শহীদ আসাদ : স্বৈরাচারী আইয়ুব পতনের নক্ষত্র
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের মতো এতবড় ঘটনা ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি। এটা ছিল স্বাধীনতার ড্রেস রিহার্সাল। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনের এক গৌরবময় অর্জন। বাঙালীকে তার ঠিকানা দেখিয়েছিল এই গণঅভ্যুত্থান। আর সেই পথ ধরে এসেছে স্বাধীন ও স্বার্ভৌম বাংলাদেশ। শহীদ আসাদ। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের সড়কে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন অকুতোভয় লড়াকু আসাদ।
৬৬’র ৬ দফার পর পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু করে। ছাত্র সমাজের তীব্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৯ এ এই আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিটিং করে। এ মিটিং থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১১ দফার দাবিতে ২০ জানুয়ারি হরতাল পালনের।
ছাত্র সমাজ পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্কুল, কলেজ বন্ধ ঘোষণা দেয়। গভর্নর মোনায়েম খান ২০ জানুয়ারি ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। পাকিস্তান পুলিশ থেকে বলা হয় শহরের কোথাও চার জনের বেশি লোক একসাথে বের হলে তাদের গ্রেফতার করা হবে। ২০ তারিখ ঢাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন কলেজের প্রায় ১০ হাজার ছাত্র ছাত্রী জড়ো হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১১ দফা দাবিতে শহরে মিছিল বের করে।
ওই মিছিল মেডিকেল কলেজের সামনের সড়কে এসে পোছলে সেখানে পুলিশ বাধা দেয় এবং লাঠিপেটা শুরু করে। এ সময় পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ বাধে। ছাত্ররা বিছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রায় এক ঘণ্টা পর আসাদসহ কিছু ছাত্র সংগঠিত হয়ে আবার মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা হলের পাশে দিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। তখন একজন পুলিশ অফিসার ওই মিছিলের নেতৃত্ব প্রদানকারী আসাদকে বনেট দিয়ে আহত করে রাস্তায় ফেলে দেন। কিছুক্ষণ পর আহত আসাদকে খুব কাছে থেকে পুলিশ গুলি করে। পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিকেলের বর্তমান জরুরী বিভাগের সামনে আসাদ শহীদ হন।
আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন। নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধনুয়া গ্রামের হাতিরাদিয়ায়। শহীদ আসাদ এর পুরো নাম আমানউল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। বাবা আলহাজ মাঃ মোহাম্মদ আবু তাহের বি এ বি টি।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী। প্রাইমারী পড়াশুনা শেষে ১৯৫৪ সালে তাঁর বাবা মাঃ মোহাম্মদ আবু তাহের তাঁকে শিবপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। শৈশবকাল থেকে আসাদ পড়াশুনায় মনোযোগী ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলা, কবিতা আবৃতি, মাছধরা ও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়া বেশ পছন্দ করতেন। শিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৬১ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন।
মেট্রিক পাশের স্বীকৃতি অর্জন করার পর ওই বছর তিনি সিলেটের এম সি কলেজে আই এ ভর্তি হন। কলেজ জীবনে তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি কলেজের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হতে থাকেন। এ সময় তিনি তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। এই কলেজে পড়াশুনাকালীন সময়ে তিনি ১৯৬২ সালের মহান শিক্ষা আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে তিনি ওই কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন।
আই এ পাশ ওই বছর আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতি শুরু করেন। তূখোড় মেধাবী এই তরুণ সমাজ বদলের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ন্যাপে কাজ শুরু করেন। এ সময় পড়াশুনা, ছাত্র আন্দোলন আর মেহনতি মানুষের মুক্তির রাজনীতি ছাড়া তাঁর কাছে অন্য কোনো কিছুর মূল্য ছিলো না। অল্পদিনের মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতা ও কাজের আন্তরিকতার কারণে তিনি রাজনৈতিক মহলে বেশ পরিচিতি অর্জন করেন। যার ফলে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন ঢাকা হল শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিভাগে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে এম এ ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি ওই বছর সিটি ল’কলেজে আইনে ভর্তি হন।
এম এ পাশ করার কিছু দিন পর তিনি মাওলানা ভাসানীর নির্দেশে মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য নিজ গ্রামে চলে যান। নিজের ভবষ্যতের কথা, পরিবারে কথা না ভেবে কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-শ্রমজীবী-পেশাজীবীর শোষণমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক বছরের মধ্যে শিবপুর, মনহরদী, রায়পুরা, নরসিংদীতে শক্তিশালী কৃষক সমতি গড়ে তোলেন।
১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি ন্যাপের নির্দেশে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে এসে তিনি স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে ছাত্র-যুব-শ্রমজীবীকে সংগঠিত করেন। স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সচেতন করে তুলতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী পূর্ববাংলায় হরতাল ঘোষণা করেন। এই হরতাল সফল করার জন্য আসাদ শিবপুর, মনহরদী, রায়পুরা, নরসিংদীতে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-শ্রমজীবীকে নিয়ে সফলভাবে হরতাল পালন করেন। ওই এলাকায় হরতাল পালনের সময় কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এতে ওই এলাকার ৩ জন কৃষক নিহত হয়। আহত হন আসাদ। আহত আবস্থায় আসাদ ঢাকা এসে পত্রিকা অফিসে উক্ত ঘটনার বিবরণ দেন, যা পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হয়।
এরপর তিনি ১৯৬৯ সালের সেই সংগ্রামময় উত্তাল দিনগুলিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। জানুয়ারী মাসের প্রতিটি দিনই কেটেছে তাঁর লড়াই-সংগ্রাম আর আন্দোলনে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে আসাদ শহীদ হন।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন
মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন
তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।