হযরত নাওয়াস ইবনে সামআন (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, একদিন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তখন কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠস্বর কখনও নিচু হয়ে যাচ্ছিল, কখনও উঁচু হয়ে যাচ্ছিল। (তাঁর বক্তব্যের ধারায়) আমাদের মনে ধারনা জন্মাল, দাজ্জাল খেজুর বাগানের মধ্যে আছে। পরে সন্ধ্যায় যখন আমরা তাঁর খেদমতে হাজির হলাম, তখন তিনি আমাদের চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি হয়েছে?
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি দাজ্জালের আলোচনা করলেন। আপনার স্বর কখনও নিচু হচ্ছিল, কখনও উঁচু হচ্ছিল। ফলে আমাদের মনে ধারনা জন্মাল, দাজ্জাল বোধ হয় খেজুর বাগানে আছে।
উত্তরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
‘ও যদি আমার উপস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তোমাদের পক্ষে আমিই যথেষ্ট হব। আর যদি আমার পরে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তোমাদের প্রত্যেককে আপন আপন দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমানের হেফাজতকারী। দাজ্জাল তরতাজা যুবক হবে। তার চোখ বোজা থাকবে। সে আব্দুল ওযযা ইবনে কাতান এর মতো হবে। তোমাদের যেই তাকে পাবে, সেই যেন সূরা কাহফের প্রথম দিককার কটি আয়াত পাঠ করে। ইরাক ও শামের মধ্যখানে যে রাস্তাটি আছে, সে ঐ পথে আত্মপ্রকাশ করবে। সে ডানে বাঁয়ে বিপর্যয় ও অরাজকতা ছড়াবে। হে আল্লাহর বান্দাগন, তোমরা দাজ্জালের মোকাবিলায় দৃঢ়পদ থেকো’।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, দুনিয়াতে সে কতদিন থাকবে?
নবীজি (সাঃ) উত্তর করলেন, ‘চল্লিশ দিন। প্রথম একটি দিন এক বছরের সমান হবে। দ্বিতীয় দিনটি এক মাসের সমান হবে। তৃতীয় দিনটি এক সপ্তাহের সমান হবে। অবশিষ্ট দিনগুলো সাধারণ দিনের মতো হবে’।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, তার ভ্রমনের গতি কেমন হবে?
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সেই বৃষ্টির মতো, বাতাস যাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে একটি সম্প্রদায়ের কাছে আসবে এবং তাদেরকে তাকে রব মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাবে। তারা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং সে যা যা বলবে, সব মেনে নেবে। ফলে দাজ্জাল (তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে) আকাশকে আদেশ করবে, ফলে বৃষ্টি হবে। সে মাটিকে আদেশ করবে, ফলে মাটি ফসল উৎপাদন করে দেবে। সন্ধ্যার সময় যখন তাদের পশুপাল ফিরে আসবে, তখন (পেট ভরে খাওয়ার কারণে) তাদের চুটগুলো উত্থিত থাকবে এবং স্তন দুধে পরিপূর্ণ হবে। তাদের পাগুলো (বেশি খাওয়ার ফলে) ছড়ানো থাকবে। তারপর দাজ্জাল অপর একটি সম্প্রদায়ের কাছে যাবে এবং তাদেরকে তাকে রব মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাবে। কিন্তু তারা তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করবে। দাজ্জাল অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছ থেকে ফিরে যাবে, যার ফলে তারা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে পড়বে এবং ধন সম্পদ সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
দাজ্জাল একটি অনুর্বর জমির পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে এবং তাকে আদেশ করবে, তুমি তোমার ধন ভাণ্ডার বের করে দাও। জমি তার ধনভাণ্ডারকে বের করে দিয়ে তার পেছনে এমনভাবে চলতে শুরু করবে, যেমন মৌমাছিরা তাদের নেতার পিছনে চলে থাকে। তারপর সে তাগড়া এক যুবককে ডেকে আনবে এবং তরবারির এক আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবে। খণ্ড দুটি এত দূরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হবে, লক্ষ্যে-ছোড়া-তীর যত দূরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এবার দাজ্জাল তাকে (দুই টুকরো হয়ে যাওয়া যুবককে) ডাক দিবে। সঙ্গে সঙ্গে যুবক উঠে তার কাছে চলে আসবে। এই ধারা চলতে থাকবে। এরই মধ্যে আল্লাহ ঈসা (আঃ) কে পাঠিয়ে দেবেন’।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৫০)
অপর এক বর্ণনায় আছে,
“দাজ্জাল উক্ত যুবকের উপর অনেক নির্যাতন চালাবে। তার কোমরে ও পিঠে বেদম প্রহার করবে। তারপর জিজ্ঞেস করবে, এবার বল, আমার উপর ঈমান এনেছ কি? যুবক বলবে, তুমি দাজ্জাল। এবার দাজ্জাল তাকে করাত দ্বারা দুই পায়ের মধ্যখান দিয়ে চিড়ে ফেলতে আদেশ দেবে। তার আদেশ পালিত হবে। যুবককে তার পায়ের মধ্যখান দিয়ে চিড়ে ফেলা হবে। তারপর দাজ্জাল তাকে জোড়া লাগিয়ে জিজ্ঞেস করবে, এবার মানছ কি আমাকে? যুবক বলবে, এখন তো আমি আরও নিশ্চিত হয়েছি যে, তুমি দাজ্জাল। তারপর যুবক জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, লোক সকল, আমার পরে এ আর কারও সাথে এরূপ আচরণ করতে পারবে না”।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তারপর দাজ্জাল যুবককে জবাই করার জন্য পাকড়াও করবে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে তার গলাটাকে পুরোপুরি তামায় পরিণত করে দেওয়া হবে। ফলে দাজ্জাল তাকে কাবু করতে পারবে না। এবার দাজ্জাল তার হাত পা ধরে ছুড়ে মারবে। মানুষ মনে করবে, তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অথচ দাজ্জাল তাকে যেখানে নিক্ষেপ করেছে, সেটি হল জান্নাত। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর সমীপে এই যুবকের শাহাদাত শ্রেষ্ঠ শাহাদাত বলে গণ্য হবে”।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৫৬; মুসনাদে আবী ইয়া’লা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৩৪)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বর্ণনা করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করলে ঈমানদার ব্যক্তিদের মধ্যে এক ব্যক্তি তার কাছে যাবে। তার সাথে দাজ্জালের প্রহরীদের দেখা হবে।
তারা তাকে বলবে, 'কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করছ?'
সে বলবে,' আমি এই আবির্ভূত ব্যক্তির কাছে যেতে ইচ্ছা করছি।'
প্রহরীরা বলবে, 'আমাদের রবের প্রতি কি তোমাদের ঈমান নেই?'
সে বলবে, 'আমাদের রবের ব্যাপারে তো কোনরূপ গোপনীয়তা নেই।'
তারা বলবে, 'একে হত্যা কর।'
কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ বলাবলি করবে, 'তোমাদের রব কি তোমাদেরকে তার অগোচরে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে নিষেধ করেননি?'
সুতরাং তারা তাকে দাজ্জালের কাছে নিয়ে যাবে। যখন মু’মিন ব্যক্তি দাজ্জালকে দেখবে তখন বলবে, 'হে লোক সকল! এই তো সেই দাজ্জাল যার প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে গেছেন।'
এরপর দাজ্জালের নির্দেশে তার দেহ হতে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। তার পেট ও পিঠ উন্মুক্ত করে পিটানো হবে আর বলা হবে, 'তুমি কি আমার প্রতি ঈমান স্থাপন কর না?'
উত্তরে মু’মিন ব্যক্তি বলবে, 'তুমিই তো সেই মিথ্যাবাদী মাসীহ দাজ্জাল।'
সুতরাং তার নির্দেশে মু’মিন ব্যক্তির মাথার সিঁথি হতে দু’পায়ের মধ্য পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে দু’টুকরা করা হবে। দাজ্জাল তার দেহের এ দুই অংশের মধ্য দিয়ে এদিক হতে ওদিকে গমন করবে। এরপর সে মু’মিন ব্যক্তির দেহকে সম্বোধন করে বলবে,' পূর্বের মত হয়ে যাও।'
তখন সে আবার পরিপূর্ণ মানব হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। আবার সে বলবে, 'এখন কি তুমি ঈমান পোষণ কর?'
মু’মিন মানবটি বলবে,'তোমার সম্পর্কে এখন আমি আরো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।'
সে মানবদেরকে ডেকে বলবে, 'হে মানবমণ্ডলী! আমার পর এ আর কারো কিছু করতে পারবে না।'
দাজ্জাল পুনরায় তাকে হত্যা করতে চাইবে। কিন্তু আল্লাহ তার ঘাড়কে গলার নিচের হাড় পর্যন্ত পিতলে মুড়িয়ে দেবেন। ফলে সে তাকে হত্যা করার আর কোন উপায় পাবে না। বাধ্য হয়ে সে তার দু’হাত ও দু’পা ধরে ছুঁড়ে ফেলবে। মানুষে ধারণা করবে দাজ্জাল তাকে আগুনে নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে বেহেশতে নিক্ষিপ্ত হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'এই ব্যক্তি বিশ্ব জগতের রব আল্লাহর কাছে মানবের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত স্তরের শহীদের মর্যাদা লাভ করবে।'
( মুসলিম)