এই মূহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরী মনির বাসায় তল্লাশী ও পরবর্তীতে তাকে মাদকসহ গ্রেপ্তার এবং রিমান্ড। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরিমনি ও তথাকথিত দুইজন নারী মডেল এবং একজন চলচ্চিত্র প্রযোজকের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, তারা অভিযুক্তদের বাসস্থান থেকে বিদেশী মদের বোতল এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য, যেমনঃ ইয়াবা, শীশা, আইস সেবনকারী পাইপ, এলএসডি সেবনে ব্যবহৃত ব্লটিং পেপার প্রভৃতি খুঁজে পেয়েছে। আটক দুইজন তথাকথিত মডেল পিয়াসা ও মৌর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা একটি সংঘবদ্ধ ব্ল্যাকমেইল গ্রুপের সদস্য এবং বিত্তবানদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মাদকের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল।
চিত্র নায়িকা পরীমনি তার গ্রেফতারের ঠিক আগে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে একটি লাইভ ভিডিও সম্প্রচারে দাবি করে যে কয়েকজন লোক তার বাড়িতে জোর করে প্রবেশ করতে চাইছে এবং জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও তারা তাদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় দিচ্ছে না। সে ধরে নিয়েছিল পুলিশ পরিচয়দানকারীরা ডাকাত হতে পারে। অভিনেত্রী পরীমনি আরও দাবি করে যে তিনি বনানী থানা ও অন্যান্য সূত্রে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে তারা তার বাড়িতে কোনও অভিযানের বিষয়ে জানে কিনা; তবে তার কোন সূত্রই তাকে এ বিষয়টি তখন নিশ্চিত করতে পারেনি।
গ্রেফতারের পর র্যাব সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং তথ্যের ভিত্তিতেই এই ঢালিউড সুপার স্টারের বাসায় অভিযান চালানো হয়েছিল। র্যাবের মুখপাত্র সাংবাদিকদের আরও নিশ্চিত করেছেন যে, নায়িকা পরীমনি তার বাসায় একটি মিনি বার বসিয়েছিল এবং নিয়মিত সে তার সহযোগীদের সাথে সেখানে অবৈধ পার্টি আয়োজন করতো ও বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল এবং চাঁদাবাজিতে একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিল।
অপর দুইজন তথাকথিত মডেল ও পরীমনির বিরুদ্ধে পুলিশের আনিত অভিযোগগুলি প্রায় একই রকম এবং তিনটি বাড়িতে অভিযানের ঘটনাতেই মাদকদ্রব্য ও মদ উদ্ধারের পর আইনি ব্যবস্থা হিসেবে তাদের সবার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে তাদের নামে এর আগে অন্য কোন মামলার কথা জানা যায়নি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাড়িতে অভিযান চালানোর আগে আদালত থেকে কোন সার্চ ওয়ারেন্টও নেয়নি।
বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি বা কারও গৃহে তল্লাশী চালানোর জন্য কতিপয় আইন রয়েছে। সারাবিশ্বেই ব্যক্তি বা বাড়িতে তল্লাশী চালানো একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ তল্লাশীর সঙ্গে নাগরিকের গোপনীয়তা ও অন্যান্য কয়েকটি মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পর্ক জড়িত। সুতরাং, বর্তমানে তল্লাশী সম্পর্কিত আইন দুনিয়াজুড়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের আইনি সুরক্ষা পাবার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে এবং সে বলে এটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের একটি অবিচ্ছেদ্য আইনি অধিকার এবং আইনি বিধান অনুসরণ ব্যতীত কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, খ্যাতি বা সম্পত্তির জন্য ক্ষতিকর কোন কাজ করা যায় না। তাই ৩১ অনুচ্ছেদানুসারে অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন অভিযুক্তকে মিডিয়ার সামনে এনে কারও সুনাম নষ্ট করতে বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে না।
উপরন্তু, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনের ৩৩ অনুচ্ছেদ কোন আটক ব্যক্তিকে বিলম্ব না করে গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে অবহিত করতে বলেছে এবং ৩৫ অনুচ্ছেদে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে জোর না করার অধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৪৩ অনুচ্ছেদানুসারে কারও বাসগৃহে অবৈধভাবে প্রবেশ, তল্লাশী বা জব্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অতএব, সংবিধানের ভাষ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে আইন নাগরিকদের বেআইনি তল্লাশী থেকে সুরক্ষা প্রদান করেছে।
সুতরাং, কোন অভিযোগের ভিত্তিতে কোথাও তল্লাশী করতে চাইলে পুলিশকে অবশ্যই বিদ্যমান আইন মেনে তল্লাশী করতে হবে এবং কারও বাড়ি বা ঘরে অভিযান চালাতে চাইলে উপযুক্ত আদালতের কাছ থেকে আগেই সার্চ ওয়ারেন্ট নিতে হবে। সার্চ ওয়ারেন্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে আদালতের কাছে অপরাধের পর্যাপ্ত এবং যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ দেখাতে হয়। ওয়ারেন্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে যে ঠিক কোথায় বা কোন গৃহের একটি নির্দিষ্ট স্থান বা তার অংশে নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ে কোন পদ্ধতিতে অভিযান চালানো যাবে।
সার্চ ওয়ারেন্টের সঙ্গে যেহেতু ব্যক্তির অনেকগুলি মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত, তাই সার্চ ওয়ারেন্ট জারির ক্ষমতা আদালতের যথাযথ সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করা উচিত। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৯৬ ধারানুসারে কেবলমাত্র তিনটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আদালত সার্চ ওয়ারেন্ট জারি করতে পারে। যথাঃ
i) যদি কোন আদালতের এরূপ বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ থাকে যে কোন ব্যক্তি সেই আদালতের সমন পাওয়ার পরও কোন প্রয়োজনীয় দলিল বা জিনিস উপস্থাপন করবে না, অথবা
ii) নথিপত্র বা কোন জিনিস কার দখলে আছে আদালতের সে তথ্য জন্য জানা নেই, অথবা
iii) আদালত যদি মনে করে যে করে এই আইনের অধীনে কোন অনুসন্ধান, বিচার বা অন্যান্য বিচারিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য একটি সাধারণ তল্লাশী বা পরিদর্শন পরোয়ানা জারি করা প্রয়োজন।
তাছাড়া এই আইনের ৯৮ ধারানুসারে একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে তথ্যের ভিত্তিতে ও প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান শেষে কারও বসত বাড়ির নির্ধারিত স্থানে ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে তল্লাশী চালানোর জন্য পরোয়ানা জারির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৬৫ ধারা এবং ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারা অনুযায়ী তল্লাশীর সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হিসাবে জরুরি প্রয়োজন ও বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতে আগে থেকে আবেদন না করে তল্লাশী পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ অফিসার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অফিসারকে তল্লাশি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যথায়, উক্ত পরিস্থিতিতে পরোয়ানা পেতে পেতে তল্লাশীর উদ্দেশ্য ব্যহত হতে পারে।
উল্লিখিত বিধানানুসারে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তদন্তকারী কর্মকর্তা বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশী চালাতে পারে, যদিনা উক্ত অফিসার যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্বাস করে যে তাছাড়া তার দ্বারা কোন জিনিস উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। তবে উক্ত অফিসারকে তার বিশ্বাসের ভিত্তি লিখিতভাবে রেকর্ড করতে হবে এবং সে যে বস্তু উদ্ধারের জন্য অভিযান চালাবে তার বিবরণ দিতে হবে।
তথাপি, যেকোন তল্লাশীর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির আইনের বিধানাবলী ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রত্যেক তল্লাশির ক্ষেত্রে পুলিশ স্থানীয় দুই বা ততোধিক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অভিযানের সময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত রাখবে এবং উক্ত তল্লাশী তাদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন করতে হবে। তবে গণ্যমান্য ব্যক্তি শব্দটি আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যার ফলে এটির অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তল্লাশির সময় পুলিশ তাদের সব জায়গায় উপস্থিত থাকতে বাঁধা দিতে পারে বা পুলিশি প্রভাবের কারণে তারা নির্ভয়ে কাজ নাও করতে পারে অথবা পুলিশ এ কাজে নিজেদের সোর্সকেও ব্যবহার করতে পারে।
আইনানুসারে, কোন বাড়িতে অভিযান চালোনাকালে বাড়ির অধিবাসী বা তার পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তিকে তল্লাশীর সময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকার অনুমতি দিতে হবে। ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের ২৮০ প্রবিধানানুসারে অভিযান চালানোর সময় পুলিশের দায়িত্ব বিস্তারিতভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যা অবশ্যই কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। কোন স্থানে নারী বসবাস করলে সেক্ষেত্রে এই আইনে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। একই নিয়ম ডিএমপি বিধি অনুসারে ডিএমপির অধীন এলাকায়ও প্রযোজ্য।
যদিও আইনে কেবলমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশী চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে; তবে পুলিশের এই ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ব্যবহার বা অপব্যবহার করা উচিত নয়। তল্লাশির সময় পুলিশকে সহযোগিতা করা ছাড়াও, একটি বাড়ির অধিবাসীর কিছু অধিকার রয়েছে; যেমনঃ পরিচয় জিজ্ঞাসা করা, তল্লাশীর কারণ জানতে চাওয়া, পরোয়ানা দেখতে চাওয়া ইত্যাদি। অধিকন্তু, পুলিশ যদি ওয়ারেন্টে নির্ধারিত নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে তল্লাশী চালাতে চায়, তাহলে তাকে বাঁধা প্রদান করতে পারে এবং যদি তল্লাশীকালে ওয়ারেন্টে বর্ণিত পদ্ধতি লঙ্ঘন করে তাহলে বসবাসকারী এমনকি পুলিশকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে। এছাড়া নিয়ম রয়েছে যে এসব আইন লঙ্ঘন করে করা কোন তল্লাশীর মাধ্যমে জব্দকৃত বস্তু আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
তারপরও আশংকা থেকে যায় যে কেউ তল্লাশী চলার সময় শত্রুতা বশত কোন অবৈধ জিনিস কারও বাড়িতে রেখে দিতে পারে এবং পুলিশ পরবর্তীতে সে বস্তু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে আদালতে ব্যবহার করতে পারে। এসব এড়ানোর জন্য এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য তল্লাশীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভিডিও রেকর্ড করার ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়াও, তল্লাশীর সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির পছন্দের আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তার উপস্থিতিতে পুরো তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আইনে নতুন বিধান সংযুক্ত করা যেতে পারে। তাতে ভবিষ্যতে তল্লাশী সম্পর্কিত আইনি প্রশ্ন ও পুলিশের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস এড়ানো সম্ভব হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৯:৩৫