somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

*আর্সেনিকঃ ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ ১ম পর্ব

০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গত ’৯৯ সালে বিবিসি বাংলা বিভাগ বাংলাদেশের ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের উপর একটা প্রতিবেদন প্রচার করেছিল। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করে বাংলাদেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে হেটে চলেছেন। ইতি মধ্যে তিন বছর পার হয়েছে। আর্সেনিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এ এক মাহাদূর্যোগ। শুধু এ জনপদ নয়, মানব ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। কিন্তু ট্রাজেডি হল, বাংলাদেশের শাষকদলগুলো ক্ষমতার ভাগ-ববাটোয়ারা নিয় ঝগড়া ফ্যাসাদে ব্যস্ত। এ দিকে তাদের মনোযোগ দেবার ফুসরত কই! দেশের রেডিও-টিভি বা পত্র পত্রিকার কাছেও যেন এ খুব বড় কোন খবর নয়। ফলে এখনও ভুক্তভোগী ছাড়া শহুরে খুব কম মানুষের কছেই আর্সেনিক একটা উদ্বেগের বিষয়।
উল্লেখ্য আর্সেনিকের কারণে যে ৮ কোটি মানুষের জীবন হুমকিগ্রস্থ তাদের প্রায় সবাই গ্রামীন জনপদের অধিবাসী; আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, অসহায় দরিদ্র মানুষ। তাদের শিক্ষা নেই। প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান কাকে বলে জানে না, কিংবা সে-মত পুষ্টি যোগাড় করার সামর্থও তাদের নাই। অথচ এখনও পর্যন্ত আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর প্রধান চিকিৎসা হল রোগ চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে রোগীকে আর্সেনিক যুক্ত পানি খাওয়া বন্ধ করতে হবে, এবং পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে।
আর্সেনিক কি ও তার বিষক্রিয়াঃ
বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন, আর্সেনিক কোন জীবানু নয়; ধাতু বা অধাতুও নয়, একটি ধাতুকল্প (metalloid)। ধাতু ও অধাতুর উভয় বৈশিষ্ট ধারণ করে ধাতুকল্প।
অন্যান্য খনিজ পদার্থের মত আর্সেনিকও মানবদেহের জন্য কিছু মাত্রায় প্রয়োজনীয়। এ মাত্রার আর্সেনিক আমরা প্রতিদিন শাক-সব্জিসহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ খাবারেরর মাধ্যমে গ্রহন করে থাকি। কিন্তু এর পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলেই বিপত্তি ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, প্রতি লিটার পানিতে .০১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক সহনীয়। অর্থাৎ এর বেশি হলে ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আর আর্সেনিকের মাত্রা যদি প্রতি লিটারে .০৫ মিলিগ্রাম হয় তাহলে তা পান করা সম্পূর্ণরূপে নিসিদ্ধ। প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় আর্সেনিক পাওয়াযায় খুবই অল্প। বেশিরভাগই থাকে যৌগ হিসাবে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের মধ্যে। যেমন, এনার্জাইট (AsS4), আর্সেনোপাইরাইট (FeAsS), স্কোরোডাইট [Fe(AsO4)2.8H2O] ইত্যাদি।
মানবদেহে এ মৌলটি সাধারণত কিডনি, লিভার, প্লীহা ইত্যাদিতে জমা হয় এবং খুব সামান্য পরিমাণে মল, মূত্র ও ঘামের সঙ্গে নির্গত হয়। এছাড়া কিছু আসেনিক হাত-পায়ের নখে ও মাথার চুলে জমা হয়। কিডনি, লিভার প্রভৃতিতে জমা হওয়া আর্সেনিক সেখানকার বিভিন্ন কোষ-কলায় প্রবেশ করে। আর আর্সেনিকের ধর্ম হল, তার নিজের শ্রেণীর (নাইট্রোজেন, ফসফরাস প্রভৃতি) মৌলকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। এদিকে কোষ গুলোতে শক্তি যোগান দানকারী ATP (অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট) নামক যৌগ উৎপাদিত হয়।। ফলে যে-কোষগুলোতে আর্সেনিক থাকে সেগুলোতে ATP -র ফসফরাস মৌলটি ওই আর্সেনিক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। অর্থাৎ অঞচ উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়। যার পরিণাম হল ওই কোষগুলোতে শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, এবং কোষগুলো মারা যায়। এভাবে লিভার, কিডনী, ফুসফুস, ইত্যাদি ক্যান্সারাক্রন্ত হয়। ফলে রোগীর বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। তাছাড়া, অর্সেনিক রক্তসংবহনতন্ত্রেও কাজে ব্যঘাত ঘটায়। ফলে অ্যামিনিয়া, লিউকোপেনিয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়, অস্তিমজ্জায় পচন ধরে যায়।
দীর্ঘদিন ধরে শরীরে আের্সেনিক প্রবেশের ফলে এই যে রোগের সৃষ্টি হয় তার নাম আর্সেনিকোসিস। দেহের ত্বকে সুনির্দিষ্ট লক্ষণ ফুটে ওঠার আগ পর্যন্ত এ রোগকে চিহ্নিত করা অসম্ভব। আর্সেনিকোসিস কয়েক প্রকারের। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য হল মেলানোসিস আর কেরাটোসিস। মেলানোসিসের ফলে চামড়ায় কালো দাগ বা ফুসকুরি পড়ে যায়। কোন কোন অংশ শক্ত হয়ে যায়। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে এবং চিকিৎসকের পরার্মশ মতো চললে এ রোগের আরোগ্য সম্ভব। কিন্তু কেরাটোসিস খুবই মারাত্মক। এর ফলে কোন কোন অঙ্গ পচে যায়।
আর্সেনিকোসিসের বিষক্রিয়ার এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণ জনগনকে এখনও সচেতন করা হয় নাই। ফলে আর্সেনিক ঘটিত রোগের লক্ষণগুলোকে তারা সাধারণ চর্মরোগ, কুষ্ঠ বা শ্বেতীর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। এর ফলে নান ধরনের সামজিক-মানসিক সমস্যার উদ্ভব হয়। এমন বহু উদাহরণ আছে, যেখানে আর্সেনিকোসিসকে সংক্রামক বা বংশানুক্রমিক রোগ মনে করে রোগীকে অস্পৃশ্য বা একঘরে করে রাখা হয়েছে। এ কারণে বহু স্থানে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে এইডস্‌ রোগীর সংখ্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় হলেও সরাকারি প্রচার মাধ্যমে এ ব্যাপারে যতটা মনোযোগ দিয়ে থাকে, এহেন ভয়াবহতা সত্বেও আর্সেনিক সংক্রামণের ক্ষেত্রে তার কণামাত্রও দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কি এই যে, সমস্যাটি সম্পর্কে দেশের মানুষ যত সচেতন হবে, তা উপশমের সরকারে দায়িত্বও তত বেড়ে যাবে?

সারাদেশে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার চিত্রঃ
বাংলাদেশে প্রথম আর্সেনিক রোগী চিহ্নিত হয় ’৮০-ও দশকের মধ্যভাগে। কোলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর চর্মরোগ বিভাগের তৎকালীন প্রধাণ ডা. কে সি সাহা এক্ষেত্রে পথিকৃৎ। কিন্তু তখন বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে কোন গা করা হয়নি। বাংলাদেশ National Institute of Preventive Social and Occupational Medicine (নিপসম)-এর একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, সরকারি মহলে আর্সেনিক নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই উদাসীনতার ফল হয়েছে ভয়াবহ। ’৯০ দশকের প্রথমভাগে নিপসম, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ (SOES) কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৩৪টি জেলার অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন এলাকার খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা হল প্রতি লিটারে .০১-.০৫ মি.গ্রাম। কোন কোন এলাকায় এটা .০৫ মি.গ্রামের অনেক উপরে। এবং ঐসব এলাকায় আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। তবে এর মধ্যে নবাবগঞ্জ, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, বাগেরহাট, খুলনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, পাবনা প্রভৃতি জেলাগুলোর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। এ জেলা গুলোর মধ্যে কিছু কিছু গ্রাম আছে যেখানে প্রত্যেকটা পরিবারের অন্তত: ১ জন বা ২ জন আর্সেনিকোসিসে মারা গেছে। যেমন, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার চরুপুর গ্রামে এক পরিবারে ৮ জনের মধ্যে ৫ জনই মারা গেছে এবং বাকীরাও রোগে ভুগছে। যশোরের শার্সা থানার সামতা গ্রামে ৫ জনের এক পরিবারে একজন মাত্র বেচে আছে।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের জনস্বাস্থ প্রকৌশল বিভাগ (DPHE) এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কয়েকটি জরীপে দেখা গেছে দেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৯ টি-ই উচ্চমাত্রার আর্সেনিক দূষণের শিকার হয়ে পরেছে। যদিও এখনও পর্যন্ত ওই জেলাগুলোর খুব অল্প কয়েকটি টিউবওয়েলই (মাত্র ৫-১০%) টেস্ট করা হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই আর্সেনিক দূষিত বলে প্রমাণীত হয়েছে। যেমন ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে ৫০০ টা গ্রামের টিউবওয়েল টেস্ট করেছে, এর মধ্যে ৬০% এর পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। তবে কোন কোন উপজেলায় (চাঁদপুরের কচুয়া, হাজীগঞ্জ) ৯৫% টিউবওয়েলের পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক ধরা পড়েছে। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেরার সোলদি গ্রামের ৭৩ টির মধ্যে ৭২ টি টিউবওয়েরের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এপর্যন্ত যে ৫৯টা জেলার পানিতে আর্সেনিক পাওয়াগেছে সেগুলোর ৪৭টাতে আর্সেনিক দূষণের মা্রা হল .০৫ মিলিগ্রাম/লিটারের উপরে। এখানে উল্লেখ্য, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে-টিউবওয়েল এক বছর আগে “নিরাপদ” বলে প্রমাণিত হয়েছে, পরবর্তী বছরে তা-ই আর্সেনিক দূষণের কারণে নিসিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ পযর্বেক্ষণের কাজটা বাংলাদেশে এখনও তেমন জোরদার হয়নি।
কিছুদিন আগে একজন মহমারী বিশেষজ্ঞ, লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক টনি ফেচার তার এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “যা দেখেছি তা খুবই মারাত্মক। রোগীর সংখ্যা খুব দ্রুতই বেড়ে যেতে পারে। আর্সেনিক সম্পর্কিত স্বাস্থ বিষয়ক পদক্ষেপ নেয়াটা তাই খুবই জরুরী।” বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চিলি, আর্জেন্টিনা এবং তাইওয়ানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের ফলে দেহাভ্যনত্মরীণ ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও একেবারে কম হবে না। ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে এ ধরনের ৭,৬০০ রোগীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যথাযথ পরীক্ষা করলে আরও বের হবে।
গত ১১ আগস্ট ২০০২, ইংরেজী দৈনিক, ডেইলি স্টার বিশ্বব্যকের গ্রুপভুক্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-আইডিএ বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতি বিষয়ক এক দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, “প্রতিকার না হলে, শেষ পর্যন্ত প্রায ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে এবং আরও অনেকে ডায়াবেটিস, নিউরোজিক্যাল সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগবে।

গত ’৯৯ সালে বিবিসি বাংলা বিভাগ বাংলাদেশের ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের উপর একটা প্রতিবেদন প্রচার করেছিল। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করে বাংলাদেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে হেটে চলেছেন। ইতি মধ্যে তিন বছর পার হয়েছে। আর্সেনিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এ এক মাহাদূর্যোগ। শুধু এ জনপদ নয়, মানব ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। কিন্তু ট্রাজেডি হল, বাংলাদেশের শাষকদলগুলো ক্ষমতার ভাগ-ববাটোয়ারা নিয় ঝগড়া ফ্যাসাদে ব্যস্ত। এ দিকে তাদের মনোযোগ দেবার ফুসরত কই! দেশের রেডিও-টিভি বা পত্র পত্রিকার কাছেও যেন এ খুব বড় কোন খবর নয়। ফলে এখনও ভুক্তভোগী ছাড়া শহুরে খুব কম মানুষের কছেই আর্সেনিক একটা উদ্বেগের বিষয়।
উল্লেখ্য আর্সেনিকের কারণে যে ৮ কোটি মানুষের জীবন হুমকিগ্রস্থ তাদের প্রায় সবাই গ্রামীন জনপদের অধিবাসী; আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, অসহায় দরিদ্র মানুষ। তাদের শিক্ষা নেই। প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান কাকে বলে জানে না, কিংবা সে-মত পুষ্টি যোগাড় করার সামর্থও তাদের নাই। অথচ এখনও পর্যন্ত আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর প্রধান চিকিৎসা হল রোগ চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে রোগীকে আর্সেনিক যুক্ত পানি খাওয়া বন্ধ করতে হবে, এবং পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে।
আর্সেনিক কি ও তার বিষক্রিয়াঃ
বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন, আর্সেনিক কোন জীবানু নয়; ধাতু বা অধাতুও নয়, একটি ধাতুকল্প (metalloid)। ধাতু ও অধাতুর উভয় বৈশিষ্ট ধারণ করে ধাতুকল্প।
অন্যান্য খনিজ পদার্থের মত আর্সেনিকও মানবদেহের জন্য কিছু মাত্রায় প্রয়োজনীয়। এ মাত্রার আর্সেনিক আমরা প্রতিদিন শাক-সব্জিসহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ খাবারেরর মাধ্যমে গ্রহন করে থাকি। কিন্তু এর পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলেই বিপত্তি ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, প্রতি লিটার পানিতে .০১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক সহনীয়। অর্থাৎ এর বেশি হলে ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আর আর্সেনিকের মাত্রা যদি প্রতি লিটারে .০৫ মিলিগ্রাম হয় তাহলে তা পান করা সম্পূর্ণরূপে নিসিদ্ধ। প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় আর্সেনিক পাওয়াযায় খুবই অল্প। বেশিরভাগই থাকে যৌগ হিসাবে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের মধ্যে। যেমন, এনার্জাইট (AsS4), আর্সেনোপাইরাইট (FeAsS), স্কোরোডাইট [Fe(AsO4)2.8H2O] ইত্যাদি।
মানবদেহে এ মৌলটি সাধারণত কিডনি, লিভার, প্লীহা ইত্যাদিতে জমা হয় এবং খুব সামান্য পরিমাণে মল, মূত্র ও ঘামের সঙ্গে নির্গত হয়। এছাড়া কিছু আসেনিক হাত-পায়ের নখে ও মাথার চুলে জমা হয়। কিডনি, লিভার প্রভৃতিতে জমা হওয়া আর্সেনিক সেখানকার বিভিন্ন কোষ-কলায় প্রবেশ করে। আর আর্সেনিকের ধর্ম হল, তার নিজের শ্রেণীর (নাইট্রোজেন, ফসফরাস প্রভৃতি) মৌলকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। এদিকে কোষ গুলোতে শক্তি যোগান দানকারী ATP (অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট) নামক যৌগ উৎপাদিত হয়।। ফলে যে-কোষগুলোতে আর্সেনিক থাকে সেগুলোতে ATP -র ফসফরাস মৌলটি ওই আর্সেনিক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। অর্থাৎ অঞচ উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়। যার পরিণাম হল ওই কোষগুলোতে শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, এবং কোষগুলো মারা যায়। এভাবে লিভার, কিডনী, ফুসফুস, ইত্যাদি ক্যান্সারাক্রন্ত হয়। ফলে রোগীর বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। তাছাড়া, অর্সেনিক রক্তসংবহনতন্ত্রেও কাজে ব্যঘাত ঘটায়। ফলে অ্যামিনিয়া, লিউকোপেনিয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়, অস্তিমজ্জায় পচন ধরে যায়।
দীর্ঘদিন ধরে শরীরে আের্সেনিক প্রবেশের ফলে এই যে রোগের সৃষ্টি হয় তার নাম আর্সেনিকোসিস। দেহের ত্বকে সুনির্দিষ্ট লক্ষণ ফুটে ওঠার আগ পর্যন্ত এ রোগকে চিহ্নিত করা অসম্ভব। আর্সেনিকোসিস কয়েক প্রকারের। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য হল মেলানোসিস আর কেরাটোসিস। মেলানোসিসের ফলে চামড়ায় কালো দাগ বা ফুসকুরি পড়ে যায়। কোন কোন অংশ শক্ত হয়ে যায়। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে এবং চিকিৎসকের পরার্মশ মতো চললে এ রোগের আরোগ্য সম্ভব। কিন্তু কেরাটোসিস খুবই মারাত্মক। এর ফলে কোন কোন অঙ্গ পচে যায়।
আর্সেনিকোসিসের বিষক্রিয়ার এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণ জনগনকে এখনও সচেতন করা হয় নাই। ফলে আর্সেনিক ঘটিত রোগের লক্ষণগুলোকে তারা সাধারণ চর্মরোগ, কুষ্ঠ বা শ্বেতীর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। এর ফলে নান ধরনের সামজিক-মানসিক সমস্যার উদ্ভব হয়। এমন বহু উদাহরণ আছে, যেখানে আর্সেনিকোসিসকে সংক্রামক বা বংশানুক্রমিক রোগ মনে করে রোগীকে অস্পৃশ্য বা একঘরে করে রাখা হয়েছে। এ কারণে বহু স্থানে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে এইডস্‌ রোগীর সংখ্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় হলেও সরাকারি প্রচার মাধ্যমে এ ব্যাপারে যতটা মনোযোগ দিয়ে থাকে, এহেন ভয়াবহতা সত্বেও আর্সেনিক সংক্রামণের ক্ষেত্রে তার কণামাত্রও দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কি এই যে, সমস্যাটি সম্পর্কে দেশের মানুষ যত সচেতন হবে, তা উপশমের সরকারে দায়িত্বও তত বেড়ে যাবে?

সারাদেশে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার চিত্রঃ
বাংলাদেশে প্রথম আর্সেনিক রোগী চিহ্নিত হয় ’৮০-ও দশকের মধ্যভাগে। কোলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর চর্মরোগ বিভাগের তৎকালীন প্রধাণ ডা. কে সি সাহা এক্ষেত্রে পথিকৃৎ। কিন্তু তখন বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে কোন গা করা হয়নি। বাংলাদেশ National Institute of Preventive Social and Occupational Medicine (নিপসম)-এর একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, সরকারি মহলে আর্সেনিক নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই উদাসীনতার ফল হয়েছে ভয়াবহ। ’৯০ দশকের প্রথমভাগে নিপসম, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ (SOES) কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৩৪টি জেলার অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন এলাকার খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা হল প্রতি লিটারে .০১-.০৫ মি.গ্রাম। কোন কোন এলাকায় এটা .০৫ মি.গ্রামের অনেক উপরে। এবং ঐসব এলাকায় আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। তবে এর মধ্যে নবাবগঞ্জ, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, বাগেরহাট, খুলনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, পাবনা প্রভৃতি জেলাগুলোর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। এ জেলা গুলোর মধ্যে কিছু কিছু গ্রাম আছে যেখানে প্রত্যেকটা পরিবারের অন্তত: ১ জন বা ২ জন আর্সেনিকোসিসে মারা গেছে। যেমন, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার চরুপুর গ্রামে এক পরিবারে ৮ জনের মধ্যে ৫ জনই মারা গেছে এবং বাকীরাও রোগে ভুগছে। যশোরের শার্সা থানার সামতা গ্রামে ৫ জনের এক পরিবারে একজন মাত্র বেচে আছে।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের জনস্বাস্থ প্রকৌশল বিভাগ (DPHE) এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কয়েকটি জরীপে দেখা গেছে দেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৯ টি-ই উচ্চমাত্রার আর্সেনিক দূষণের শিকার হয়ে পরেছে। যদিও এখনও পর্যন্ত ওই জেলাগুলোর খুব অল্প কয়েকটি টিউবওয়েলই (মাত্র ৫-১০%) টেস্ট করা হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই আর্সেনিক দূষিত বলে প্রমাণীত হয়েছে। যেমন ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে ৫০০ টা গ্রামের টিউবওয়েল টেস্ট করেছে, এর মধ্যে ৬০% এর পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। তবে কোন কোন উপজেলায় (চাঁদপুরের কচুয়া, হাজীগঞ্জ) ৯৫% টিউবওয়েলের পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক ধরা পড়েছে। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেরার সোলদি গ্রামের ৭৩ টির মধ্যে ৭২ টি টিউবওয়েরের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এপর্যন্ত যে ৫৯টা জেলার পানিতে আর্সেনিক পাওয়াগেছে সেগুলোর ৪৭টাতে আর্সেনিক দূষণের মা্রা হল .০৫ মিলিগ্রাম/লিটারের উপরে। এখানে উল্লেখ্য, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে-টিউবওয়েল এক বছর আগে “নিরাপদ” বলে প্রমাণিত হয়েছে, পরবর্তী বছরে তা-ই আর্সেনিক দূষণের কারণে নিসিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ পযর্বেক্ষণের কাজটা বাংলাদেশে এখনও তেমন জোরদার হয়নি।
কিছুদিন আগে একজন মহমারী বিশেষজ্ঞ, লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক টনি ফেচার তার এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “যা দেখেছি তা খুবই মারাত্মক। রোগীর সংখ্যা খুব দ্রুতই বেড়ে যেতে পারে। আর্সেনিক সম্পর্কিত স্বাস্থ বিষয়ক পদক্ষেপ নেয়াটা তাই খুবই জরুরী।” বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চিলি, আর্জেন্টিনা এবং তাইওয়ানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের ফলে দেহাভ্যনত্মরীণ ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও একেবারে কম হবে না। ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে এ ধরনের ৭,৬০০ রোগীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যথাযথ পরীক্ষা করলে আরও বের হবে।
গত ১১ আগস্ট ২০০২, ইংরেজী দৈনিক, ডেইলি স্টার বিশ্বব্যকের গ্রুপভুক্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-আইডিএ বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতি বিষয়ক এক দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, “প্রতিকার না হলে, শেষ পর্যন্ত প্রায ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে এবং আরও অনেকে ডায়াবেটিস, নিউরোজিক্যাল সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগবে।

(গতকাল প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু ভুলক্রমে রিমুভড হয়ে যাওয়ায় আবার প্রকাশ করলাম)
চলবে............................
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×