নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে সায়্যাদ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেননি। সাহাবা কিরামের মতো পরবর্তী আলেমগনেরও মাঝে এ ব্যাপারে মতভেদ চলতে থাকে। যারা ইবনে সায়্যাদের দাজ্জাল হবার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, তাদের দলিল হল দাজ্জাল হবে কাফের। সে মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করবে না এবং তার কোন সন্তান জন্মাবে না। পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস করেন, ইবনে সায়্যাদই দাজ্জাল, তাদের বক্তব্য হল, তার মাঝে সেই সব লক্ষন বিদ্যমান ছিল, যেগুলো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তার পিতামাতাও ঠিক তেমনই ছিল, যেমনটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেছিলেন। তাছাড়া ইবনে সায়্যাদ-এর উক্তি ‘আমি দাজ্জালের জন্মের সময় ও স্থান সম্পর্কে জানি’ এটিও তার নিজের দাজ্জাল হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
এই পক্ষটি ইবনে সায়্যাদের দাজ্জাল না হওয়ার পক্ষের আলেমগনের দলিলের জবাবে বলেছেন, দাজ্জাল কাফের হবে এ কথা ঠিক। ইবনে সায়্যাদও কাফের ছিল। আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) এর সফরসঙ্গীদের একজন যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি এটা পছন্দ করবে যে, তুমি দাজ্জাল? সে উত্তর দিয়েছিল, দাজ্জালকে যেসব বিষয় দেওয়া হয়েছে, যদি আমাকেও সে সব দেওয়া হয়, তাহলে আমি দাজ্জাল হওয়া অপছন্দ করব না। তার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দাজ্জাল তখনই ইসলাম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।
অবশিষ্ট থাকল, অবশিষ্ট থাকল, মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করা-না-করার বিষয়টি।
এপ্রসঙ্গে মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববি বলেছেন,
‘তার ইসলাম প্রকাশ করা, হজ্ব করা, জিহাদ করা ও দুঃসময় অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা এসব ক্ষেত্রে তো একথা স্পষ্ট বলা হয়নি যে, সে দাজ্জাল ব্যতীত অন্য কেউ’।
শীর্ষস্থানীয় সাহাবাগনের মধ্যে হযরত ওমর (রাঃ), হযরত আবুজর গিফারি (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ), হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) ও আরও একাধিক বিশিষ্ট সাহাবা ইবনে সায়্যাদ এর দাজ্জাল হওয়ার প্রবক্তা ছিলেন।
ইমাম বুখারি (রহঃ)ও ইবনে সায়্যাদ এর দাজ্জাল হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। হযরত জাবির (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) থেকে যে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তিনি সেটি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। তামীমদারি সম্পর্কিত হযরত ফাতেমা বিনতে কায়েস (রাঃ) এর হাদিসটি তিনি উল্লেখই করেননি।
(ফাতহুল বারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩২৮)
যে সব আলেম ইবনে সায়্যাদকে দাজ্জাল মানেন না, তাদের দলিল হল হযরত তামীমদারি শীর্ষক হাদিস। হাফিজ ইবনে হাজর ফাতহুল বারীতে এসব আলোচনার পর বলেছেন, তামীমদারি শীর্ষক হাদিস ও ইবনে সায়্যাদ-এর দাজ্জাল হওয়া বিষয়ক হাদিসগুলোর মধ্যে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, তামীমদারি (রাঃ) যাকে বাঁধা অবস্থায় দেখেছিলেন, সে দাজ্জালই ছিল। আর ইবনে সায়্যাদ ছিল শয়তান, যে পুরো সময়টিতে দাজ্জালের রূপ ধারণ করে ইস্ফাহান চলে যাওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ওখানে গিয়ে সে তার বন্ধুদেরসহ সেই সময়ের জন্য গা ঢাকা দিয়েছে, যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে আত্মপ্রকাশের শক্তি দান করবেন।
(ফাতহুল বারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩২৮)
তাছাড়া ইবনে হাজর দলিল হিসাবে সেই বর্ণনাটিও উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেছেন, আমরা যখন ইস্ফাহান জয় করলাম, তখন আমাদের বাহিনী ও ইহুদিয়া নামক পল্লীর মধ্যখানে এক ক্রোশ পথের ব্যবধান ছিল। আমরা ইহুদিয়া যেতাম এবং সেখান থেকে খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি ক্রয় করে আনতাম।
‘একদিন আমি ওখানে গেলাম। দেখলাম, ইহুদীরা নাচছে ও বাজনা বাজাচ্ছে। উক্ত ইহুদীদের মাঝে আমার এক বন্ধু ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা নাচ গান করছে কেন? সে বলল, আমাদের যে সম্রাটের মাধ্যমে আমরা আরব বিশ্বকে জয় করব, তিনি আগমন করছেন।
তার এই উত্তরে আমার মনে কৌতূহল জেগে গেল। রাতটা আমি তারই কাছে একটি উঁচু স্থানে অতিবাহিত করলাম। পরদিন সকালে যখন সূর্য উদিত হল, তখন আমাদের বাহিনীর দিক থেকে ধূলি উত্থিত হল। আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম, যার গাঁয়ে রায়হানের কাবা জড়ানো আর ইহুদীরা নাচগানে লিপ্ত। আমি লোকটিকে ভালোমতো দেখলাম। বুঝে ফেললাম, লোকটি ইবনে সায়্যাদ। পরক্ষনে সে ইহুদিয়া পল্লীতে ঢুকে গেল এবং পরে এ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি’।
(ফাতহুল বারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৩৭)
আলোচনাটি এখানেই শেষ করছি। যেহেতু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেননি, তাই বলতে হচ্ছে, প্রকৃত সত্য আল্লাহই জানেন।
এভাবে রহস্য লুকায়িত রাখার মধ্যে মহান আল্লাহর অনেক তাৎপর্য থাকে, যা সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য কল্যাণের কারণ হয়ে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ সকাল ৮:৪৭