কবি হেলাল হাফিজ মূলত প্রেমের কবি।
স্কুল লাইফে আমরা যখন প্রেম করতাম, তখন হেলাল হাফিজের কবিতা ছাড়া -মেয়ে পটানোর মতো অন্য কোনো মারণাস্ত্র আমাদের হাতে ছিল না।
কত দুর্দান্ত প্রেমের কবিতা তিনি লিখেছেন :
:: স্যাম্পল নং ১ ::
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷
:: স্যাম্পল নং ২ ::
তুমি কি জুলেখা, শিরী, সাবিত্রী, নাকি রজকিনী?
চিনি, খুব জানি
তুমি যার তার, যে কেউ তোমার,
তোমাকে দিলাম না - ভালোবাসার অপূর্ব অধিকার।
:: স্যাম্পল নং ৩ ::
আমাকে উস্টা মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে,
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারু নখে চোট লাগেনি তো;
ইস্! করছো কি? বসো না লক্ষ্মীটি,
ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপটিক দুটো চুমু দিয়ে দেই।
তবে হেলাল ভাইয়ের সবচেয়ে দুধর্ষ প্রেমের কবিতার নাম ছিল : 'ভূমিহীন কৃষকের গান'।
তার প্রথম দুই চরণ এই রকম :
'' দুই ইঞ্চি জায়গা হবে?
বহুদিন চাষাবাদ করিনা সুখের।''
তবে কীভাবে কীভাবে যেন হেলাল ভাইয়ের একটি রাজনৈতিক কবিতা দারুন জনপ্রিয়তা পায়। বলা যায়, কবিতাখানি স্লোগানে পরিণত হয়ে গেছে। কবিতার শিরোনাম : নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
'' এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়''
তবে হেলাল হাফিজের এই রাজনৈতিক কবিতার চেয়ে আমার ভালো তার অন্য একটি রাজনৈতিক কবিতা। যে কবিতা চিরকালীন, বিশ্বজনীন এবং সব প্রেক্ষাপটেই সত্য। কবিতাটিখানি পুরোপুরি তুলে ধরছি :
'' ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠাগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনো তাদের অয় নাই হুঁশ।
গোছায়া গাছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি মানুষের অইবোই জয়।
কলিমুদ্দিনের পোলা চিডি দিয়া জানাইছে,–’ভাই
আইতাছি টাউন দেখতে একসাথে আমরা সবাই,
নগরের ধাপ্পাবাজ মানুষেরে কইও রেডি অইতে
বেদম মাইরের মুখে কতোক্ষণ পারবো দাঁড়াইতে।’
টিকেট ঘরের ছাদে বিকালে দাঁড়ায়ে যখন যা খুশি যারা কন
কোনো দিন খোঁজ লইছেন গ্রামের লোকের সোজা মন
কী কী চায়, কতোখানি চায়
কয়দিন খায় আর কয়বেলা না খায়া কাটায়।
রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি,
আমিও গ্রামের পোলা চুত্মারানি গাইল দিতে জানি।''
আমি কবিতা তেমন বুঝি না, রাজনীতি তো একদমই বুঝি না।
কিন্তু আমার বিচারে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতা এটি।
ক্ষমতায় থাকে মাত্র ১% মানুষ, বাকি ৯৯% মানুষ শোষিত, নির্যাতিত এবং নিপীড়িত। এই ৯৯% মানুষের কন্ঠে এতো সোচ্চার করে, এতোগুলো সত্য কথা এর আগে কোন কবি বলতে পেরেছেন কিনা জানি না।
আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি খোদ পশ্চিমা দেশেও '' উই আর নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট '' স্লোগানে অকুপাই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে।
তখন আমার কানে কেবলই এই কবিতার কথাই ভাসে। ডান নয়, বাম নয়, কোনো রেডবুক কিংবা ইয়োলো পেইজ নয়, এই কবিতাই ফিরে ফিরে আসে :
'' ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠাগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনো তাদের অয় নাই হুঁশ।
গোছায়া গাছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি মানুষের অইবোই জয়।'''
বিএনপি'র এক নারী সাংসদ এই কবিতা সংসদে পাঠ করেছেন। সারাদেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। তাদের কানে বাজছে ''চুতমারানি' শব্দটি। কবিতার অন্য লাইনগুলো, যেগুলো ধ্রুবতারার মতো সত্য, সেই শব্দগুলো জাতির মধ্যে কোনোই আলোড়ন ফেললো না।
আমি বিএনপিকে পছন্দ করি না।
তবু আমি মহান সংসদে বিএনপি'র একজন নেত্রী , এতো পবিত্র এবং ভয়ংকর সত্যভাষণমূলক একটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন বলে, তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
আমাদের সংসদে বোধহয় সাধারণ মানুষের কথা এইভাবে উঠে আসার সময় এসেছে।