হযরত আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“মহাযুদ্ধের সময় মুসলমানদের তাঁবু (ফিল্ড হেডকোয়ার্টার) হবে শামের সর্বোন্নত নগরী দামেস্কের সন্নিকটস্থ আলগুতা নামক স্থানে”।
(সুনানে আবি দাউদ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১১১; মুসতাদরাকে হাকেম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৩২; আল মুগনী, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৬৯)
আলগুতা সিরিয়ায় রাজধানী দামেস্ক থেকে পূর্ব দিকে প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি অঞ্চল। এখানকার মওসুম সাধারণ উষ্ণ থাকে। তাপমাত্রা জুলাইয়ে সর্বনিম্ন ১৬.৫ এবং সর্বোচ্চ ৪০.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকে। জানুয়ারীতে থাকে সর্বনিম্ন ৯.৩ ডিগ্রী আর সর্বোচ্চ ১৬.৫ ডিগ্রী।
মহাযুদ্ধের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দামেস্কের সন্নিকটস্থ আলগুতা নামক স্থানে ইমাম মাহদী (আঃ) এর হাতে থাকবে।
যেহেতু এখানে মহাযুদ্ধের বিশদ আলোচনা এই লিখার উদ্দেশ্য নয়, তাই আমরা সরাসরি মুসলিম শরীফের একটি হাদিসে চলে যাব যেখানে মহাযুদ্ধের ভয়াবহতার কিছুটা দৃশ্যপট বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন,
‘এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব না হওয়া পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যখন উত্তরাধিকারও বন্টিত হবে না, গনিমতের জন্য আনন্দও করা হবে না’। এরপর তিনি সিরিয়ায় দিকে আঙ্গুল তুলে আঙ্গুল তুলে এর ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। বললেন, ‘সিরিয়ার ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিরাট এক বাহিনী প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। ইসলামপন্থীরাও তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুত হয়ে যাবে’।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি রোমানদের (খ্রিস্টানদের) কথা বলতে চাচ্ছেন? আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন,
‘হ্যাঁ, সেই যুদ্ধটি হবে ঘোরতর। মুসলমানরা জীবনের বাজি লাগাবে। তারা প্রত্যয় নিবে, বিজয় অর্জন না করে ফিরব না। উভয়পক্ষ লড়াই করবে। এমনকি যখন রাত উভয়ের মাঝে আড়াল তৈরি করবে, তখন উভয়পক্ষ আপন আপন শিবিরে ফিরে যাবে। কোন পক্ষই জয়ী হবে না। এভাবে একদল আত্মঘাতী জানবাজ শেষ হয়ে যাবে।
তারপর আরেকদল মুসলমান মৃত্যুর শপথ নিবে যে, হয় বিজয় অর্জন করব, নয়ত জীবন দিয়ে দিব। উভয়পক্ষ যুদ্ধ করবে। রাত তাদের মাঝে আড়াল তৈরি করলে চূড়ান্ত কোন ফলাফল ছাড়াই উভয়পক্ষ আপন আপন শিবিরে ফিরে যাবে। এভাবে মুজাহিদদের এই জানবাজ দলটিও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
তারপর আরেকদল মুসলমান শপথ নিবে। হয় জয় ছিনিয়ে আনব, নতুবা জীবন দিয়ে দিব। তারা যুদ্ধ করবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। রাত নেমে এলে উভয়পক্ষই উভয়পক্ষই জয় না নিয়ে শিবিরে ফিরে যাবে। এই জানবাজ দলটিও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
চতুর্থ দিন অবশিষ্ট মুসলমানগণ যুদ্ধের জন্য শত্রুর মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে যাবে। এবার আল্লাহ শত্রুপক্ষের জন্য পরাজয় অবধারিত করবেন। মুসলমানরা ঘোরতর যুদ্ধ করবে – এমন যুদ্ধ, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে যে, মৃতদের পাশ দিয়ে পাখিরা উড়বার চেষ্টা করবে; কিন্তু মরদেহগুলো এত দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকবে কিংবা লাশগুলো এত দুর্গন্ধ হয়ে যাবে যে, পাখিগুলো মরে মরে পড়ে যাবে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের পরিজন তাদের গণনা করবে। কিন্তু শতকরা একজন ব্যতীত কাউকে জীবিত পাবে না। এমতাবস্থায় গনিমত বণ্টনে কোন আনন্দ থাকবে কি? এমতাবস্থায় উত্তরাধিকার বণ্টনের কোন সার্থকতা থাকবে কি?
পরিস্থিতি যখন এই দাঁড়াবে, ঠিক তখন মানুষ আরও একটি যুদ্ধের সংবাদ শুনতে পাবে, যা হবে এটির চেয়েও ভয়াবহ। কে একজন চিৎকার করে করে সংবাদ ছড়িয়ে দেবে যে, দাজ্জাল এসে পড়েছে এবং তোমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে তোমাদের পরিবার পরিজনকে ফেতনায় নিপাতিত করার চেষ্টা করছে। শুনে মুসলমানরা হাতের জিনিসপত্র সব দিয়ে ছুটে যাবে। দাজ্জাল আগমনের সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তারা আগে দশজন অশ্বারোহী প্রেরণ করবে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি এই দশজন ব্যক্তির নাম, তাদের পিতার নাম, তাদের ঘোড়াগুলোর কোনটির কি রং সব জানি। সে যুগে ভূপৃষ্ঠে যত অশ্বারোহী সৈনিক থাকবে, তারা হবে শ্রেষ্ঠ সৈনিক”।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২২৩; মুসতাদরাকে হাকেম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫২৩; মুসনাদে আবী ইয়া’লা, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২৫৯)
এই হাদিসে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুধু দিনে লড়া হবে। রাতে কোন যুদ্ধ হবে না। তার অর্থ কি এই যে, এই সব যুদ্ধ পুরানো রীতিতে শুধু তীর আর তরবারি দ্বারা লড়া হবে? রাতে যুদ্ধ না হওয়ার কারণ এছাড়া আর কি হতে পারে?
মানুষ মনে করে, হযরত মাহদির আমলে আধুনিক প্রযুক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং যুদ্ধ তীর আর তরবারি দ্বারা লড়া হবে। সম্ভবত এই ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, হাদিসে ব্যবহৃত ‘সাইফুন’ শব্দ থেকে। ‘সাইফুন’ শব্দের অর্থ তরবারি। কিন্তু শুধু একে দলিল বানিয়ে নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে, হযরত মাহদির যুগে তরবারি দ্বারা যুদ্ধ হবে। কেননা, ‘সাইফুন’ শব্দটি শুধু ‘অস্ত্র’ অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন, পবিত্র কুরআনে ‘ত্বইরন’ শব্দের অর্থ ‘পাখি’। আবার বর্তমান যুগে আরবিতে ‘ত্বইরন’ শব্দটি ‘উড়োজাহাজ’ এর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া সেই যুগে যুদ্ধ তীর তরবারি দ্বারা সংঘটিত না হয়ে আধুনিক মারনাস্ত্র দ্বারা হওয়ার পক্ষে অনেক আভাস-ইঙ্গিতও হাদিসে রয়েছে। যেমন-
১। কয়েকটি হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত মাহদির যুগের যুদ্ধগুলোতে, যেমন ফোরাতের তীরের যুদ্ধের বর্ণনায় এবং উপরের যুদ্ধের বর্ণনায় বলা হয়েছে, প্রানহানির সংখ্যা এমন হবে যে প্রতি ১০০ জনে ৯৯ জন ব্যক্তি মারা যাবে। যা শুধুমাত্র আধুনিক আনবিক অস্ত্র বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারেই সম্ভব।
২। যে হাদিসে দাজ্জালের বাহনের কথা বলা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, দাজ্জালের গাধা হবে খুব দ্রুতগামী, কান হবে অনেক লম্বা। এই বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায়, হাদিসে গাধা দ্বারা কোন প্রাণীকে বোঝানো হয়নি; বরং এর দ্বারা বাহনকে বোঝানো হয়েছে, যা তীব্র গতিসম্পন্ন এবং বাহনের দুই পাশে উড়োজাহাজের ডানার ন্যায় লম্বা কিছু হতে পারে। এবং আমরা জানি, বাহনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়েছে প্রযুক্তির উপর ভর করেই।
৩। হযরত হুজায়ফা (রাঃ) বর্ণিত বিস্তারিত হাদিসে আছে, আ’মাক যুদ্ধে আল্লাহ কাফেরদের উপর উপর ফোরাতের কূল থেকে খোরাসানি ধনুকের সাহায্যে তীর বর্ষণ করবে। অথচ আ’মাক (সিরিয়ায় আলেপ্পোতে তুরস্কের সীমানার কাছাকাছি গ্রাম) থেকে ফোরাতের নিকটতম তীরের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। সাধারণ কোন তীর ধনুকের দ্বারা ৭৫ কিলোমিটার পার হওয়া সম্ভব নয়। এখানে ধনুকের উদ্দেশ্য তোপ বা ইংরেজিতে “ল্যান্ড টু ল্যান্ড মিজাইল” হতে পারে।
৪। আরেক জায়গায় হাদিসে, যুদ্ধকালীন সময়ে জাজিরাতুল আরবের অন্যতম স্থান ইয়েমেনের ধবংসের কারণ বলেছেন, ফড়িং এর আক্রমণ। আমরা জানি ফড়িং অত্যন্ত দ্রুত উড়তে সক্ষম। হয়তো এর দ্বারা তিনি যুদ্ধবিমানকে বোঝাতে চেয়েছেন।
এছাড়াও আরও অনেক ইঙ্গিত রয়েছে, যেগুলো দ্বারা প্রতিয়মান হচ্ছে, অন্তত দাজ্জালের ধ্বংসযজ্ঞ বিস্তৃত না হওয়া পর্যন্ত আধুনিক যুদ্ধকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা যায় না। বাকি আল্লাহ ভালো জানে।
সার কথা হল, যুদ্ধ তরবারি দ্বারাই হবে এই মর্মে নিজের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থির করা এবং এই মর্মে হাদিস বর্ণনা করা ঠিক নয়। কারণ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে তীর তরবারি দ্বারাই যুদ্ধ হতো। এমতাবস্থায় তিনি যদি এমন কোন সরঞ্জামের কথা উল্লেখ করতেন, যা সে সময় বোঝা সম্ভব ছিল না, তাহলে মানুষের মস্তিস্ক প্রকৃত উদ্দেশ্য হতে সরে যেত এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেটি বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ সেটি যথাযথভাবে বুঝতে ব্যর্থ হতো।
আবার এমনও হতে পারে, মুজাহিদরা একের পর এক আরবের তেলকুপগুলো ধ্বংস করে প্রযুক্তির ব্যবহারকে কঠিন করে তুলবে। যেখানে উভয়পক্ষ বাহন হিসাবে ঘোড়া ব্যবহারে বাধ্য হবে। বর্তমান পশ্চিমা মিডিয়া ইউটিউবের মাধ্যমে মুজাহিদদের ক্যাম্পের ট্রেনিং এর যে সব ভিডিও প্রকাশ করেছে, অনেক জায়গাতে ঘোড়ায় চড়ার ট্রেনিং দিতে দেখা গেছে।
মূল কথা, নিশ্চিতভাবে কিছু বলা ঠিক হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ২:০৫