যুলুম নিয়ে অধিকাংশ আলোচনা হয় একমুখী। যেমনঃ বাবা-মা’র ওপর সন্তানের যুলুম, স্ত্রীর ওপর স্বামীর যুলুম। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে কেউ যদি বলে সন্তানের ওপর বাবা-মা’র যুলুম কিংবা স্বামীর ওপর স্ত্রীর যুলুম- তো সবাই হাসাহাসি করে। বলে, পাগল নাকি? এটা কী করে সম্ভব? বাবা-মা আবার সন্তানের খারাপ চায় কী করে?
এক বোনের গল্প বলি। নাম খাদিজা। সরকারি কোনো এক ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। বয়স চব্বিশ পার হয়েছে। বাড়ি উত্তরবঙ্গে। ফাইনাল ইয়ারে পড়ুয়া বোনের ক্ষেত্রে যা হয় উনারও তা হচ্ছে। আশ-পাশ থেকে প্রচুর বিয়ের প্রস্তাব আসছে।
এলাকায় মেয়ের সুনাম আছে। মেয়ে পর্দা করে চলে, ছেলেদের সাথে কখনো তার উঠাবসা দেখা যায় না- লোকজন যখন এসব কথা বলে তখন খাদিজার বাবা-মা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। না, মেয়ে ইসলাম মানছে এই খুশিতে না। পাশের বাড়ির জরিনার মা কিংবা আক্কাসের বাপ তার মেয়ের প্রশংসা করছে এই খুশিতে।
তবে খুশিটা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। খুব হাইফাই জব করা এক ছেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। ছেলের মুখে চাপ দাড়ি আছে, রেগুলার নামায পড়ে। সুবহানাল্লাহ! আর কী লাগে? মেয়ে বলেছিল, বাবা! ছেলের দাড়ি থাকতে হবে, রেগুলার নামায পড়তে হবে।
মেয়ের চাহিদার সাথে মিলে গেছে। এখন শুধু ‘কবুল’ বলা বাকী। তবে এখন কিনা মেয়েটাই বেঁকে বসছে! বলছে, ছেলে ব্যাংকে জব করে। সুদের সাথে জড়িত এমন কাউকে সে বিয়ে করবে না। খাদিজার বাবা বলে বসলেন, কান্ড দ্যাখো! দুইদিনের হুজুরনী, ইন্টারেস্টকে বলে সুদ! আর ইন্টারেস্ট হারাম হলে তোর বাবার ঘরে খাচ্ছিস কেন! আমি নিজেও তো ব্যাংক থেকে জমানো টাকায় মোটা অংকের ইন্টারেস্ট পাই।
এক কান, দু’কান করে আশেপাশে জানাজানি হলো। সবাই বলল, নাহ! মেয়েটাকে ভালো ভেবেছিলাম। এত সুন্দর সম্বন্ধ যে মেয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, হয় ঐ মেয়ে বোকা, নতুবা তার প্রেমের সম্পর্ক আছে। পাশের বাড়ির আক্কাসের বাপও এবার বাসায় এসে আর মেয়ের প্রশংসা করলেন না। খাদিজার আব্বাকে বললেন, আপনার মেয়ে পর্দা করে ভালো। হিজাব আমার মেয়েও পরে। ও তো ব্যাংকে জবও করছে। কোনোদিন তো এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখি নি। আপনার মেয়ে ওহাবী হয়ে যাচ্ছে না তো? একটু নজর রাখবেন প্লীজ। আপনাদের ভালো চাই বলেই বলছি। না হয় আমার কী দায় পড়েছে!
খাদিজার আব্বার এবার টনক নড়ল। মেয়ের পড়ার টেবিলে হানা দিলেন। কথা সত্যি! নিজের পড়ার বইয়ের চেয়ে ইসলামী বই-ই বেশি। কিছু বই তো পুরো আরবীতে লেখা। ঘটনা কী! মেয়ে কি আরবি-টারবি শিখছে নাকি। কই! উনি তো আরবি পারেন না। ইসলাম বুঝতে তো উনার সমস্যা হয়নি। সুন্দর করে টেবিল থেকে উনি কুরআন শরীফটা আলাদা করলেন। লাল-কাপড়ে মুরিয়ে ফেললেন। আলতো করে চুমুও খেলেন।
তারপর বাকী বইগুলো ডাইনিং স্পেসে এনে পুড়িয়ে ফেলা হলো। এই বইগুলোই যত নষ্টের গোঁড়া। পুড়িয়ে ফেলা বইয়ের লিস্টে ছিল- তাফসির ইবনে কাসির, হিসনুম মুসলিম, রিয়াদুস সলেহিন, আর রাহেকুল মাখতুম, হাদিসুল আরবাইন- এর মতো আগাগোড়া কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক বই। খাদিজা বাসায় না থাকার সময়েই তিনি এসব করলেন যাতে এগুলো পুড়ানোর সময় মেয়ে সিন ক্রিয়েট করতে না পারে।
খাদিজা বাসায় এসে এসব দেখে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ‘অধিক শোকে পাথর’-যাকে বলে। সারারাত কুরআনটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদল। এসব দেখে মায়া লাগবে কী তার বাবা আরো ক্ষেপে গেলেন। পরদিন মেয়ের সব বোরখা পুড়িয়ে ফেলা হলো। বাইরে গেলে সেলোয়ার কামিজের সাথে হিজাব পরে বাইরে যাবে। বোরখা পরে ভূতের মত বাইরে যেতে হবে, এমন কথা কোন হাদিসে আছে! অনেক সহ্য হয়েছে এমন ওহাবীপনা! আর না!
মনে হতে পারে, এতক্ষণ কোনো বানানো গল্প বলেছি। কিন্তু আসলে তা না। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে কান পাতলেই মধ্যরাতে এমন খাদিজাদের চাপা কান্না শুনতে পাওয়া যায়। যদি এগুলো যুলুম না হয়, তবে যুলুম আর কোনটা?
যুলুম যে শুধু বোনদের বেলায় হয়, ভাইদের বেলায় হয় না- কথাটা সত্যি না। তবে ছেলেরা অনেককিছুই মোকাবেলা করতে পারে। যেমনঃ বাবা বলেছে দাড়ি রাখলে আমার কাছে কোনো টাকা পাবি না। ছেলে ঠিকই টিউশনি করে পড়াশুনার খরচ চালিয়ে নিচ্ছে। আবার বাসায় পরিবেশ অসহ্য লাগছে? দূরে কোথাও চাকরী নিয়ে পড়ে থাকতে পারে ছেলেরা। তবে যারা চিন্তা করে ফ্যামিলি আর ইসলাম দুটোকে একসাথে সাথে নিয়ে আগাতে, বিপদে তারা বেশি পড়ে।
আপনাদের আরেক দ্বীনি ভাইয়ের গল্প বলি। উনার ইচ্ছে, ফ্যামিলিকে সাথে নিয়েই বিয়ে করবেন। তো ছাত্রাবস্থাতেই বাসায় জানালেন। তার বাসার লোকজন অবশ্য ছেলের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। তারা চিন্তা করল, এখন না করা যাবে না। করলে ছেলে বিগড়ে যাবে। অন্যভাবে, না করতে হবে। সেটা কীভাবে? যেদিন পাত্রী দেখতে যাবে, সেদিন সন্ধ্যেবেলা ভাইয়ের মা ঘুম থেকে উঠে শুরু করল কান্না। কান্না মানে হাউমাউ কান্না। উনি নাকি বাজে স্বপ্ন দেখেছেন। ভাই নাকি কখনো তার মাকে অন্তত স্বপ্ন দেখে কাঁদতে দেখেনি। খটকা লাগলেও মুখে কিছু বলল না।
পরে আবার পাত্রী দেখতে যাওয়ার কথা বললে তাকে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হলো। উনার মা আত্মীয়দের কাছে বলে বেড়িয়েছেন, তার দাড়িওয়ালা ছেলে সম্ভবত এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ঐ মেয়েকে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। হুজুর হয়ে প্রেম! খালারা এসব জানে শুনে তো ভাইটা পারলে লজ্জায় সুইসাইড করে। আর কি ঐ মেয়েকে দেখতে যাওয়া সম্ভব? সম্ভব না।
বেশ কয়েকদিন পর আরেক জায়গায় পাত্রী দেখার কথা বললে, ফ্যামিলি থেকে খুব পজেটিভ সাড়া পাওয়া গেলো। তবে পানি কিছুদূর গড়ানোর পর বুঝা গেলো, সেটাও মুখের কথাই ছিল। মাঝখান থেকে কিছু হৃদয় ভাঙ্গা হলো, চোখ দিয়ে কিছু অশ্রু ঝরল, কিছু স্বপ্নের মৃত্যু ঘটল। এসব অবশ্য, তারাই চোখ দিয়ে দেখবে যাদের চোখ আছে। আচ্ছা, এই অশ্রুগুলোর কি কোনো দাম নেই? এগুলো কি যুলুম না? এক ভাই আক্ষেপ করে বলছিলেন, সালাত শেষে হাত তুলে মুখে তো ঠিকই পড়ি- রব্বির হাম হুমা কামা রব্বায়ানি সগিরা। কিন্তু অন্তর থেকে গার্ডিয়ানের জন্য বদ-দু‘আ চলে আসে। অনেক চাইলেও সেটা রোধ করতে পারি না।
সৌদি আরবের রিয়াদের এক বোনের গল্প পড়লাম সেদিন। আন্ডার গ্রাজুয়েট করা অবস্থায় বাবা বিয়ে দেয়নি। বলেছেন, আগে পড়াশুনা শেষ করো। বাবার কথামতো পোস্টগ্রাজুয়েট, পিএইচডি করলেন। সমস্যা হচ্ছে, এত উচ্চশিক্ষিতার জন্য উচ্চশিক্ষিত ছেলে পাওয়া কঠিন। বোনটা ভার্সিটির প্রফেসর হয়ে গেলেন। কলিগরা বিয়ের প্রস্তাব দিলে সেখানেও বাবা না করে দেন। কোনো ছেলের চেহারা তার ভালো লাগে না তো কোনো ছেলের টাকাপয়সা তার কাছে কম মনে হয়। হয়তো মেয়ের জন্য পার্ফেক্ট ছেলে খুঁজতে গিয়ে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, পৃথিবীতে কেউই পার্ফেক্ট না। এমনকি তার মেয়েও না।
এর মধ্যে বহু নদীর জল বহু জায়গায় গড়াল। বোনের বয়সও ত্রিশ পেরিয়ে চল্লিশের দিকে এগোলো। প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ভুগে একসময় হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। সামান্য অসুখই তীব্র আকার ধারণ করায় একসময় বোনটা মারা গেলেন। মৃত্যুর সামান্য আগে বাবাকে কাছে ডেকে বললেন, বাবা বলুন আমিন।
বাবা বললেন, আমিন।
- আবার বলুন আমিন।
- আমিন।
- আরেকবার বলুন আমিন।
- আমিন।
বোনটা তারপর একরাশ ব্যাথা নিয়ে বললেন, ওয়াল্লাহি! আল্লাহ যেন আপনাকে আখিরাতে জান্নাতের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন যেভাবে আপনি আমার যৌবনে আমাকে বিয়ের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছেন।
** ভাই শিহাব আহমেদ তুহিন থেকে সংগ্রহিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১৪