বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাগনের মজলিসে যখনই দাজ্জালের আলোচনা করতেন, তখনই তাঁদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হয়ে যেত এবং কান্না শুরু করতেন। কিন্তু এর কারণ কি যে, আজ মুসলমানরা এই ব্যাপারে কোনোই চিন্তা করছে না?
সম্ভবত তার কারণ হল, আজ মানুষ এই ফেতনাটিকে সেই অর্থে বুঝবার চেষ্টা করছে না, যে অর্থে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝিয়েছেন। আজ যদি কোন মুসলমান এই হাদিসটি শোনে, দাজ্জালের কাছে খাদ্যের পাহাড় ও পানির নহর থাকবে, তখন সে হাদিসটি এমন অবস্থায় শোনে যে, তাঁর পেট পরিপূর্ণ থাকে এবং পানির কোন অভাবই থাকে না। ফলে সে দাজ্জালের সময়কার পরিস্থিতিকেও নিজের ভরা পেট ও ভেজা গলার সময়কার অবস্থারই উপর অনুমান করে। এই হাদিসগুলো শোনার সময় তাঁর চোখের সামনে এ দৃশ্যটি মোটেও ভাসে না যে, তখনকার পরিস্থিতি এমন হবে যে, দিনের পর দিন নয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যাবে, রুটির একটুকরোও জুটবে না। অনাহার মানুষকে কাহিল করে তুলবে। পানির অভাবে কণ্ঠনালীতে কাঁটা বিঁধবে।
আপনি বাইরে থেকে ফিরে যখন ঘরে পা রাখবেন, তখন দেখতে পাবেন, আপনার কলিজার টুকরো যে সন্তানটির একটি মাত্র ইশারাতে তাঁর প্রতিটি বাসনা ও দাবি পূরণ হয়ে যেত, আজ তীব্র পিপাসায় তাঁর জীবনটা বের হয়ে গেছে। কয়েক দিনের অনাহার তাঁর গোলাপের মতো সুন্দর মুখ থেকে জীবনের সব সৌন্দর্য-ঔজ্জ্বল্য ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দৃশ্যটি দেখামাত্র আপনার অন্তর খাঁ খাঁ করে উঠল। কিন্তু আপনি অসহায়, অক্ষম। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সন্তানের দিক থেকে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু সেদিকে তাকালেন, অদিকে পড়ে আছে আক্ষেপ আর যন্ত্রণার আরেকখানি প্রতিচ্ছবি – মা – আম্মাজান, হ্যাঁ, আপনার আম্মাজান! সেই মা, যিনি আপনাকে ক্ষুধার্ত পেটে কখনও ঘুমতে দেননি। যিনি আপনার ইঙ্গিতেই আপনার পিপাসার কথা বুঝে ফেলতেন। যিনি নিজের সমস্ত সবাদ-আহ্লাদকে আপনার জন্য কুরবান করে দিয়েছিলেন।
আজ আপনার সেই মা চোখের দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন ভরে নিয়ে যুবক পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন এই আশায় যে, বাছা আমার আজ একটুকরো রুটি আর এক কাতরা পানি কোথাও থেকে সংগ্রহ করে এনেছে। কিন্তু পুত্রের মুখের লেখা পড়তে সক্ষম মা আপনার মুখাবয়বে লেখা জবাবটা পড়ে নিলেন। পুত্রের অসহায়ত্বের ফলে মায়ের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আপনার কলিজাটা মুখে বেরিয়ে আসবার উপক্রম হল। আপনি ভেতরে ভেতরেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে লাগবেন।
কষ্টটা সহ্য করতে না পেরে এবার আপনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এই আশায় যে, সম্ভবত ওদিকে কেউ নাই। কিন্তু না, আছে। ওখানে একজন পড়ে আছে – আপনার জীবন সফরের সঙ্গিনী, পরীক্ষার প্রতিটি মুহূর্তে যে আপনাকে সাহস জুগিয়েছেন। কিন্তু আজ ঠোঁট দুটো তাঁর শুকনো। আর দেখতে না দেখতেই প্রেম আপনার অশ্রুতাপে গলে যেতে শুরু করল। অবশেষে আপনিও তো মানুষ। আপনার বুকেও তো গোশত পিণ্ডই ধুকধুক করে। সন্তানের স্নেহ, মায়ের মমতা ও স্ত্রীর প্রেম সবাই মিলে আপনার হৃদয়টাকে তামার মতো গলিয়ে দিল। কোথাও কোন আশ্রয় নেই, কোথাও কোন সহায় সহযোগিতা নেই। কেউ নেই আপনার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবার। কি ভাবে থাকবে, প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি দরজায় এই একই দৃশ্য।
কেউ নেই সাহায্য করবার – সকলেরই সাহায্য দরকার!
এমন সময় বাইরে থেকে সুস্বাদু খাবারের সুঘ্রাণ আর পানির কলকল শব্দ কানে ভেসে এল। আপনি ও আপনার পরিজন সবাই দৌড়ে বাইরে গেলেন। মনে হল, কষ্টের দিন বুঝি শেষ হয়ে গেছে। মানুষের এই বনে কোন ‘মাসিহা’ এসে পড়েছেন। আগত ‘মাসিহা’ ঘোষণা করছে, ‘ক্ষুধা পিপাসায় কাতর লোকেরা! এই সুঘ্রাণযুক্ত সুস্বাদু খাবার, এই ঠাণ্ডা পানি তোমাদেরই জন্য’।
ঘোষণাটি শোনামাত্র আপনার, আপনার পরিজন ও নগরীর অন্যান্য বাসিন্দাদের আধা জীবন যেন এমনিতেই ফিরে এসেছে। মাসিহা আবার বলতে শুরু করল, এই সবকিছুই তোমাদেরই জন্য। কিন্তু তোমরা কি বিশ্বাস কর যে, এই খাবার পানির মালিক আমি? তোমরা কি এই বাস্তবতাকে স্বীকার করছ যে, এ সব বস্তু সামগ্রী আমার অধীনে?
এই দ্বিতীয় ঘোষণাটি শোনার পর খাবার পানির প্রতি অগ্রসরমান আপনার পা কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেল। আপনি কিছু ভাবতে শুরু করলেন। আপনার স্মৃতি বলল, এই শব্দগুলো তো চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনার মনে পড়ে গেল, এই মাসিহাটা কে? কিন্তু সেই মুহূর্তে পেছন থেকে আপনার সন্তানের কান্না তীব্র হতে লাগল। মায়ের আর্তনাদ কানে এসে বাজল। স্ত্রীর করুণ আহাজারি কানে এসে ঢুকল। আপনি ছুটে গেলেন। আপনার কলিজার টুকরা – আপনার সন্তানটি মৃত্যু ও জীবনের মাঝে ঝুলছে। যদি কয়েক ফোঁটা পানি জুটে যায়, তাহলে শিশুটির জীবন বেঁচে যেতে পারে।
এখন একদিকে আপনার সন্তান, মা ও স্ত্রীর ভালবাসা, অপরদিকে ঈমান বিধ্বংসী একটি প্রশ্নের উত্তর।
একদিকে আনন্দপূর্ণ ঘর, অন্যদিকে বিলাপের আসর।
যেন একদিকে আগুন, অন্যদিকে মন মাতানো ফুল বাগান।
বলুন, বিবেকের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিয়ে ভাবুন, বিষয়টি কি এতই সহজ, যতটা আপনি মনে করছেন? বোধ হয় না। বরং তখনকার পরিস্থিতি হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ফেতনা!
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি,
“আদমের সৃষ্টি থেকে শুরু করে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সময়ে আল্লাহর নিকট দাজ্জাল অপেক্ষা বড় ফেতনা দ্বিতীয়টি নেই’।
(মুসতাদরাকে হাকেম , খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৭৩)
আরেক বর্ণনায় আছে,
“আদম সৃষ্টি থেকে শুরু করে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সময়ে দাজ্জাল অপেক্ষা জঘন্য সৃষ্টি দ্বিতীয়টি আর নেই”।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৬৬)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যখন নামাজে তাশাহহুদ পাঠ করবে, তখন সে যেন চারটি বিষয় থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। বলবে, হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের শাস্তি, কবরের শাস্তি, জীবন ও মৃত্যুর ফেতনা ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১২)
দেখুন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে দাজ্জাল থেকে রক্ষা করার জন্য কত চিন্তা করতেন যে, আমাদেরকে নামাজের মধ্যে দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাওয়ার দু’আ শিখিয়ে দিয়েছেন।
হযরত হুজায়ফা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“দাজ্জাল যখন বের হবে, তখন তার সঙ্গে পানি ও আগুন থাকবে। কিন্তু মানুষ যাকে আগুন বলে দেখবে, সেটিই হবে শীতল পানি। আর যাকে পানি বলে দেখবে, সেটিই হবে শীতল পানি। আর যদি দাজ্জালকে পায়, সে যেন সেই বস্তুটিতে অবতরণ করে, যাকে সে আগুন বলে দেখবে। কেননা, সেটিই হল সুমিষ্ট ঠাণ্ডা পানি”।
(সহিহ বুখারি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১২৭২)
অপর এক হাদিসে দাজ্জালের সঙ্গে গোশত ও রুটির পাহাড় থাকবে বলে উল্লেখ রয়েছে। তার অর্থ হল, যে লোক তার সম্মুখে মাথানত করবে, তার কাছে সম্পদ ও খাদ্যপন্যের সমারোহ থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তাকে অমান্য করবে, তার উপর সব ধরনের অবরোধ আরোপ করে তার জীবনকে কোণঠাসা ও সংকটাপন্ন করে ফেলবে
আমিন বেগ ভাইয়ের ব্লগ থেকে।