হাইস্কুলে পড়ার সময়ে একবার ক্লাসে ৫ মিনিট দেরি করে যাওয়াতে বেরসিক মাস্টার আমাকে দুই হাত পাততে বললেন। সম্ভাব্য শাস্তির কথা ভেবে হাত পাততে ইতস্তত বোধ করছিলাম। একাধিকবার বলার পর আমি হাত দুটো বাড়িয়ে দিলাম, তিনিও মনের খায়েস মিটিয়ে বেত দিয়ে আমার সাদা হাত দুটি লাল করে দিলেন। পুরো ক্লাসের পিনপতন নিরবতার মধ্যেও একটা মেয়ের ক্ষিন হাসির শব্দ আমার মনে কাটার মত বিধেছিল। আমি নিবার্ক হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম আর মনে মনে মাস্টারের চৌদ্দ গৌষ্ঠি উদ্দারে ব্যস্ত ছিলাম। আজকের মত ক্লাস এখানেই সমাপ্ত। অনেকগুলো বছর পর...
কমলাপুর রেল স্টেশনে দাড়িয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়, আমাদের দেশের ট্রেন ঠিক টাইমে চলে আসলে নিজের কাছেই কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হয়। প্লাটফর্মএ ট্রেনের জন্য কতক্ষন অপেক্ষা না করলে পুরো ভ্রমনটাই কেমন জানি পানসা পানসা লাগে। কিন্তু ট্রেনের অপেক্ষার সময়টা কেন জানি আজকে একটু বেশিই দীর্ঘ মনে হচ্ছে । আমার সামনে অনেকেই অপেক্ষার অবসানের জন্য পায়চারি করছে, অনেকে আবার নিজেদের বাচ্চাদের এলোমেলো গতিবিধি নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ত। একটা মেয়েকে দেখলাম দুর থেকে দৌড়ে আসছে হয়তবা ভাবতেছিল ট্রেন মিস করল কিনা? তাই সময়ের সাথে উনার এত দৌড় প্রতিযোগিতা। যেকোন স্টেশনে এমন ঘটনা প্রায়ই চোখে পড়ে তবে, এটা কিন্তু তেমন কোন কমন ঘটনা ছিল না।
উনি যতক্ষনে দৌড় শেষে আমার কাছাকাছি এসে পৌছাল ততক্ষনে অনিয়ন্ত্রিত বিক্ষিত চুলগুলো উনার মুখের উপরে এলোমেলো ভাবে দখল নিয়েছে। মেয়েদের এমন অবস্থায় দেখতে বোধহয় একটু বেশিই মায়াবী মনে হয়। আমিও আর আট/দশ জনের মত কিছুটা কৌতুহল নিয়ে উনার গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। কিন্তু সে কি !! এই রমনীকে তো কেমন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে। দুইজনের মাঝে কিছুক্ষন কৌতুহলপূর্ন নিরব চাহনির পর বুঝতে পারলাম আমরাই সেই চির প্রতিদ্বন্ধি যারা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতেও পিছপা হতাম না।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বয়স, অভ্যাস ও শারিরিক গঠন এখন অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। নিরবতার অবসানের পর, জিজ্ঞেস করলাম তোমার এত তাড়া কিসের ? জ্যামে আটকে ছিলাম অনেকক্ষন তাই ভাবলাম ট্রেনটা মিস করব বুঝি ।
বললাম, ভাগ্যিস আজকে দেড়ি করার জন্য কোন শাস্তি দেয়া হবে না, নয়তো তোমাকে এত লোকের সামনে হাত পাততে হতো। সে অনেকটা লজ্জিত হয়ে “দুখিঃত” বলেছিল বটে তবে দুঃখবোধ থেকে তার লজ্জারাঙ্গা মুখটাই বেশি উজ্জল হয়ে ধরা পরেছিল। এত চঞ্চল একটা মেয়ে এমন করে এতটা কাতরভাবে লজ্জিত হতে পারে সেটা ভাবতেই অবাক লাগছিল। বেশ কিছুক্ষন আলাপচারিতার পর তার বিধবা জিবনের একাকিত্ব, বৃদ্ধ মা-বাবাকে সাহায্য করা, প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরির ব্যস্ততা সবকিছু শুনে একটা মেয়ের জিবনযুদ্ধ আমাকে অনেকটাই আবেগপ্রবন করে তুলেছিল। বলেছিলাম, তুমি কি পুনরায় তোমার জিবনে অন্য কাউকে সুযোগ দিতে চাও? সে কিছুক্ষন নিরব থাকার পর বলল, কেউ আমাকে করুনা করুক সেটা আমি চাই না এবং আমি কারো আবেগের কারন হই সেটাও আমার পছন্দ না।
আমি কিন্তু তোমার প্রতি আবেগ, করুনা কিছুটাই প্রদর্শন করছি না আমি শুধু আমার নিজেকে ভাল রাখার জন্য তোমার সাহায্য চাইছি। সে ঈষৎ হাসি হেসে বলল, তুমি বরাবরই বিলম্ব কর এবারও অনেকটা তাই।
ততক্ষনে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো.....
আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম, আমরা দুইজনেই হয়তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিলম্ব করেছি বটে তবে গন্তব্যে পৌছানোর জন্য ট্রেনটা কিন্তু একসাথে সঠিক সময়েই পেয়েছি।
এখন গন্তব্য স্থানটা এক হবে কিনা সেই অপেক্ষায়...!!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৯:১৩