কয়েক দশক ধরে কিছু কিছু অপ্রচলিত শব্দ অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি বিস্তৃত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। চমক ও অভিনবত্বে তা সারাও ফেলেছে। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম, পোস্ট-কলোনিয়ালিজম প্রভৃতি শব্দ গুলো আমরা শুনতে পাচ্ছি। আজকাল Prefix হিসাবে ‘পোস্ট’ কথাটি নানা তত্ত্বগতবিষয়ে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। চিন্তাভাবনার নানা বিষয় ও মাত্রা এর দ্বারা ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। এই ‘পোস্ট’ বাদীরা আসলে রেনেশাঁস বা এনলাইটনমেন্ট আশ্রয়ী চিন্তাভাবনা ও জ্ঞনতত্ত্বের ঘোরতর বিরোধী। আলোক প্রাপ্তির যুগের বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিতে বিরোধিতা করে এক অভিন্ব ব্যাখ্যা তারা হাজির করেছেন। পোস্ট- মডার্নিজম-এর অন্যতম প্রবক্তা জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার বলেছিলেন, এই ‘পোস্ট’ হল অনেকটা ধর্মান্তরনের মতন। মডার্নিটি থেকে পোস্ট- মডার্নিটি।
বহু চিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিকদের চিন্তাভাবনার এলাকায় পোস্ট- মডার্নিজম বা উত্তর আধুনিকতাবাদ- এর নানান টুকরো টুকরো ভাবনা অনেক আগে থেকে এলেও একে পুরো দার্শনিক তত্ত্বের আদলে দাঁড় করান জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার, ম্যাকাইনটাওয়ার ও রিচার্ট রোবটি। সাহিত্য এই ধারণাটিকে এনেছিলেন ইহাব হাসান।
আরনল্ড টোয়েনবি দেখিয়েছিলেন, মডার্ন বা আধুনিকতার যুগটির প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে। উত্তর আধুনিকতার চিন্তাভাবনার বিষয়গত, আঙ্গিকগত নানা প্রশ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ১৯১৮-১৯৩৯-এর মধ্যে উল্লেখিত হতে থাকে। কালপঞ্জীর বিচারে অনেকের মনে হতে পারে আধুনিকতার যুগ শেষ হওয়ার পরই ‘উত্তর’ যুগ শুরু। রাইট মিলস ঘোষণা করেছিলেন, আমরা আধুনিক যুগের শেষে পৌঁছে গেছি। এরপরই ‘উত্তরআধুনিকতার যুগ’ শুরু। এভাবে দেখার বিরুদ্ধে টোয়েনবি বলেছিলেন, আধুনিকতায় বিশ্বচরাচরের সমন্বয় থাকে না, এই সমন্বয় ঘটবে উত্তরআধুনিকতায়, যা ইতিহাস ও সমাজের মুক্তি ঘটাবে, ইত্যাদি।
কালপঞ্জী, বিষয়বস্তু এবং দৃষ্টিভঙ্গির নিরন্তর সংঘর্ষ ও অসংলগ্নতায় উত্তর আধুনিকতাবাদের ধারণাটি অস্পষ্টই থেকে যায়। মডার্নিটি ও পোস্ট-মডার্নিটির-এর মধ্যে টানাপোরেন এই অস্পষ্টতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই টানাপোরেন শুরু হয় ত্রিশ দশকে, যখন সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা স্থাপত্য নগর কাঠামো সম্পর্কে সম্পূর্ন আলাদা বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। এরা প্রচলিত সিমেট্রিক্যাল (প্রতিসাম্যযুক্ত) গঠনরীতির বদলে অ্যাসিমোট্রিক্যাল (প্রতিসম্যহীণ) গঠণরীতিকেই প্রতিষ্ঠা করেন। এক্ষেত্রে রবার্ট ভেন্টরি, চার্লস্ জেনকস্ কেনেথ ফ্র্যাম্পটন প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। আর একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখককে গৌণ করে লিখিত বিষয়ের (টেক্সট) খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করার নতুন তত্ত্বটিও হাজির করা হয়। এই গৌনতাকে, রলাঁ বার্থ দেখান, ‘ডেথ অফ এন অথর’ বা ‘লেখকের মৃত্যু’ হিসেবে। এই দুটি ভাবনার এলাকা দিয়েই অনেক দেখান উত্তর আধুনিকতার কালপঞ্জী শুরু। নান্দনিকতা ও সমাজ বাস্তবতা তথা রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে টানাপোড়েন ও বিতর্ক, তা বহুদিনের। এর প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির পুনর্বিচারের দিকে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন থিঅডোর আডরনো। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির চর্চা ও আলোচনায় অস্পষ্টতা, অনিশ্চয়তা ও স্ববিরোধিতার উপাদান থেকে উত্তর আধুনিকতার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। উত্তর আধুনিক নান্দনিকতা ও রাজনীতির পারস্পারিক সম্পের্কের মধ্যে মানুষ যে সম্পৃক্ত তা লিওতার, ম্যাকইনটায়ার, রোবটি, জেমশন প্রমুখ তুলে ধরেছিলেন।
উত্তর আধুনিকতার অভ্যূত্থানের গুরুত্বপুর্ণ বছরটি হল ১৯৬৮ সাল। সেই সময় গোটা ইউরোপ জুড়ে বামপন্থী ছাত্র-যুব-শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীরা মূলত এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী ও নানা ক্ষেত্রে ‘অটোনমি’র দাবিতে রাস্তায় পড়েছিলেন। ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিল। কিছু এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন কারীদের দক্ষলে চলে আসে। লক্ষহীন,রোমান্টিক বিক্ষোভমূলক এই তাৎক্ষনিক আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই ব্যার্থ হওয়ার দরুন আসে ঘোর হতাশা, নেতিবাচক চিন্তা বা সিনিসিজম। তাঁদের প্রস্ততিহীন লক্ষ্যহীন আন্দোলনের মৌল উপাদান ও দুর্বলতাগুলি অনুসন্ধান না করে তাঁরা একে মার্কসবাদের ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নিয়ে নানা বিষয়ে পুনর্বিচার আরম্ভ করেন। বিশেষ করে যারা ‘তে ক্যোয়ে’ নামে একটি আভা গার্দ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা পরবর্তীকালে পোস্ট-স্ট্রক্চারালিজম, পোস্ট-মডার্নিজম, লোগো-সেন্ট্রিসিজম, গ্রিন পিস এমন নানা ছোট-বড় ভাবনার এলাকা গড়ে তোলেন।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে এসেছিল আধুনিকতার চিন্তাভাবনা। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যাক্তিবাদ বা ব্যাক্তির আত্মপ্রকাশই ছিল এর কেন্দ্র বিন্দু। লেখক-শিল্পী-কলাকুশলী প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব স্টাইল গড়ে উঠতে তা সহায্য করেছিল। কবিতা পড়ে কবিকে চেনা যেত, ইনস্টুমেন্ট শুনে বা গায়কীতে বোঝা যেত কার বাজনা ও সুর, মূর্তি দেখে চেনা যেত ভাস্কর্য কার, সিনেকা বা থিয়েটার দেখে বোঝা যেত নির্দেশনা কার ইত্যাদি। রবীন্দ্র-শরৎ-নজরুল- জীবনানন্দের শৈলী, প্রমথেশ-শিশির-ঋত্বিক-সত্যজিৎ শৈলী আলাউদ্দীন-বড়গোলামের শৈলী প্রভৃতি স্বকীায়তার গরিমায় আধুনিকতার দ্যোতক হতে পেরেছিল। উত্তর আধুনিকতায় এভাবে আর ‘চেনা’‘বোঝা’ চলবে না। যে আঁকছে, লিখছে, নাচছে, গাইছে তার ‘আমি’ আর থাকবনা। সব ভেঙ্গে চুরে দেওয়া হল। শৈলীর নির্ধারীত মানে আর রইল না, চিহ্নের নির্ধারিত ইশারা আর রইলনা। ধরা বাধা গৎ ভেঙ্গে দেওয়ার কথা হলো। কবিকে আর দরকার নেই, লেখা পড়ে জানবার জন্য লেখকের প্রয়োজন নেই। পাঠক সে সব বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন করে জেনে নেবেন। কাব্য-গদ্য, সুর-তাল-ছন্দ, আলো-ছায়া সবকিছু ভেঙ্গে ভেঙ্গে জানতে হবে। পুরো দায়িত্বটাই তাই পাঠক-দর্শক-সাহিত্যিক নিজেকে গড়ে তোলেন। উত্তর আধুনিকতায় তাঁরা নিজেদের ভাঙ্গেন।
ভাষাতত্ত্বের আকারবাদীরা উত্তর আধুনিকতার সূচনা করেন। তাদের বলা হত ফর্ম্যালিস্ট। রুশ দেশে আকারবাদী বুদ্ধিজীবী ভিকতর স্কোলাভস্কি ‘আর্ট অ্যাজ টেকনিক’ বা ‘কৌশল রূপে শিল্প’ বইটি ১৯১৭ সালে প্রকাশ করেন। একটি পৃথক স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, ‘শিল্প হল চিত্রকল্পের মাধ্যমে চিন্তা’ এবং ‘কবিতা হল ভাবনার চিন্তা করার প্রথম ও প্রধান উপায়।’ আকারবাদীরা বলেন, সাহিত্যের পাঠবস্তকে আলোচনা করা প্রয়োজন। পঠবস্ত নির্মাণের নিজস্ব ব্যাকরণ, নিয়ম ও কৌশল থাকে। সেসবকে কেন্দ্র করেই আলোচনা হওয়া উচিত। আইডিয়াকে চাপিয়ে দেওয়ার কোন দরকার নেই। একজন মটরমেকানিক যেভাবে গাড়ির কলকব্জা দেখে, সেভাবেই সাহিত্যের পাঠবস্তকে দেখতে হবে। সাহিত্য তৈরী হয় শব্দ দিয়ে, নিয়ম বা পদ্ধতি দিয়ে-আইডিয়া বা আবেগ দিয়ে নয়। আকারবাদীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সাহিত্যে আঙ্গিক বা ফর্ম তার বিষয়বস্তু নয়। এরপর থেকেই সাহিত্য, সাহিত্য পাঠ ও সাহিত্য আলোচনা সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা ও দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ ও গবেষণা শুরু হয়। এই তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে বলা হত সেন্টপিটার্সবুর্গের ‘ওপেজ গ্রুপ’। তাদের মধ্যে ছিলেন রোমান ইয়াকবসন, অসিপব্রিক, য়ুরি তাইনিয়ানভ, বরিস আইসেনবম, মিখাইল বাখতিন এবং বরিস তোমাশেভস্কি প্রমুখ। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রুশ বুদ্ধিজীবীরা সে সময় এদের চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে তীব্র মতবাদিক সংগ্রাম গড়ে তোলেন। এক্ষেত্রে সব চেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নেন সোভিয়েত শিক্ষা বিভাগের প্রথম কমিশার, প্রখ্যাত তাত্ত্বিক, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও অনন্য বাগ্মী আনতলি ভাসিলিভিচ লুনাচারস্কি। দুই ও তিনের দশক ধরে ভাষা সাহিত্য শিল্প প্রভৃতি নানা বিস্তৃত ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাভাবনা আজও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ফারদিনাঁ দ্য সস্যুর ছিলেন স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদ ভিত্তিক ভাষাতত্ত্বটির জনক। ভাষাতাত্ত্বিক ও জেনেভা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সস্যুর ভাষার প্রকৃতি চরিত্র জানবার জন্য ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস পড়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তাঁর সমসাময়িক ভাষাতাত্ত্বিকরা ভাষার ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের গবেষণায়, বিশেষ করে উনিশ শতকের শেষের দিকে জার্মান গবেষকরা ভাষার মধ্যে তাদের প্রবল জাতভিমানের শেকড় খুঁজে পেয়েছিলেন। ছিলেন সিন্ক্রনিক মডেলের অনুসারী। সিন্ক্রনিক মডেল হল ভাষার বিভিন্ন স্তরগুলিকে অনুসন্ধান করা আর ডায়াক্রনিক মডেল হল ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসকে লক্ষ্য করা।
ভাষাকে সস্যুর দুটি ভাগে ভাগ করেন, (১) ‘ল্যাঙ’ অর্থাৎ নৈর্ব্যত্তিক নিয়ম পদ্ধতি বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রত ভাষা, (২)‘প্যারোল’ অর্থ্যৎ কথ্যভাষা বা শব্দ। কথ্য ভাষা বা ‘স্পিচফর্ম’কে তিনি গ্রহণ করেননি। ল্যাঙ-এর ডায়াক্রনিক ও সিন্ক্রনিক দুটি মডেলের মধ্যে সিন্ক্রনিক মডেলকেই গ্রহণ করে গবেষণা চালিয়ে গেছেন।
ডায়াক্রনিক মডেলকে বাতিল করার ফলে সস্যুর দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। (১) ঐতিহাসিক বিবর্তনের থেকে ভাষাকে আলাদা করে তিনি ভাষাকে কাঠামোগত বা গঠনপ্রনালীরূপে দেখেন। (২) মানুষের সমস্ত কাজকর্ম, ও চিন্তাভাবনার নিয়ন্ত্রন হয় ভাষা দিয়েই। ধ্যানধারনাকে আমরা ব্যাক্ত করি ভাষার সাহায্যে। প্রনালী বা কাঠামোভিত্তিক ভাষার সাহায্যে সাহিত্য গড়ে ওঠে। বিশেষ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যে। সেই সাহিত্যকেও আমাদের বুঝতে হবে ভাষা কাঠামো ও পদ্ধতি দিয়েই। সস্যুর এই প্রণালী বা পদ্ধতিকে বলেছিলেন সেমিওক্সি। তিনি বলেছেন, সাহিত্যের লেখা বা রচনাংশের প্রথাগত ব্যাখ্যা নয়, অন্যান্যরা কিভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন সেটাই বিচার্য। সেমিওটিক্স শব্দটি প্রথম ব্যাবহার করেন উনিশ শতকে আমেরিকার ভাষাবিদ সি এস পিয়ার্স তাঁর চিহ্ন সম্পর্কিত আলোচনায়। সস্যুর দেখেছিলেন, ভাষাতত্ত্ব হল চিহ্নবিজ্ঞানের একটি শাখা মাত্র। মানুষের মস্তিষ্ক চিহ্নের সাহায্যে সবকিছু জানে। ভাষা ছাড়াও নানা রকমের চিহ্নের তিনি উল্লেখ করেছেন। অঙ্গভঙ্গি, নাচ, নানাধরনের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি এর মধ্যে পড়ে। এছাড়া ভাষার বাইরেও নানাক্ষেত্রে জুড়ে, যেমন মিথ, আচার-আচরণ, উৎপাদন, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, আত্মীয়তা, অভ্যাস প্রভৃতি সবকিছুকে ভাষার মডেলে ফেলে কাঠামোবাদীদের বিশ্লেষণ করার চেষ্টার মধ্যে তথাকথিত নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা বা উত্তর আধুনিকতার প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছিল।
অবশ্য সস্যুরের বিশ্লেষণ অনেকে মানেননি। তাঁরা বলেছেন, এই বিশ্লেষণ বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। একে তাঁরা ‘অ্যাবসট্রাকট অবজেকটিভিজম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা এও দেখিয়েছেন, চিহ্নের বাস্তব উপাদান থেকে আদর্শ বা মতবাদকে আলাদা করা যায়না। পারস্পারিক সামাজিক আদানপ্রদানের বাস্তব রূপ থেকে চিহ্নিকে পৃথক করা যায় না। সমাজের সংগঠিত পারস্পরিক আদানপ্রদানের অংশ হিসাবে চিহ্নকে আমরা দেখতে পাই। এর বাইরে তা অবস্থান করে না। মানুষে মানুষে যোগাযোগ এবং যোগাযোগের নানা ক্রিয়াকৌশল বাস্তব ভিত্তি ছাড়া ঘটেনা। সামাজিকভাবে যে চেতনা গড়ে ওঠে তার দ্বারাই মানুষের পারস্পারিক ভাব বিনিময়ের ভিত্তিতে ভাষাক্রিয়া গড়ে ওঠে। তাঁরা একই ‘সেমিওটিক অ্যাক্ট’ বলেছেন। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন, ভাষা গড়ে ওঠার ইতিহাসে উৎপাদন ব্যবস্থাই চুড়ান্ত ভূমিকা পালন করে। শেষ বক্তব্যটার মধ্যে অবশ্য কিছুটা একপেশে ঝোঁক রয়েছে।
কাঠামোবাদ থেকে উত্তর কাঠামোবাদ-এর মধ্যে মিলও আছে অমিলও আছে। একটার থেকে আর একটা উত্তরন হিসাবেই দেখানো হয়েছে। কাঠামোবাদের গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছিল সিন্ক্রনিক মডেলকে। শব্দের সঙ্গের শব্দের পার্থক্য থেকে অর্থটা বেরিয়ে আসে। উত্তর কাঠামোবাদীরা এ নিয়ে তর্ক করেননি বরং মেনে নিয়েছিলেন। তাঁরা যা বাড়তি কথা বলেছিলেন তা হল, শব্দ চিহ্নের ভিতর অসংখ্য মানের ভাড়ার থাকা। আজ এটি শব্দের যা মানে, ভবিষ্যতে তা নাও থাকতে পারে, একাধিক মানেও যুক্ত হতে পারে। শব্দের অর্থ একজায়গায় চিরদিন স্থির থাকে না, পাল্টাতে থাকে। উত্তর কাঠামোবাদীরা আধিপত্যবাদী ক্ষমতার প্রভাব ও পারস্পারিক সম্পর্কের কথাও বলেছেন। বাংলা ভাষায় বহু অভিব্যাক্তি দিনেমার, পর্তুগীজ, ফরাসী ও ইংরেজরা আসার পর পাল্টে গেছে। নতুন নতুন শব্দার্থ যুক্ত হয়েছে। উত্তর কাঠামোবাদী তত্ত্ব জাকদেরিদা, জাক লাকাঁ, মিশেল ফুকো প্রমুখ গড়ে তুলেছিলেন। আবার একই প্রসারিত করে গড়ে উঠেছে এডোয়ার্ড সাইড, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, হোমি ভাবা প্রমুখের উত্তর ঔপনিবেশিকতার তত্ত্ব।
পোস্ট-মডার্নিজম অন্তর্গত ডিকনস্টাকশন বা বিনির্মানের তত্ত্ব খুবই গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে রেখেছে। বিনির্মান হল সাহিত্যের পাঠবস্তুর সঙ্গে পরিচয়ের একটি উপায় বা পক্রিয়া। কিভাবে পাঠ বস্তু পড়া হবে এটা তারই তত্ত্ব। এর আগেই আলোচিত হয়েছে রাশিয়ার আকারবাদী তত্ত্ব বা সুইস-জার্মান কাঠামোবাদী তত্ত্ব বা আমেরিকার সমালোচকদের নিউ ক্রিটিসিজম এর তত্ত্ব- সবই সাহিত্যের, গদ্য-কবিতার পাঠ্যাংশ মূলত কিভাবে পড়া হবে তারই রকমফের তত্ত্ব। কাঠামোবাদের উপর দাঁড় করানো বিনির্মানের ভাবনা-চিন্তাই পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম-এর তত্ত্ব। এর জনক ফরাসী ভাষাবিজ্ঞানী , দার্শনিক জাক দেরিদা। তিনি কান্ট, নি;শে, হুর্সেল প্রমুখের চিন্তা থেকেই এ তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন। কারোল স্টাবাইল উল্লেখ করেছেন যে, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম দিয়েছে তত্ত্ব। আর পোস্ট-মডার্নিজম তাকে প্রয়োগ করেছে।
পোস্ট-মডার্নিজম-এ নারীবাদের পৃষ্ঠভূমি আধুনিকতাকে দেখা হয়েছে পুরুষের চিন্তায়, পুরুষের জন্য, পুরুষের তৈরী। বহু রকমের নারীবাদের মধ্যে উত্তর আধুনিকতায় নারীবাদ একটি। মহিলা ও পুরুষ উভয়ের চিন্তাভাবনাই নারীবাদ হতে পারে। কে ভাবছে এটা বিচার্য নয়। কি ভাবছে সেটাই মূল আলোচ্য। নারীমুক্তি, নারীস্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, লেসবিয়ানিজম, নারীর মূল্য, নারীর অধীকার কথাগুলি ‘নারী’ যুক্ত আছে বলেই তা নারীবাদ নয়। ‘নারী’কে যুক্ত করে এইসব কনসেপ্ট পুরুষরাই তৈরী করেছে তাদের প্রয়োজনেই। তাই উত্তর আধুনিকতায় নারীবাদ এইসব কনসেপ্ট-এর বিনির্মানের কথা বলেছে। ইমেলডা হুইলিহ্যান বলেছেন, আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক এইসব চিন্তা ও ক্ষমতার কেন্দ্রকে তাই আক্রমণ করতে হবে। এই কেন্দ্রকে নারীবাদীরা বলে পিতৃতান্ত্রিক। বুর্জোয়া তথা পুঁজিবাদী আধুনিকতার মতবাদ আসলে পুরুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও অনুশাসনে দুষিত অন্যান্য নারীবাদী মতবাদগুলিও তাই। যেখানে পুরুষ থাকবে ক্ষমাতার কেন্দ্রে-নারীরা সেখানে অন্তঃপুরে, ঘর-গৃহস্থালী ও সন্তান প্রতিপালনের কাজে। পুরুষ হবে ‘আমরা’ আর নারী হবে ‘ওরা’। পুরুষ হবে ‘পাবলিক’ আর নারী হবে ‘প্রাইভেট’। পুরুষ থাকবে বাইরে আর নারীরা ঘরে। এভাবেই পুরুষের চোখে নারীকে দেখা হয়েছে।
আধুনিকতার মধ্যেই নারীবাদী চিন্তার সূচনা হয়েছিল। ১৭৯২ সালে মেরি ওল্ডস্টোনক্র্যাফ্ট-এর ‘ভিনডিকেশন অব দি রাইটস্ অব ওম্যান’ গ্রন্থে যে চিন্তার সূত্রপাত ঘটেছিল তার উত্তরন ঘটে বিশ শতকের গোড়ার দিকে, ব্রিটেনে ও আমেরিকার সমানাধিকারের দাবির আন্দোলনে। অন্যান্য পোস্ট-মডার্ন ভাবনার চিন্তার এলাকায় পোস্ট-মডার্ন ফেমিনিজম একটি তত্ত্বগত রূপ পায় ষাটের দশকে ইউরোপে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের সংশয়, স্বপ্নভঙ্গ ও আত্মজিজ্ঞাসায়। নারীবাদ পুুরুষ ও মহিলা উভয়ের সম্পর্কে পুরনো ধ্যানধারণাকে, লিঙ্গভিত্তিক বিভেদের প্রশ্নকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে কথাটা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে তা হল, সকলের একটিই পরিচয় হবে, নারী বা পুরুষ নয়, মানবজাতি।
এভাবে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে নানা পরিসরে নানা ব্যাখ্যায় উত্তর আধুনিকতাবাদী বিস্তৃত চিন্তাভাবনার এলাকা গড়ে উঠল। তর্কবিতর্খ ও স্ববিরোধিতার মধ্যে একটা কাঠামো গড়ে উঠল। টেরি ইগলটনের ভাষায় বলা যায়, এটা একটা তত্ত্বই। একেই এখন বলা হচ্ছে পোস্ট-মডার্নিটি। ইগলটন দেখিয়েছেন, কিভাবে উনিশ শতকের রোমান্টিসিজমের যুগ পেরিয়ে বিশ শতকের তিন থেকে পঁাঁচ দশকে ‘নিউ ক্রিটিসিজম’- এর মধ্যে দিয়ে আমরা পোস্ট-মডার্নিজম বা উত্তর আধুনিকতাবাদের যুগে পদার্পণ করেছি। এখন এই উত্তর আধুনিকতাবাদ নানা ব্যাপ্তি নিয়ে আলোচিত হচ্ছে। এর প্রভাব ও সর্বত্রই পড়ছে। তাই উত্তর আধুনিকতাবাদ কী তা নিয়ে কিছুটা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আলোচনার সুবিধার জন্য একে তিনটি ভাগ করে নেওয়া যায়-এক গঠন বা নির্মাণগত, দুই দর্শনগত, তিন ফলিত বা প্রয়োগগত।
উত্তর আধুনিকতাবাদ ইউরোপে জায়গা করে নেওয়ার আগেই ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল থেকেই তা ‘নয়া বাম’ মতবাদে অঙ্কুরিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ফ্রান্সে যে অস্তিত্ববাদী মতবাদ চালু হয়েছিল, গভীরতায় না হলেও উত্তর আধুনিকতাবাদ তার চেয়ে পরিসর ও বৈচিত্র্যে অনেক, বেশী তাৎপর্যপূর্ণ। সত্তর দশকের গোড়ায় ফরাসী মার্কবাদী লুই আলথুসারের ‘ফর মার্স’ নামক গ্রন্থটিতে মার্কসীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে ‘ ডিটারমিনিজম’ ও ‘এসেনসিয়লিজম’ সম্পর্কে চিন্তাকে উত্তর আধুনিকতাবাদের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা ও আক্রমন করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে উত্তর আধুনিকতাবাদ কোন রাস্তায় চলবে, তার গতিপথ স্পস্ট করে দিয়েছিল। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা মনে করেন রেনেশাঁ বা আলোকপ্রাপ্তির যুগ থেকে আধুনিকতার মতবাদ বা মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল যা ক্রমেই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। বিংশশতাব্দীর শেষপর্বে বহু নতুন নতুন ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই নাকি এই উত্তর আধুনিকতাবাদী চিন্তাভাবনার অভ্যুত্থান ঘটে। তাঁরা কমবেশী সকলে মনে করেন, এনলাইটেনমেন্ট আশ্রয়ী যুক্তিবাদের যাবতীয় কার্যকারিতা নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাঁদের মতে, যুক্তিবাদের চৌহদ্দি অতিক্রম করতে হবে এবং যুক্তিবাদের সীমাবদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
উত্তর আধুনিকতাবাদের গঠনগত ও তাত্ত্বিক দিকগুলি আলোচনা করে দেখাতে গেলে জাক দেরিদা-র ‘গ্রামাটোলজি’র উল্লেখ করা দরকার। গ্রামাটোলজির বক্তব্য হল, উুচারিত ও লিখিত ভাষার মধ্যে কোন প্রভেদ নেইÑউুচারিত ও লিখিত ভাষার সাহায্যে যা গঠন করা হয় তা লেখক বা কথকের ‘টেক্সট’ এই টেক্সট-এর মধ্যে নিহিত থাকে লেখকের যাবতীয় চিন্তাভাবনা। এই চিন্তাভাবনার বিরোধিতা বা প্রতিরোধ গড়ে তোলে বা টেক্সট বিনির্মানের (ডিকনস্ট্রাকশন) মধ্যে দিয়ে বিপরীত চিন্তা গড়ে ওঠে। প্রতিটি ঘটনা এবং জ্ঞানতত্ত্বের সবকিছুই নির্মান-বিনির্মাণের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রেক্ষিতেই উত্তর আধুনিকতবাদীরা তাঁদের তত্ত্বের কাঠামো গড়ে তুলেছেন।
নির্মাণ ও বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে যে ডিসকোর্সটি বা কথন ও বাচনটি গড়ে ওঠে তার ধারাবাহিক আনুশীলনের মধ্যে দিয়ে বাচনটির ‘জেনিওলজি’ বা পরম্পরা গূঢ়ার্থ পরিস্ফুট হয়। সমগ্রের চেয়ে খন্ডবাচনই এখানে বিবেচ্য। বিভিন্ন ডিসকোর্স বা বাচনগুলির সূত্রবদ্ধ পরম্পরা এবং কার্যকারণের ভিত্তিতে সাধারণীকরণ (জেনারেলাইজেশন) বা বিশ্বজনীন সত্যরূপে ‘মাস্টার ডিসকোর্স’ বা চরমবাচন গঠন করার প্রয়াসকে উত্তর আধুনিকতাবাদীরা মনে করেন ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক। বস্তু সম্পর্কিত ধারনা, সমাজ ও সামাজিক সম্পর্কÑ কোন কিছুকে কেন্দ্র করে সাধারণ সত্যের ধারনা থাকতে পারে না। তাঁদের মতে, মাস্টার ডিসকোর্স বা গ্রান্ড ন্যারেটিভ বলে কিছু নেই। সেই অর্থে ইতিহাসের গতি ও সমাজবিজ্ঞানের কোন বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিগ্রাহ্য ধারনা তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। আধুনিক বিজ্ঞানের ‘কোয়ান্টাম তত্ত্ব’ ‘থিয়োরি অব রিলেটিভটি’, ‘ল অব প্রব্যাবিলিটি’ ‘ডিটারমিনিজম’ প্রভৃতিকে মাস্টার ডিসকোর্স বা চরমবাচন ব’লে উত্তর আধুনিকতাবাদীরা নস্যাৎ করে দিয়েছেন। নিয়ম শৃঙ্খলার চেয়ে ‘কেওস’ বা বিশৃঙ্খলা, সমগ্রের চেয়ে খন্ডতা, নিশ্চয়তার বদলে অনিশ্চয়তা, অস্তিত্ববাদের চেয়ে সন্দেহবাদ, যেমন খুশি চল’, প্রভৃতিকেই উত্তর আধুনিকতাবাদীরা গ্রহণ করেছেন।
উত্তর আধুনিকতাবাদে ভাব ও বস্তুর পারস্পারিক সম্পর্কের ধারনা ও যথেষ্ট বাচনিক অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন। তাঁরা মনে করেন, সত্যের বস্তুগত (অবজেকটিভ) রূপ নেই, সত্য হল মনগড়া (সাবজেকটিভ), ফলে হেগেলীয় পুরানো ভাববাদকেই তাঁরা তাঁদের চিন্তায় প্রাধান্য দিয়েছেন।
যাই হোক, এখন প্রশ্ন হল, এইসব কাঠামো ও দর্শনগত ধারণার ভিত্তিতে তাঁরা কিভাবে কাজ করবেন? আর কিই-বা করবেন? তাঁদের বক্তব্য হল, সমাজের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে আলাদা আলাদা যেসব ডিসকোর্স বা বাচন গড়ে ওঠে তার সবেতেই একটি করে থাকে কর্তৃত্বকারী বাচনের বিপরীতপন্থীরা থাকে দলিত অবস্থানে। দলিতরা পাল্টা বা প্রতিবাচন গড়ে তোলার চেষ্টা করে কর্তৃত্বকারী বাচনের বিনির্মাণের (ডিকনস্টাকশনের) মধ্যে দিয়ে। বিনির্মানের মধ্যে দিয়ে প্রতিবাচন শক্তি অর্জন করে এবং একদিন তা কর্তৃত্বকারী বাচনের কাঠামোতে ‘অন্তর্ঘাত’ ঘটানোর কর্মসূচি উত্তর আধুনিকতাবাদীদের আদর্শগত লক্ষ্য ও সামাজিক ভূমিকা হিসাবে দেখানো হয়। তাদের রাজনীতি হল ‘অর্ন্তঘাত’-এর রাজনীতি। আন্তনিও গ্রাম্পচি দেখিয়েছেন, সমাজজীবনে বিভিন্ন কর্তৃত্বকারী বাচনের আধিপত্যকে হেজিমনি) পরাস্ত করাই মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের বিভিন্ন স্তরে যে সমস্ত নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেইসব ‘সিভিল সোসাইটি’ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে যে সমস্ত কর্তৃত্বকারী খন্ডবাচনের অস্তিত্ব থাকে, সেগুলির বিনির্মাণ ও আন্তর্ঘাতের মধ্যে দিয়ে কি একদিন এই সিভিল সোসাইটি ভেঙ্গে পড়বে? এই প্রশ্ন উত্তর আধুনিকতাবাদের অন্যতম প্রবক্তা মিশেল ফুকো ও জাক দেরিদার কোন স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না। বরং যে বক্তব্য পাওয়া যায় তাহল, রাষ্ট্র ও সিভিল সোসাইটির কোন প্রতিবাচন হয় না। অর্থাৎ রাষ্টের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন গড়ে উঠুক তা তাঁদের অভিপ্রেতও নয় লক্ষ্যও নয়।
পোস্ট-মডার্নিজম বা উত্তর আধুনিকতাবাদের কাঠামোগত, দর্শনগত ও প্রয়োগগত যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা পেলাম তা, এককথায়, যথেষ্ট তাৎপর্যপুর্ণ ‘মতদর্শ’ হিসাবে ইউরোপে আত্মপ্রকাশ করেছে। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ কাজ এই তথাকথিত মতাদর্শের সমর্থক। বস্তুত এই ‘মতদর্শ’ ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ-সাভ্রাজ্যবাদের আধুনিক মতবাদ হিসাবে স্বীকৃতি ও অর্জন করেছে।
উত্তর আধুনিকতাবাদে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, সামাজিক পরিবর্তন’, ‘সমাজবিপ্লব’ প্রভৃতির স্থান নেই। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর পরিবর্তে রয়েছে এসব সম্পর্কিত কিছু বাচন। তাঁদের মতে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন শ্রেণীচরিত্র নেই। বিভিন্ন বাচনকে অন্তর্গত করে সমাজ অবস্থান করে। বাচনিক ভিত্তি কোথাও বর্ণ, কোথাও জাতিগোষ্ঠী, কোথাও লিঙ্গ, কোথাও ধর্ম ইত্যাদি। মানুষ নানা মাত্রিক সত্তায় অন্বিত। যে মানুষ শ্রমিক সে মানুষই পুরুষ বা নারী, হিন্দী বা বাংলাভাষী, হিন্দু বা মুসলমান, ব্রাহ্মণ বা শূদ্র, কালো বা ফর্সা ইত্যাদি। যে পুরুষ-শ্রমিক দলিত অবস্থানে রয়েছে, সেই আবার ঘরে লিঙ্গ পরিচয়ে কর্তৃত্বকারী অবস্থানেÑ সেই আবার সংখ্যালঘু হিসাবে দলিত অবস্থানে রয়েছে। মানুষ তাই একই সাথে বহু মাত্রিক বাচন-প্রতিবাচনের মধ্যে অবস্থান করে।
মার্কসবাদের বিরুদ্ধে উত্তর আধুনিকতাবাদীদের অভিযোগ, মার্কসবাদ একটি বিশেষ মাত্রায় মানুষের (শ্রমিকশ্রেণী) আধিপত্য সংগঠিত ক’রে দমনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করে। তাদের মতে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যাবস্থাকে বলপ্রয়োগ এবং বিপ্লবের আঘাতে ধ্বংস করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের কোন প্রয়োজন নেই। এতে বিশেষ মাত্রায় আধিপত্য থেকে উদ্ভুত হয় সর্বনিয়ন্ত্রক সর্বগ্রাসী শাসনতন্ত্রের মতাদর্শ, যা সিভিল সোসাইটিতে গণতন্ত্রের প্রসার বদ্ধ করে দেয়। এধরনের চিন্তা যদিও নতুন কিছু নয়। উদারনৈতিক বুর্জোয়ারা এভাবেই চিন্তা করেছিলেন।
উত্তর আধুনিকতাবাদীরা বলেন, রাষ্ট্র বা সিভিল সোসাইটির কোন প্রতিবাচন হয় না। কিন্তু এসবের অন্তর্গত বাচনগুলির মধ্যেই হাজার একটা প্রতিবাচন গড়ে উঠতে পারে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অক্ষত রেখেই। অথচ তাঁদের ‘মতদর্শের’ স্ববিরোধিতার প্রতিক্রিয়াশীল রূপটি হল, তাঁরা মনে করেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিবাচর গড়ে তোলাটা খুবই জরুরী। এখানেই তাঁদের উদ্দেশ্য আর আড়াল থাকেনি। পুঁজিবাদের পক্ষেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ উত্তর আধুনিকতাবাদের এই মতবাদ পুরোপুরি সমাজতন্ত্র তথা মার্কসবাদবিরোধী কার্যক্রম ছাড়া আর কিছু নয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনে তাই দেখা যায়, সাভ্রাজ্যবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সাথে কণ্ঠমিলিয়ে তাঁরা যৎপরোনাস্তি উল্লসিত হন। অথচ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণসংগ্রাম-শ্রেণীসংগ্রামের তাঁরা তীব্র বিরোধিতা করেন। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র নির্ধারাণে তাঁদের কাল্পনিক ও অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কচকচানি ও বাচনিক ধূভ্রজাল আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সেটাই তাঁরা করে চলছেন।
উত্তর আধুনিকতাবাদে গণতন্ত্রের ধারনা অদ্ভুত। নারীবাদী, পরিবেশবাদী, সমকামবাদী, লিভ-টুগেদারবাদী, ইত্যাদি সব ‘বাদী’ দের তাঁরা মনে করেন গণতান্ত্রিক চাহিদা সৃষ্টিকারী ‘ডিমান্ড-গ্রুপ’। উত্তর আধুনিকতাবাদের তাত্ত্বিক সমর্থক রুডলফ দেখিয়েছেন, কিভাবে ডিমান্ড-গ্রুপগুলি এইসব বিষয়গুলি নিয়ে সুবিধা আদায় করতে রাষ্ট্র ও জাতীয় কর্মসূচীর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা এইসব গ্রুপগুলির সাংগঠনিক ভাবে প্রতিবাচন গড়ে তোলাকে সমর্থন করেনÑ যা আসলে মানুষকে স্থানিক (কনটেক্স্টুয়াল) বা খন্ড খন্ড চিন্তায় বিচ্ছিন্ন করে রাখছে। উত্তর আধুনিকতাবাদের ধ্বজাধারীরা পাল্টাবাচনের নামে সমরকম সেচ্ছাচারিতাকে ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে চলেছেন। একেই তাঁরা তথাকথিত আন্দোলন হিসেবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা ওঠে তা হল, স্বেচ্ছাচারিতা কি কোন আন্দোলন হতে পারে? তাঁরা কি সমাজসচেতন, ন্যায়নীতি মূল্যবোধের আধারে প্রতিষ্ঠিত কোন আন্দোলন চান? না কি স্বেচ্ছাচার-ভ্রষ্টাচার ও স্বতঃস্ফূর্র্ততার হাতে ছেড়ে দিয়ে মানুষের আন্দোলনের সংগঠন গড়ে তোলার দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন? মানুষকে অমানুষে পরিণত করে বিচ্ছিন্ন রাখতে চাইছেন? এ সব প্রশ্ন আজ গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
উত্তর আধুনিকতাবাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য মার্কসবাদকে আঘাত করা। মার্কসবাদ চায় সবরকম শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সামন্ততন্ত্র-পুঁজিবাদ-সাভ্রাজ্যবাদের অবসান। চায় রাষ্ট্র বিপ্লব। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা তা চান না। মার্কসবাদীরা প্রচলিত শোষণমূলক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ চান, শেষপর্যন্ত উচ্ছেদ চান। উত্তর আধুুনিকতাবাদীরা চান কর্তৃত্বকারী বাচনের বিরুদ্ধে পাল্টা বাচন গড়ে তুলতে এবং এতে অন্তর্ঘাত ঘটাতে। কিন্তু তাদের এই তথাকথিত লড়াকু অন্তর্ঘাতের অর্থ হল নৈরাজ্যবাদী নিহিলিস্ট জঙ্গিত্বÑযার দ্বারা শোষণমূলক সামাজিক ব্যবস্থা ও তার সিভিল সোসাইটির উপর এতটুকু আঁচড় পড়বে না।
জাক দেরিদার বক্তব্য, মার্কস ছিলেন ডি-কন্সট্রাকটর। মার্কস বহু বিষয়কে কেন্দ্র করে কর্তৃত্বকারী বাচনের বিনির্মাণের কাজ করে গিয়েছেন। এই বিনির্মাণের বহু বিষয়কে কেন্দ্র করে মার্কসের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা তাঁরাও অস্বীকার করতে পারেননি। দেরিদার মতে, মার্কসের ‘ভূত” ( স্পেক্টর) আজও সমাজকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই বিপদের দিক বলে তাঁরা মনে করেন। তাই মার্কসীয় চিন্তা বা মার্কসীয় টেক্সট-এর বিনির্মাণ খুবই জরুরী। অর্থাৎ মার্কসের চিন্তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বাচগুলি তৈরি হয়েছে, সেসবের প্রতিবাচন তথা প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে উত্তর আধুনিকতাবাদীরা মনে করেন। সোভিয়েট সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির পতনের পর এই প্রতিবাচন তৈরির কাজ, বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে মার্কসীয় টেক্সট-এ অন্তর্ঘাত ঘটানোর কাজ, পূর্বের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে বলে এখন তাঁরা মনে করেন। এর দ্বারা মার্কবাদের মাষ্টার ডিসকোর্সের বা চরম বাচনের আধিপত্যকারী ভূমিকা ধ্বংস হয়ে গণতন্ত্রের জমি প্রসারিত হবে। তাহলে মার্কসের ‘ভূত’ আর কোথাও তাঁরা করে বেড়াবে না। মার্কসবাদের বিরোধিতায় উত্তর আধুনিকতাবাদীরা যাই বলুন না কেন, মার্কসবাদের মূল দৃষ্টিভঙ্গিকে তাঁরা ধরতে পারেননি অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছে। মার্কসবাদ শুধুমাত্র একটা মতবাদ নয়, বস্তু-জগৎ-জীবনের সমস্ত দিককে ব্যাপ্ত করে একটা বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিÑফিলিসফি অব লইফ। মার্কসবাদ জীবনকে পরিবর্তন করার, বর্তমান ও অনাগত মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র দিশাÑ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অমোঘ অস্ত্র। তাই মার্কসবাদ জন্মলগ্ন থেকে যেমন শোষিতÑ নিপীড়িত মানুষের একমাত্র অবলম্বন, একই সাথে উত্তর আধুনিকতাবাদ সহ সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও শাসকশ্রেণীর আক্রমণের লক্ষ্যেও। এক শতাব্দীর বেশী সময় ধরে নানা ধরনের আক্রমণ মার্কসবাদের উপর ঘটেছেÑ কেউ তাকে ধ্বংস করতে পারেনি। বরং মার্কসবাদ বিরামহীনভাবে আধুুনিক জ্ঞানতত্ত্বের প্রতিটি শাখাকে গ্রহণ করে বিশ্বজনীন সত্যের ধারণা ও প্রয়োগকে আরও উন্নত ও শানিত করছে।
মার্কসবাদকে হাতিয়ার করে সর্বত্রই তাই পূঁজিবাদÑসাভ্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ও শ্রেণীসংগ্রাম ঘটেছে। খোদ মার্কিন দেশেও সাভ্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ঝড় উঠছে। সোভিয়েত রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে প্রতিবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যে বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে, তা যে মার্কসবাদ পরিত্যাগ করে সংশোধনবাদ চর্চার পরিণতিÑএটা মার্কসবাদই আমাদের দেখিয়েছে। বর্তমানে এই দেশগুলিতেও পূঁজিবাদরে বিরুদ্ধে মার্কসবাদকে হাতিয়ার করেই মানুষ আবার উঠে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে। পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ ক্রমেই আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বগযদ্ধের আগে পুঁজিবাদী-সাভ্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে যতটুকু আপেক্ষিক স্থায়িত্ব ছিল, তাও আজ সঙ্কটে ভেঙে পড়ছে। সর্বত্রই অস্থিরতা বাড়ছেÑপুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের তিব্রতাও বাড়ছে। এককথায়, বর্তমানে পুঁজিবাদ সর্বাত্মক সঙ্কটের মধ্যে দিশাহারা হয়ে পড়ছে, তাই মানুষের আন্দোলনকে নষ্ট ও বিপথগামী করতে মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও যুক্তিবোধকে মেরে দেওয়ার চেষ্ট করছে। এই কারণেই মুমূর্ষু পুঁজিবাদ উত্তর আধূনিকতাবাদ বা পোস্ট-মডার্নিজমের সবচেয়ে বড় প্রচারক হয়ে দাঁড়িয়েছে।