বিখ্যাত আরব কবি আবু নুয়াসের। অশ্লীল কবিতার জন্য আরব কিংবা অনারব সবার কাছেই তিনি সমানভাবে পরিচিত। তার বাবা ছিলেন আরব, মা পারস্যের। আত্মীয়-স্বজন কারো মধ্যেই কাব্যচর্চার বাতিক ছিল না। কাব্য ছিল তার সহজাত প্রতিভার একটি।
জন্মের সময়ে বাবা মারা যান। মা আরেকটি বিয়ে করে তাকে রেখে আসেন বসরায়। সেখানে তিনি কুরআন নিয়ে পড়াশুনা করেন। পুরো কুরআনের হাফিজ হন। তার পরবর্তী জীবনে কুরআনের শিক্ষার খুব বেশি প্রতিফলন দেখা না গেলেও বলা যায় জীবনের শেষটা হয়তো এ কুরআন দিয়েই রচিত হয়েছিল। শেষের কবিতা রচনায় এক বড়ো প্রভাবক ছিল আল্লাহর এই কালাম।
বালক বয়সেই দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। প্রতিভাও ছিল নজরকাড়া। যার কারণে খুব সহজেই কুফার বিখ্যাত কবি আবু উসামা ওয়ালিবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আবু উসামা তাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। দুঃখজনকভাবে, আবু নুয়াসের মতো প্রতিভাবান ব্যক্তিকে শৈশবে সবক দিয়েছেন আবু উসামার মতো কবি, যার কবিতাজুড়ে ছিল কেবল অশ্লীলতা, যৌনতা এবং সমকামিতা। উস্তাদের কাছে আবু নুয়াস যে এসবের পাঠ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন তা তার পরিণত বয়সের কবিতা দেখলেই বুঝা যায়। আবু উসামা সমকামিতাকেন্দ্রিক যেসব কবিতা লিখতেন, তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতেন আবু নুয়াসের ওপর। বড়ো হয়ে আবু নুয়াসও গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন-
“কতোবারই তো ভাইরা এসেছে আমার কাছে নিয়ে উদার মন,
তারপরেও এড়াতে পেরেছে গর্ভাবস্থা, দিতে হয়নি জন্মদান।”
এটা সবচেয়ে শালীন কবিতার মধ্যে একটি। সমকামিতা নিয়ে তিনি এমন এমন সব কবিতা লিখেছেন যা যে কোনো সভ্য সমাজে প্রকাশের অযোগ্য।
তিনি সমকামিতার পাঠ যদি আবু উসামার কাছ থেকে শিখে থাকেন, তবে প্রেমের পাঠ শিখেছিলেন জানান নামের বসরাবাসী এক নারীর কাছ থেকে। প্রেমঘটিত যেসব কবিতা লিখেছেন তা সম্ভবত জানানকে কেন্দ্র করেই। যদিও তাদের সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। আবু নুয়াসের বিকৃত রুচি জানান বেশিদিন সহ্য করতে পারেনি। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার পর জানান বসরার পথে পথে আবু নুয়াসকে অভিশাপ দিয়ে বেড়াতে থাকে। অভিশাপের প্রত্যুত্তরে আবু নুয়াসের জবাবও ছিল বেশ রসময়-
“তোমার অভিশাপ এসেছে আমার কানে,
দাও যতো ইচ্ছা শাপ আমার সোপানে।
গাল দেয়ার সময় তোমার ঐ মুখে কি বাজে না আমার নাম?
এর বেশি আর কী চাইতে পারি বলো, তোমার ঠোঁটে আমার নাম!”
প্রথম প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হবার কিছুদিন পর আবু নুয়াস বসরা থেকে তৎকালীন আব্বাসী খেলাফতের রাজধানী বাগদাদে চলে যান।
একজন জাহেল কবির যেসব গুণ রপ্ত করতে হয়, তার সবই তিনি বাগদাদে যেয়ে রপ্ত করেন- অতিরিক্ত মদ্যপান, জিনায় লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। জানানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর বহু নারীর সাথে আবু নুয়াসের সম্পর্কের কথা তার কবিতার মাধ্যমেই জানা যায়। বাগদাদে লম্বা একটা সময় আবু নুয়াস মদের আসরে ডুবে থাকেন। মদকেই বানিয়ে ফেলে জীবনের আসল উদ্দেশ্য-
“জীবন তো জীবনই নয় মদপান বাদে।”
শুধু অশালীন কথা বলায় কিংবা পাপময় জীবন যাপনেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি, কখনো কখনো তার কথায় এবং কাজে প্রকাশ পেয়েছে এমন সব বিষয় যা একজন মুসলিমকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। একবার মাগরিবের সালাতের সময় আবু নুয়াসকে দেখা গেলো একদম প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন। ইমাম সাহেব যখন সূরা কাফিরুন পড়তে গিয়ে বললেন,
“বলুন! হে কাফের সম্প্রদায়।”
আবু নুয়াস সালাতের মধ্যেই জবাব দিলেন,
“(আমি) হাজির।”
নবি-রাসূলদের নিয়ে অনেক বিকৃত আকিদাও উনার বিভিন্ন কবিতায় পাওয়া যায়। এক কবিতায় তো যারা মদ পরিবেশন করে তাদের চেহারাকেই কিবলা বানিয়ে বসলেন-
“যেহেতু আঙ্গুরক্ষেতের কন্যারা আমার শরাব, আর (পানীয় পরিবেশনকারী) সুন্দর কিশোররা আমরা কিবলা;
তাই আমি এদের ওপরই ভরসা করি আঁধার রাতে, যা ইচ্ছে বলতে থাকুক তিরস্কারকারীরা।”
ইসলামে সমকামিতা খুবই ভয়াবহ অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা অনেক শক্তিশালী সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন সমকামিতায় লিপ্ত থাকার কারণে। আবু নুয়াসের কাব্য প্রতিভার সিংহভাগ কেটেছে বাগদাদে, খলিফাদের একদম দরজার সামনে। তারপরেও যে তিনি নির্বিঘ্নে এসব অশালীন কথা লিখে যেতে পেরেছেন, তার পেছনে একটা বড়ো কারণ হচ্ছে খলিফা হারুনুর রশিদের ছেলে আল-আমিনের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। যার কারণে খলিফাপুত্রের দিকে ইঙ্গিত করে এমন সমকামিতাকেন্দ্রিক কবিতা লেখার পরেও তিনি নিস্তার পেয়ে যান-
“প্রেমে পড়েছি, কিন্তু কাউকে বলতে পারছি না কার প্রেমে পড়েছি।
আমি ভয় করি এমন একজনকে যে আর কাউকেই ভয় করে না।
একবার চিন্তা করি যাই হোক, নিবেদন করব আমার ভালোবাসা তার কাছে,
তখন নিজের মাথার কথা ভেবেও চিন্তা হয়, এখনো কি তা জায়গামতো আছে?”
আনুমানিক ৮১৪ সালের দিকে আবু নুয়াস মারা যান।
আবু নুয়াসের জীবন যদি শুধু এতোটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তবে তাকে নিয়ে এ গল্প লেখার কোনো মানে ছিল না। তার কথা আমি প্রথম জানতে পারি এদেশে সুশীলদের পুরোধা অভিজিৎ রায়ের একটি লেখা থেকে। লেখাটি সমকামিতার পক্ষে ছিল। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, ইসলামে একেবারে আদিকাল থেকেই সমকামিতা রয়েছে। তবে এ কথা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি কুরআন-হাদিস কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো ইতিহাসের বই থেকে দলীল না দিয়ে দলীল দিয়েছিলেন আবু নুয়াসের কবিতা থেকে। সেগুলো কীভাবে ইসলামের দলীল হয় তা আমার দুর্বল মাথায় ধরেনি। হুমায়ুন আজাদও তার বইতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে উনাকে স্মরণ করেছেন।
মদ, সমকামিতা ও দেহকেন্দ্রিক কবিতাগুলোর জন্যে ওরিয়েন্টালিস্ট লেখকরা উনাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে একটুও ভুল করেননি। কেউ কেউ তাকে বলেছেন- The Greatest Poet in Islam। বিবিসি একবার উনাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ ছেপেছিল এই শিরোনামে- The Arab poet who worshipped wine.
তার অন্ধকার জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি বেশি হওয়ায় আলোটুকু ঢাকা পড়ে গেছে। অবশ্য, খুব বেশি আলো সেখানে ছিলও না। সারাটা জীবন তো মদ আর বিকৃত যৌনতার পক্ষেই কলম ধরেছেন। তবে যে ইতিহাসটা ওরিয়েন্টালিস্ট লেখকরা তুলে ধরেন না তা হচ্ছে, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আবু নুয়াস অন্তরে পরিবর্তন অনুভব করেছিলেন। নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন ধর্মীয় জ্ঞান আহরণে।
দুনিয়ায় মজে থাকা এ কবির কিছু কবিতা পাওয়া যায় যে একেবারেই দুনিয়াবিমুখতা ও আল্লাহভীতি নির্দেশ করে। সম্ভবত জীবন সায়াহ্নে এ কবিতাগুলো তিনি রচনা করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, শৈশবের সেই ধর্মীয় জ্ঞান তার মনে আন্দোলন সৃষ্টি করতো এ নোংরা জীবন ছেড়ে পবিত্রতার সাথে বাঁচতে। তখন তিনি এসব কবিতা লিখতেন।
উদাহারণস্বরূপ তার এ কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে তাকওয়া-
“পর্দার আড়ালে যে-ই হোক না কেন লুকায়িত,
আল্লাহর সামনে সে ঠিকই হয় প্রকাশিত।
অনেক কিছুই আছে যা তোমরা দেখতে পাও না,
কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে কিছুই লুকানো যায় না।”
আবার এ কবিতায় ফুটে উঠছে দুনিয়াবিমুখতা-
“কোনো বুদ্ধিমান যদি গভীরভাবে দেখে এ পৃথিবীকে,
দেখবে সে এক শত্রুকে, পাশে আছে বন্ধুবেশে।”
মদকে ইবাদতের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এ কবির মুখ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহর প্রশংসা-
“সকল বিলাপ থেমে যাবে,
সব অশ্রুও শুকিয়ে যাবে।
সব অর্থ একদিন যাবে ফুরিয়ে,
সকল স্মৃতিগুলো একদিন যাবে হারিয়ে।
শুধু থাকবেন আল্লাহ-
কেউ যতোই মহান হোক না কেন, আল্লাহ তার চেয়েও মহান।”
আবু নুয়াস মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন তাকে স্বপ্নে দেখেছিল। স্বপ্নে তারা আবু নুয়াসকে জিজ্ঞেস করল, আল্লাহ আপনার সাথে কেমন আচরণ করেছেন?
আবু নুয়াস তাদেরকে বললেন, তিনি আমার সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। কেন জানেন? শুধু আমার একটা কবিতার কারণে। কবিতাটা এখনো আমার বালিশের নিচে রয়েছে।
লোকজন তার বালিশের নিচে গিয়ে দেখল সত্যিই সেখানে কাগজের মধ্যে একটা কবিতা লেখা রয়েছে-
“আমার রব! আমার গুনাহ যে অনেক বড়ো,
কিন্তু আমি জানি তোমার দয়া তার চেয়েও অনেক বড়ো।
তাই ডাকছি তোমায়, যেভাবে বলেছ তুমি ডাকতে বিনয়ের সাথে,
যদি তুমি ফিরিয়ে দাও, তবে আমি দয়া পাব কার কাছে?
কেবল যদি ভালো মানুষদেরই তোমাকে ডাকার অধিকার থাকে,
তবে (আমার মতো) পাপীরা যাবে কার কাছে?
আর কোনো অবলম্বনই নেই, তাই তোমার ভরসায় দণ্ডায়মান,
আশা রাখি তোমার ক্ষমার, আর যাই হোক, আমি তো মুসলমান।”
শুধু একটা কবিতা লেখার জন্য একসময় যিনি সমকামিতা, মদ খাওয়ার মত জঘন্য বিষয়কে গ্লোরিফাই করে কবিতা লিখেছিলেন, তাকে আল্লাহ তা’আলা মাফ করে দিয়েছিলেন বলে আশা করা যায়। আর মাফ করাটা অসম্ভব মনে হবে কেন? যিনি শুধু একটা কুকুরকে পানি পান করার জন্য এক পতিতাকে মাফ করেছিলেন, শেষ সময়ে আত্মশুদ্ধির দিকে ধাবমান হবার জন্যে একশ লোককে খুন করা ব্যক্তিকে ক্ষমা করেছিলেন, তাঁর ভয়ে নিজের লাশ ছাই করে দেয়া কাফন চোরকে ক্ষমা করেছিলেন; তাঁর কাছে আবু নুয়াসকে ক্ষমা করা কি খুব বেশি কিছু?
আমাদের রব আর কেউ নয় কেবল আল্লাহ, এ আনন্দ আমরা কোথায় রাখব!
সংগ্রহিত ও কৃতজ্ঞতায় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ২:৩৬