ্জাবির পেছনে? ছেলেমানুষ একটা দুটো থাকলেই বছর চলে যায়, তোমার কিংবা শীলার জামাকাপড়ে গেলে না হয় বুঝতাম।'
'
'সংসারে এত রকম খরচপাতি আছে আর তুমি পনেরশটা টাকা স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে এলে?'
মেয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাপকে পাঠালো, 'একবার একটু পড়ে দেখাও ত, দেখবো সব ঠিক হয়েছে কিনা।'
আমরা সবাই দেখলাম সবই ঠিক আছে, শুধু হারুন ছাড়া।তার মনে হচ্ছে গলাটা একটু বেশী খোলা, ঝুলটা একটু বেশী খাট , কাপড়টাও বেশী সুবিধজনক নয়, একবার ধুলেই নাকি ফেড হয়ে যাবে। মাপটা অন্তত একসাইজ বড় আনতে হবেই।'
' ঠিক আছে , শীলাকে সাথে নিয়ে চলে যেও, কাল ওর ঐদিকেই ইংলিশের কোচিং আছে।নিজে পরে ট্রায়াল দিয়ে আনবে।কালই যাবে , তিনদিকের মাঝে বদলানোর ডেট, পরে গেলে দেবে না।'
কত তিন দিন চলে গেল , সাহেবের যাওয়া আর হয়না , শেষমেষ যখন তাকে জোর করে পাঠানো হল , গিয়ে দেখেন স্টক শেষ। বাপ মেয়েতে মিলে আরও চড়া দামের একটা পাঞ্জাবি তাদের মনে ধরলো।
' তোর মা যে কি সব পছন্দ করে , দেখ এটা কি সুন্দর ।'
দাম দেখে মুখ চুন।তাও বদলাতে যখন হবেই, দোকানে বলে কয়ে আগেরটা বদলে নিল ওরা, সাথে একস্ট্রা বাকি কিছু গচ্চা গেল পকেট থেকে কারন আগেরটার চেয়ে এটা বেশী দামী।
বীরদর্পে ফিরে এল বাড়িতে।' দেখ , একেই বলে পছন্দ করা।'
'দামটা কত?' এবার আর কথা নেই সাহেবের মুখে।
এত ঝামেলা করে কেনা পাঞ্জাবি-ঈদের দিন কিন্তু ঐ পোশাক হারুনের গায়ে চড়ে না, আমার মার বাড়িতে গেলে চড়ে তাঁর দেয়া টা আর শাশুড়ির- আই মিন তার নিজের মায়ের বাড়িতে গেলে তাঁর দেয়া ঈদের উপহার। তা পরেই ও এমন ভাবে ঘুরে বেড়ায় যেন এর চেয়ে সুন্দর কোন পোশাক সে জীবনে পরে নি। গদগদ স্বরে প্রশংসা করে,' মা আপনার টেস্টের কোন জবাব নেই!'
ডিপ্লোমেসি একেই বলে।
বাস্টবিকই ছেলেরা কি ইম্পসিবলই নাহয়! তাও নেড়া একবার না বারবারই বেল তলা্য যা্য যেমন আমি যাই প্রতি বছর ওর পাঞ্জাবি কিনতে।এই কাহিনি তাই রিপিট হয় হর বছর বছর..............।