বইটি পড়ে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে গেলাম। মা এসব একদম পাত্তা দেয় না। একসময় মা দেখতেন ঘরে আমি একা একা হঠাৎ হঠাৎ হেসে উঠি, তিনি ছুটে এসে দেখেন ছেলে বই পড়ছে আর হাসছে! অভ্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি। কান্নাও আলাদা কোনও ব্যাপার না তার কাছে।
ছেলেবেলায় তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, কুয়াশা, ওয়েস্টার্ন, ক্লাসিক পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাঁর হাত ধরা, তিনি হুমায়ুন আহমেদ। তাঁর প্রায় প্রতিটি বই যে মুহুর্তে পড়া শেষ হয়ে যায়, সেই মুহুর্তে দেখি নিজেও লেখক হয়ে উঠেছি। তখন তাঁর প্রখর সমালোচনা শুরু করে দেই, সমাজের প্রতি এই লেখকের কোন দায়বদ্ধতা নেই, শুধু চটুলতাই কোনও সাহিত্য হতে পারে না...ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনও আমি পাঠক, লেখক, ছোটকাগজের প্রতিশ্রুতিশীল সম্পাদক। তখন বিশ্বের বাঘা বাঘা সব দর্শন, কবিতা, আর্টিকেল, ছোটগল্প নিয়ে রীতিমতো গবেষণা-আলোচনা আর চায়ের কাপে ঝড় তুলতাম। অ্যালেন্স গিন্সবার্গের, 'অ্যামেরিকা, আই ফাক ইউ উইথ ইয়োর গ্রনেড' ছিল প্রিয় কবিতাগুলির একটি।
ঢাকায় হিজরতের পর শুরু হল জীবিকার পিছে ছোটা, বাবা-মা ভেবে নিয়েছে ছেলে পড়ালেখা করতে গেছে, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টটেন্ট হয়ে তবেই ঘরে ফিরবে। দেশের প্রতিথযশা একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কাম চার্টার্ড অ্যাকাউন্টটেন্ট শফিক রেহমানের সঙ্গে আলাপ করলাম, আমি মিডিয়া মোগল হতে চাই সেই সাথে সিএ। তিনি শুধু হাসলেন, বললেন তুমি পারবে। তিনি এও বললেন, এত অল্প বয়সে লেখক হয়ে গেলে সমস্যা আছে। তিনি হুমায়ুন আহম্মদের কথা বললেন, হুমায়ুন আহম্মেদ এদেশের ছেলেমেয়েগুলিকে বই কিনতে শিখিয়েছে।
শুধু তাই নয়, হুমায়ুন আহম্মেদ এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলিকে কাঁদতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে বৃষ্টিতে ভিজতে, ভালোবাসতে, হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে পথে নামতে এরকম আরও অনেক কিছু। হুমায়ুন আহম্মেদ একটি সাহসের নাম, যিনি কি না বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লিখেই রোজগার করা যায় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। মেধাস্বত্ত্ব আইন বলে কিছু এদেশে না থাকা স্বত্ত্বেও হুমায়ুন আহম্মেদ বাঁচিয়ে রেখেছিলেন একটা ইন্ডাস্ট্রিকে। কম্পিউটার কম্পোজিটর থেকে শুরু করে, প্রেস-কাগজ-বাইন্ডার-লেমিনেটর-প্রকাশক অনেকগুলি পেশাজীবি বেঁচে থাকে হুমায়ুনের বই প্রকাশ হয় বলে। আধুনিক কালের জীবনব্যবস্থার সার্বিক ছবি যার লেখায় দেখা যায় তিনি হুমায়ুন আহম্মেদ। আধুনিক সময়ে এই লেখক এক আধুনিক অসুখের সেবাদাস হয়েছেন। তাঁকে বাঁচাতে জোর প্রচেষ্টা চলছে। এত এত মানুষ ভালোবাসে যাঁকে তিনি মরতে পারেন না। অপরাধীরা দীর্ঘায়ু হয় শুনেছি। বুড়ো যুদ্ধাপরাধীরা এখনও টিকে আছে! আর এতো মানুষের প্রিয় লেখক মরে যাবেন, এটা হতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা থাক বা না থাক, ভালোবাসা আছে, হুমায়ুন আহম্মেদকে বেঁচে ফিরতেই হবে। কান্না ভেজা চোখে আমি হুমায়ুন আহম্মদের জন্য লিখছি, লেখা আমার কাছে নামাজ পড়ার মতো বিষয়। আমি আমার জায়নামাজে বসে বলছি অদৃশ্য এক নিয়ন্ত্রককে, হুমায়ুন আহম্মেদ চলে গেলে বাংলাদেশী পাঠক-সমালোচকের হৃদয়ে ব্লক তৈরি হবে, একটি প্রজন্ম হৃদয়ে ব্লক নিয়ে প্রকৃতিকে ভৎসনা করবে। প্রকৃতি, তুমি হুমায়ুনকে নিয়ে যেও না। লেখকের জন্য আমাদের কান্নাকে নিঃষ্ফল করে দিও না। এরাও প্রকাশ করেছে
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ১১:২৮