এই শব্দগুলো একই, কিন্তু অক্ষরের প্রকৃত উচ্চারণভেদে কেমন হয়ে যাচ্ছে?
সালাম- ছালাম
সালাত- ছালাত/ ছলাত
সওয়াব- ছোয়াব
গাউসুল আজম- গাউছুল আজম/ গাউচুল আজম
সুন্নি/সুন্নী- ছুন্নী
শিয়া/শীয়া-সিয়া/ছিয়া
রাজিআল্লাহু আনহু- রাদ্বিআল্লাহু আনহু
জোয়াল্লিন-দোয়াল্লিন
সফর-ছফর/ছপর
সিন, শীন, স্বদ- এই তিনটারই উচ্চারণ স, শ, স হবে।
বাংলা ভাষার বানানরীতি আরবি ভাষার নিয়মকানুন দিয়ে পরিচালিত হবেনা, বাংলা বানানের একটা সর্বজনগ্রাহ্য রীতি, যেটাকে 'প্রমিত রীতি' বলা হয়, আছে। একই কথা আরবির ক্ষেত্রেও খুবই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত বানানরীতি খুবই আধুনিক এবং ফোনেটিক্স তথা ধ্বনিতত্ত্বের বিচারে মোটামুটি বিশ্বজনীন।
বাংলায় 'স' এর উচ্চারণ মূলত 'শ'। যাবতীয় তৎসম কিংবা বাংলা শব্দের ক্ষেত্রে 'স' এর উচ্চারণ 'শ' হয়। যেমন 'সৈনিক', 'সেনা' 'সাফল্য' ইত্যাদি।
মজার ব্যপার হল, ইংরেজি S, আরবি 'সিন', 'সোয়াদ' এবং 'সা' এই বর্ণগুলোর সমোচ্চরানের প্রতিবর্ণ আমাদের বর্ণমালায় নেই।
অনারবদের আরবি উচ্চারণে সবচে বড় বিপদ হয় স্বদ আর দ্বঁ-দ এ। আরবিকে তো আল লুগাতুদ্ দ্বঁ-দ বলে। দ্বঁ-দ হল একমাত্র আরবিতে প্রাপ্য ইউনিক উচ্চারণ। পৃথিবীর আর কোন ভাষায় এমন উচ্চারণ নেই এটা ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রচলিত। আর দ্বঁ-দ এর কাছাকাছি অক্ষরটা হল স্ব-দ। তাই সবখানেই আরবিটা স্ব-দ আর দ্ব-দ কে কাছাকাছি কোন লোকাল অক্ষরে আনতে গিয়ে কোন অক্ষরেই আনা যায় না। তাও মন্দ না। মানুষ করে কী, এই দুটা অক্ষরের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে গিয়ে অত্যন্ত দূরের ভিন্ন উচ্চারণ নিয়ে আসে।
প্রিয় ফেবুফ্রেন্ড অভিরূপ গাঙ্গুলী বললেন, পশ্চিমবঙ্গে চলছে দেয়াল্লিন ও যোয়াল্লিন।
যেমন, দ্বঁ-দ নিয়ে তো এক সময় মারামারি হতো। দুই ফির্কা। দোয়াল্লিন আর যোয়াল্লিন। প্রতিদিন তিনবার জোরে জোরে নামাজে আসে। প্রতিদিন মহা গ্যাঞ্জাম। আমার নানা ছোটবেলায় বলতেন আমাদের, মানুষ তো অন্ধকারে একজন আরেকজনের গলা টিপেও বলতো, বল্, দোয়াল্লিন না যোয়াল্লিন। বলে হাসতেন। হয়তো তিনি গল্প করছিলেন। রমজান নাকি রমদ্বান। রাদ্বিআল্লাহু আনহু নাকি রাজিআল্লাহু আনহু। আসলে দ বা জ কোনটা দিয়েই কশ্মিনকালেও দ্বঁ-দ কে প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি এইযে দ্বঁ-দ লিখছি এটা দিয়েও প্রকাশ করা যাবে না। স্ব-দ ও দ্বঁ-দ কে এক অক্ষরে প্রকাশ করার একমাত্র উপায় নতুন অক্ষর প্রচলন করা। কিন্তু যে পর্যন্ত আমরা নতুন অক্ষর প্রচলন না করছি, অথবা আমরা সরাসরি আরবি অক্ষর দিয়ে সেটা না লিখছি, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বিকল্প এক-অক্ষর উপায় হচ্ছে স্ব-দ এর জন্য স ও দ্বঁ-দ এর জন্য দ।
যেমন আরবিতে প বা পি নেই। একে বা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এখন আরবি ভাষায় দাবি উঠেছে বেলাস্তিক, ব্যারিস ও কুমবিউতার না বলে বায়ের একটা নুক্তা বাড়িয়ে দিয়ে বরং সেটাকে পা করা হোক। এ নিয়ে প্রায়ই আরব দেশগুলোতে জ্ঞানী গুণীরা পত্র পত্রিকায়ও লেখেন। কারণ স্পষ্ট। আগের দিনের আরবরা প্লাস্টিক কে ব্লাস্তিক বলতেন, এখন কিন্তু তাঁরা প্লাস্তিক বলেন। হয়ত প পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বা ও নয়। বরং প ই উচ্চারণ করেন, বা এর দিকে একটু ভার থাকে। এটা শ্বাসনালী ও জিহ্বার ফোনেটিক্সের কারণে বদলে যাওয়া ব্যবহারের ফল। পারিবারিক উচ্চারণরীতি বা দেশনির্ভর ভাষানির্ভর উচ্চারণরীতির জন্য মানুষের শারীরিক পরিবর্তন পর্যন্ত আসে। সেটা শরীরে এবং ব্রেনের ইন্টারপ্রিটেশনের অঞ্চলগুলোতে। আজকাল আরবরা ব্যারিস না বলে প্যারিসও বলেন। তো, পি বা প যেহেতু আরবি ভাষায় চলে এসেছে, পি বা প কেন আরবিতে আলাদাভাবে উচ্চারণসহায়ক বর্ণে আসবে না? বর্ণ তো মূলত উচ্চারণ সহায়তার জন্য। এর বাইরে কিছু নয়।
বেশ কিছু সহায়তা পেলাম নাঈম রিজভী ভাইর কাছ থেকে। তিনি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় খুবই সচেতন। 'ছ' বর্ণটির উচ্চারণ উপরের বর্ণগুলির উচ্চারণের সঙ্গে মোটেই তুলনীয় নয় কেননা 'ছ' একটা তালব্য (চ-বর্গীয়) বর্ণ, যার উচ্চারণের স্থান (প্রধানত জিভের মধ্যভাগ এবং তালু ) S, সিন, সোয়াদ বা সা এর উচ্চারণস্থান ( মুলত জিভের অগ্রভাগ এবং সম্মুখ দন্তমূল) থেকে আলাদা।
ফলে, ফোনেটিক্স এর আন্তর্জাতিক তদারকি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে উপরোক্ত বিদেশী বর্ণগুলোর প্রতিবর্ণ হিসেবে 'স' কে নির্ধারিত করা হয়। অন্যদিকে ইংরেজি Sh, আরবি শিন এর প্রতিবর্ণ হিসেবে 'শ'কে নির্ধারণ করা হয়।
এটাতো নিশ্চিত, যে, স্ব-দ আর দ্ব-দ কে বাংলায় কোন অক্ষর দিয়ে পরিপূর্ণ প্রকাশ করা যায় না। তাই সবচে কাছাকাছি উচ্চারণ স ও দ। এখন যদি কেউ ছ/চ ও ধ/ঠ উচ্চারণ লেখে, সেটা পড়ার সময় মানুষের কী অবস্থা হবে?
এই আলাপের সময় শেখ মোহিব্বুল্লাহ্ ভাই আলিম মানুষ এভাবে সহায়তা করলেন- মাখরাজ আর ব্যাকরণ থেকে হরফ ও অক্ষর সমূহের উচ্চারণের স্থানগুলি জানলে ভূতে পারে না। 'স' 'সিন' 'সোয়াদ' একই স্থান হতে উচ্চারিত হয় বিধায় সিন ও সোয়াদ হরফ বাংলায় চ/ছ দিয়ে লিখলে শুদ্ধ হবে না, বরং স দিয়েই লিখতে হব।
বাংলা একাডেমির বানানরীতি অনুযায়ী 'সুন্নি'(ছুন্নী বা সুন্নী নয়) , 'শিয়া', গাউসুল আজম, গাউসিয়া শরিফ(বিদেশি শব্দে ী বর্জন করার নিয়মে) -এগুলো শুদ্ধ বানান।
তবে আমরা চাইলে দীর্ঘ ঈ কার দিয়ে লিখতে পারি। এজন্য লিখতে পারি যে, এক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ কার ও হ্রস্ব ই কারের পার্থক্যটা আরবি ও বাংলায় বাহিত হচ্ছে। আমার এখনো 'নবি' লিখতে ভাল লাগে না, যেহেতু 'নবী'র একটা সহজ অপশন বাংলায় আছে যদিও আরো শুদ্ধ উচ্চারণ হবে নাবী'/নাবী'ই ।
বাংলাদেশের খ্রীষ্টান সম্প্রদায় সরাসরি এ বিষয়টা নিয়ে বাংলা কর্তৃপক্ষের সাথে দফা করে নিয়েছেন। তাঁদের ধর্ম সম্পর্কিত শব্দগুলোকে অধূনা বাংলা রীতিতে খ্রিস্টান লেখা যাবে না, বরং তাঁরা যা লিখে এসেছেন, সেই খ্রীষ্টান লিখতে পারতে হবে। এক্ষেত্রে তাঁদের অনুভূতি শ্রদ্ধেয়। আমিও সেই অনুভূতিতে আরবি শব্দে দুই আলিফ ও তিন আলিফ টানের জায়গায় দীর্ঘ ঈ কার দিই।
মোট কথা আমরা চাইলে এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির বিদেশি বানানের দীর্ঘ ঈ ও হ্রস্ব ই রীতি উপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু স্বদ সিন, শিনকে কিছুতেই ছ বলতে পারি না। দীর্ঘ ঈ দিলে বিকৃতি হয় না, কিন্তু চ বা ছ দিলে সরাসরি খুবই বাজে বিকৃতি হয়। তেমনি জ দিয়ে কখনো দ্বঁ-দ প্রকাশ পায় না সেটা প্রকাশ করতে হলে দ বা দ্ব আনতে হয়। কোন উপায়ই নেই অন্য।