হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“দাজ্জালের গাধার (বাহনের) মাঝে চল্লিশ গজের দূরত্ব থাকবে এবং এক একটি পদক্ষেপ তিনদিনের ভ্রমণের সমান হবে। সে তার গাধার পিঠে আরোহণ করে সমুদ্রে এমনভাবে ঢুকে যাবে, যেমন তোমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে পানির ছোট নালায় ঢুকে থাক (এবং নালা পার হয়ে থাক)। সে দাবি করবে, আমি বিশ্বজগতের রব এবং সূর্যটা আমার কথা মত চলছে। তোমরা কি চাচ্ছ যে আমি একে থামিয়ে দেই? তার কথায় সূর্য থেমে যাবে। এমনকি একটি দিন মাস ও সপ্তাহের সমান হয়ে যাবে। এবার সে বলবে, তোমরা কি চাচ্ছ, আমি এটিকে আবার চালিয়ে দেই? লোকেরা বলবে, হ্যাঁ দিন। তখন দিন ঘণ্টার সমান হয়ে যাবে।
তার কাছে এক মহিলা আসবে এবং বলবে, হে আমার রব, আপনি আমার পুত্র এবং স্বামীকে জীবিত করে দিন। তখন শয়তানরা মহিলার পুত্র ও স্বামীর আকৃতিতে এসে হাজির হবে। মহিলা শয়তানকে গলায় জড়িয়ে ধরবে এবং তার সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে। মানুষের ঘরগুলো শয়তানদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
এক গ্রাম্যলোক দাজ্জালের নিকট আসবে এবং বলবে, হে আমাদের রব, আপনি আমাদের জন্য আমাদের উট ও বকরিগুলোকে জীবিত করে দিন। দাজ্জাল তাদেরকে উট-বকরির আকৃতিতে কতগুলো শয়তান দিয়ে দেবে। এই পশুগুলো ঠিক সেই বয়স ও সেই শরীর স্বাস্থ্যের হবে, যেমনটি তাদের মৃত উট বকরিগুলো ছিল। এসব দেখে গ্রামের অধিবাসীরা বলবে, ইনি যদি আমাদের রব না হতেন, তাহলে আমাদের মৃত উট বকরিগুলোকে কোনক্রমেই জীবিত করতে পারতেন না।
দাজ্জালের সঙ্গে ঝোল ও গোশতওয়ালা হাড়ের পাহাড় থাকবে, যেগুলো সব সময় গরম থাকবে – কখনও ঠাণ্ডা হবে না। আর প্রবাহমান নহর থাকবে। একটি পাহাড় থাকবে বিভিন্ন ফল ও সবজির বাগানের। একটি পাহাড় থাকবে আগুন ও ধোঁয়ার। সে বলবে, এটি আমার জান্নাত আর এটি আমার জাহান্নাম। এগুলো আমার খাদ্য এবং এগুলো আমার পানীয়। হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর সঙ্গে থাকা লোকদের লোকদেরকে সতর্ক করবেন যে, এই লোকটিই মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। আল্লাহ তাঁর উপর লা’নত বর্ষণ করুন। তোমরা তার কবল থেকে বেঁচে থাকো। আল্লাহ ঈসা (আঃ) কে অনেক তীব্র গতি দান করবেন। ফলে দাজ্জাল তাঁর নাগাল পাবে না।
তো দাজ্জাল যখন বলবে, আমি সমগ্র জগতের রব, তখন মানুষ বলবে তুমি মিথ্যাবাদী। উত্তরে হযরত ঈসা (আঃ) বলবেন, মানুষ সত্য কথা বলেছে। তারপর ঈসা (আঃ) মক্কার দিকে আসবেন। সেখানে তিনি বড় এক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত পাবেন। তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কে? তিনি উত্তর দেবেন, আমি মিকাঈল; দাজ্জালকে হারাম শরীফ থেকে দূরে রাখার জন্য আল্লাহ আমাকে প্রেরন করেছেন। তারপর ঈসা (আঃ) মদিনার দিকে আসবেন। সেখানেও তিনি বড় এক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত পাবেন। তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কে? তিনি উত্তর দেবেন, আমি জিব্রাঈল; দাজ্জালকে রাসুলের হারাম থেকে দূরে রাখার জন্য আল্লাহ আমাকে প্রেরন করেছেন।
এবার দাজ্জাল মক্কার দিকে অগ্রসর হবে। এসে যখন মিকাঈল (আঃ) কে দেখবে, সঙ্গে সঙ্গে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যাবে এবং পবিত্র হারাম শরীফে ঢুকতে ব্যর্থ হবে। তবে সে বিকট সব্দে একটি চিৎকার দেবে, যার ফলে প্রতিজন মুনাফিক নারী ও মুনাফিক পুরুষ মক্কা থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের কাছে চলে যাবে। তারপর দাজ্জাল মদিনার দিকে আসবে। কিন্তু যখন জিব্রাঈলকে দেখবে, সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানেও সে সজোরে একটা চিৎকার দেবে। সেই চিৎকার শুনে প্রতিজন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মদিনা থেকে বের হয়ে তার কাছে চলে যাবে।
এক তথ্যসরবরাহকারী মুসলমান মুসলমানদের এই দলটির কাছে আসবে, যারা কুনুস্তুনিয়া (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করেছে এবং যাদের সঙ্গে সাথে বাইতুল মুকাদ্দাসের মুসলমানদের সম্প্রীতি থাকবে। বলবে, অচিরেই দাজ্জাল তোমাদের কাছে এসে পৌঁছাবে। শুনে তারা বলবে, আসুক, আমরা তার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তুমিও আমাদের সঙ্গে থাকো। দূত বলবে, না, আমাকে অন্যদেরও সংবাদটা পৌঁছুতে হবে। কিন্তু এই লোকটি যখন ফেরত রওনা হবে, তখন দাজ্জাল তাকে ধরে ফেলবে এবং বলবে, এই সেই লোক, যে মনে করে, আমি তাকে কাবু করতে পারবো না। নাও একে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলো। এই মুসলিম দূতকে করাত দ্বারা চিড়ে ফেলা হবে।
তারপর দাজ্জাল (জনতাকে উদ্দেশ্য করে) বলবে, আমি যদি এই লোকটিকে তোমাদের সামনে জীবিত করে দেই, তাহলে কি তোমরা বিশ্বাস করবে, আমি তোমাদের রব? জনতা বলবে, আমরা তো আগে থেকেই জানি, আপনি আমাদের রব। তারপরও এই বিশ্বাসটিকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দাজ্জাল লোকটিকে জীবিত করে তুলবে। লোকটি আল্লাহর ইচ্ছায় দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ এই লোকটি ব্যতীত আর কারও ক্ষেত্রে দাজ্জালকে এই শক্তি দেবেন না যে, কাউকে হত্যা করে সে আবার তাকে জীবিত করবে।
তারপর দাজ্জাল মুসলমান দূতকে বলবে, আমি কি তোমাকে হত্যা করে জীবিত করিনি? কাজেই আমি তোমার রব। উত্তরে দূত বলবে, এখন তো আমি আরও নিশ্চিত হয়েছি যে, আমিই সেই ব্যক্তি, যাকে নবীজি (সাঃ) সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তুমি আমাকে হত্যা করবে এবং পরে আল্লাহর ইচ্ছায় জীবিত করবে। আর আল্লাহ আমাকে ব্যতীত আর কাউকে পুনরায় জীবিত করবেন না। তারপর উক্ত দূতের গাঁয়ে তামার চাদর জড়িয়ে দেওয়া হবে, যার ফলে দাজ্জালের কোন অস্ত্র তার উপর ক্রিয়া করবে না। না তরবারি, না ছুরি, না পাথর, না অন্য কোন অস্ত্র। ফলে দাজ্জাল বলবে, একে আমার জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। আল্লাহ দাজ্জালের আগুনের পর্বতটিকে সবুজ শ্যামল বাগিচায় পরিণত করে দেবেন (কিন্তু দর্শকরা মনে করবে, ওকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে)। মানুষ সংশয়ে নিপাতিত হবে।
তারপর দাজ্জাল দ্রুত বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে এগিয়ে যাবে। যখন সে আফীকের চূড়ায় আরোহণ করবে, তখন তার ছায়া মুসলমানদের উপর পতিত হবে। (ফলে মুসলমানরা তার আগমন টের পেয়ে যাবে) সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে তাদের ধনুকগুলোকে ঠিকঠাক করে নেবে। (সেই দিনটি এত কঠিন হবে যে), সেদিন সেই মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করা হবে, যারা ক্ষুধা ও দুর্বলতার কারণে (বিশ্রামের লক্ষ্যে) সামান্য সময়ের জন্য থেমে যাবে রা বসে পড়বে। (অর্থাৎ যত শক্তিশালী যোদ্ধাই হোক, ঘোরতর যুদ্ধ লড়ার কারণে সামান্য সময়ের জন্য হলেও সে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হবে)। এই অবস্থায় মুসলমানরা ঘোষণা শুনবে – লোকসকল, তোমাদের কাছে সাহায্য (হযরত ঈসা ইবনে মারিয়াম) এসে পড়েছে”।
(আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৪৩)
দাজ্জালের এক একটি পদক্ষেপ তিনদিনের সফরের সমান হবে। হিসাব করে পাওয়া গেছে, এই পরিমাণটা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৮২ কিলোমিটার। ঘণ্টায় ২ লাখ ৬৫ হাজার ২ শত কিলোমিটার। হিসাবটা এভাবে বের করা হয়েছে যে, তিন দিনের শরয়ী সফর হল ৪৮ মাইল। ৪৮ মাইলে ৮২ কিলোমিটার। এই হিসাবের অর্থ দাঁড়ায়, দাজ্জাল সেকেন্ডে ৮২ কিলোমিটার গতিতে ভ্রমণ করবে। মুসলিম শরীফে নাওয়াস ইবনে সাম’আন এর বর্ণনায় দাজ্জালের গতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যেন সেই বৃষ্টি, বায়ু যাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়’।
‘আফীক’ একটি পাহাড়ি সড়কের নাম, যেখানে জর্ডান নদী তারবিয়া উপসাগর থেকে বের হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল এই অঞ্চলটির দখল হাতে নিয়েছিল। ‘আফীক’ এর আরেক নাম আছে ‘এমটি পিটার্স’। বাইবেলের ভাষ্য মোতাবেক ‘আফীক’ সেই জায়গা, যেখানে হযরত ঈসা (আঃ) ব্যাপ্টিজম গ্রহণ করেছিলেন এবং ব্যাপ্টিজমের জন্য বহু মানুষ গিয়ে থাকে’।
(এন্সাইক্লোপেডিয়া অফ ব্রিটেনিকা)
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন,
“দাজ্জালের গাধার কানগুলো এত বড় হবে যে, সত্তর হাজার মানুষ তার তলে ছায়া গ্রহণ করতে পারবে”।
( আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৪৮)
হযরত কা’ব (রাঃ) বর্ণনা করেন,
“দাজ্জাল যখন উর্দুনে (জর্ডানে) আসবে, তখন তূর পাহাড়, ছাওর পাহাড় ও জুদি পাহাড়কে ডাকবে। এমনকি এই তিনটি পাহাড় পরস্পর এমনভাবে সংঘাতে লিপ্ত হবে, যেমন দুটি ষাঁড় কিংবা ছাগল পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়”।
( আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৩৭)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৫ সকাল ১০:৩৭