৪.২৫ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের মুদ্রা বা দিনার এবং ২.৯৭৫ গ্রামের রূপার মুদ্রা বা দিরহাম হবে প্রস্তাবিত মুসলিম খিলাফাতের মুদ্রা। আদি ইসলামিক খিলাফতের অনুসারে।
-স্বর্ণ ও রৌপ্যের টাকা হওয়ার অপরিহার্যতা এই একটা লাইনেই বোঝা যায়, বাস্তবতা ও কমন সেন্স থেকে কত দূরে রয়েছে তথাকথিত আধুনিক ইসলামি সঙ্গঠন, হিজবুত তাহরির।
যারা নিজেদের সাথে ইসলামকে যুক্ত করে, কিন্তু ইসলাম থেকে বিচু্তির দোষে দুষ্ট, তাদের মৃততুদন্ড প্রদান করা হবে।
-হিজবুত খিলাফাতের খসড়া সংবিধানের আর্টিকেল সেভেন ।
প্রত্যেক পুরুষ মুসলিম, পনের বছর বা তারচে বেশি বয়সি, বাধ্য থাকবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে জিহাদের জন্য প্রস্তুত থাকতে।
-আর্টিকেল ফিফটি সিক্স, হিজবুত তাহরীর প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধান।
রোজার মাসে জুমার নামাজ পড়তে গেলাম। আসার সময় দেখি নানাজনের হাতে হিজবুত তাহরীর উলাইয়া বাংলাদেশের লিফলেট। চেয়ে তো আর নেয়া যায় না, রাস্তায় তাকাতেই দেখি একটা পড়ে আছে। তুলে পড়তে পড়তে এলাম।
খুব সাধারণ একজন মানুষের কথা কল্পনা করা যায়। যিনি আটপৌরে জীবনযাপন করেন। সরল, আর দশজনের একজন। ধর্মসচেতন থাকার চেষ্টা করেন। এই তাহরীরী লিফলেটটা তার হাতে পড়ল। পরে?
পরে যা হবে, তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়-
ঢাকাতেই, এক বাসে বই বিক্রি হচ্ছে। যাত্রি খপ করে ধরে ফেললেন ক্যানভাসারের হাত। আপনি জানেন, কী বিক্রি করছেন?
-জানি, জিহাদি বই।
-এগুলা যে বাংলাদেশে আইন করে নিষেধ করা আছে তা জানেন?
-(ভাবলেশহীন) জানি।
-এখন যদি আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেই?
-দিতে পারেন।
-যদি মানুষজন পিটানো শুরু করে?
-মারতে পারেন। অনেক মানুষই মারে। আপনিও মেরে দেখতে পারেন।
প্রিয়,
গা শিউরে ওঠে না? একবার কল্পনা করুন, এই মানুষগুলো অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে, মোড়ে মোড়ে, হানা দিচ্ছে বাসায়। এবং তারা সবাই এমন ভাবলেশহীন।
কেন ভাবলেশহীন?
কারণ তাদের হিসাব অনুযায়ী তারা বিশ্বাস করতে পেরেছে,
জালিম শাসকের সামনে হক কথা বলতে পারলে এটাই হল সবচে সেরা জিহাদ। এই কাজ করলে শহীদের সর্দার হওয়া যায়। এই কাজ না করলে ঈমান পূর্ণ হয় না। হত্যা করতে পারলে গাজী হওয়া যায়, নিহত হলে শহীদ হওয়া যায়। এবং নিহত হলেও তারা মরে না, জীবিত থাকে ও রিযিক প্রাপ্ত হয়, পরকালে সবচে সেরা জান্নাতে সবচে ভাল পুরস্কারগুলো পায়। যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করে না, তারাই জালিম। তারা বিশ্বাস করে, যদি জনগণ এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, হাসিনা-খালেদাতন্ত্রকে হাত দিয়ে (সশস্ত্রভাবে) প্রতিহত না করে, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে আজাব দিবেন। তা ভূমিকম্প হতে পারে, জাতীয় বিপর্যয় হতে পারে। তারা বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে, এই সমাজ ব্যবস্থায় কোন মুমিনের দোয়া কবুল হবে না! এই বাংলাদেশ এখন ফিরআউনের মত অবস্থায় আছে। আর ফিরআউনের তুলনায় বর্তমান শাসিকা একজন বালিকা, তার টুটি চেপে ধরতে হবে। যারা টুটি চেপে ধরার কাজ করবে, তারা নবী দ.'র চাচার মত সম্মানিত হবে!!!
সাধারণ মুসলমান বা অসাধারণ মুসলমান, সাধারণ অমুসলিম বা অসাধারণ অমুসলিম- এরা সবাই কিন্তু এই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার ভিতরেই পড়ছেন।
মুসলমানদের মনের ভিতরে একটু হলেও খুতখুতে ভাব তৈরি করার মত প্রচারণা তারা করতে পারে। একটু দোলচাল, একটু নৈতিক সমর্থন। এটা তাদের যোগ্যতা।
আর অমুসলিমের কাছে তো সোজাসাপ্টা জবাব আছেই, মুসলমানের জাতই এমন। এদের কাজই এমন। কী আর হবে, যা হবে তা সহ্য করতে হবে।
হিজবুত তাহরীর, তাদের ইতিহাস, উৎস, ধর্মবিশ্বাস ও কাজের ধারার সাথে বাংলাদেশে বাস্তবতার একটা পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব আমরা এখানে, সব সহব্লগারের তথ্যে তা হবে আরো ঋদ্ধ ও পূর্ণ। আসুন, শুরু করা যাক।
তাহরিরের শুরু: এক কষ্টগাঁথা ও ফলাফল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হল মিত্রবাহিনী - অক্ষশক্তির সাথে। মাঝখানে ফেঁসে গেল বেচারা ফিলিস্তিনিরা। তারা অবাক হয়ে দেখল, তাদের ভূমিতে প্রথম অতিথি হয়ে এল ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা। পরে খুব দ্রুত তা পরিণত হল একটা রাষ্ট্রে। অবাক হয়ে তারা দেখে, তাদের দেশ, কিছু দেশের সহায়তায় পরিণত হয়েছে ইজরায়েলে।
তারপর অত্যাচারের অকল্পমাত্রা।
তারা আরো অবাক হয়ে দেখে, এই অকল্পনীয় অত্যাচারে সারা পৃথিবীর প্রায় শতকোটি মুসলিম নিশ্চুপ।
হিজবুত তাহরিরের ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠাতা, একজন বিচারপতি তক্বিউদ্দিন আন্ নাবহানী, তখন উপলব্ধি করল, মুসলিম খিলাফাত থাকলে তো আর এই নিশ্চুপতা থাকত না।
এই একটা ধারণা, তৈরি করল হিজবুত তাহরির এবং তৈরি করল ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য একটা দারুণ ঝুঁকি। তৈরি করল ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক পরিস্থিতি। পৃথিবীব্যাপী ১৫ লাখ তরুণের স্বপ্ন ও জীবনের পথচলা হয়ে পড়ল এলোমেলো।
হ্যা, হিজবুত তাহরির বা স্বাধীনতার দল একটা সঙ্গঠন যা ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বর্তমানে ইংল্যান্ডের পূব লন্ডনে প্রতিটা মুসলিম বাঙালি তরুণের কাছে যেমন পৌছেছে তেমনি পৌছেছে টেক্সাস বা নিউইয়র্কে। তাদের নাম যদিও দল, তারা কখনোই রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজেদের নাম নিবন্ধন করেনি কোন দেশে। কক্ষনো কোন নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাদের তীব্র জনপ্রিয়তা মধ্যপ্রাচ্যের উচ্চশিক্ষিত ছেলেগুলোর মাঝে। জনপ্রিয়তা মধ্য এশিয়ায়, এমনকি মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মত জাভান দেশগুলোতেও তাদের বিশাল বিস্তৃতি।
চল্লিশটা দেশে হিজবুত তাহরির সক্রিয়। সেখানে, প্রতিটা দেশে আছে ৫০০০ থেকে ১০০০০ সক্রিয় মূল সদস্য এবং অযুত অযুত অযুত সক্রিয় সমর্থক।
তাদের কথা হল, যে যার ধর্ম পালন করবে, সমস্ত মুসলিম জন-প্রধান দেশে একক খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে সামরিক পথেই, প্রতিষ্ঠিত করবে তাদের ভাষায় যা 'শরিআহ' আইন, সেটাকে। তারপর তারা সারা পৃথিবীতে দাওয়াত পৌছাবে ইসলামের।
তারা সারা পৃথিবীর কোন মুসলিম দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশ বলতে আলাদা কোন দেশের অস্তিত্ব তাদের কাছে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। গণতন্ত্র বা মানুষের ভোটে সরকার পরিচালিত হওয়ায় বিশ্বাসী নয়। এবং এজন্য যে কোন দেশকে, উদ্বুদ্ধ করবে তারা। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে, সেনা বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করবে।
রাষ্ট্রক্ষমতাকে হিচড়ে মাটিতে নামাও।
অথচ প্রকাশ্যে বলে বেড়ায়, তাদের নীতি নন-ভায়োলেন্স। যদি নন-ভায়োলেন্সই নীতি হয়ে থাকে, তাহলে দেশে দেশে এত কু' করার চেষ্টা কেন?
আর যে যে দেশে কু করার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিটা দেশে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়। বিশটারও অধিক দেশে। সর্বশেষ ২০০৪ সালে পারভেজ মুশাররফ পাকিস্তানে কু' করার চেষ্টায় এবং ২০০৯-১১ ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়।
তাহরিরের নীতি: ভয়ানক
মুসলিমদের কাজ করা উচিত। তাদের ভূমিকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা উচিত সেই ভূমিগুলোর দিকে যা এখনো ইসলামিকে পরিণত হয়নি। দ্বার উল ক্বুফরকে (অস্বীকারকারী ভূমি) পরিণত করতে হবে দ্বার উল ইসলামে।
-দ্য ইসলামিক স্টেট, তক্বিউদ্দিন, হিজবুত অনুসারীদের শাইখ।
তাহরির কী চায় তাতো অজানা নয়।
কিন্তু তাহরির তা কীভাবে চায়? পৃথিবীতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করতে চায় কীভাবে?
১৯৫৩ সালে তক্বিউদ্দিন আন্ নাবহানী র হাতে গঠিত হবার পরও ১৯৬০ পর্যন্ত তাহরির মূল নীতি তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু নীতি যে গঠিত হয়ে গেছে তা প্রমাণিত হয় ১৯৬১ সালে। তারা ঘোষণা করে, জর্ডানের সাধারণ জনগণ তাদের সাথে আছে। ১৯৬৮-১৯৬৯ সালের দিকে আসল খবর বেরোয়। হ্যা, জর্ডানে একটা ব্যর্থ সেনা অভু্ত্থান হয়েছে হিজবুতের হাতে। সেনা অভুত্থান হয়েছে তখনি সিরিয়াতেও। ১৯৭৪ সালে ব্যর্থ অভুত্থান ঘটায় মিসরে। ১৯৭৮ সালে আরো জানা অজানা বিভিন্ন কু' করতে ব্যর্থ হয়ে হিজবুত তাহরির স্বীকার করে, মুসলিম জাতি ঝিমিয়ে পড়েছে। তারা কুফরি শক্তির হাতে মাথানত করছে। ১৯৯৮ সালে তারা ঘোষণা করা শুরু করে, মুসলিম জাতি এখন খিলাফত চায়। ফিলিস্তিনের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আতা খলিল আবু রুশতা পার্টির তৃতীয় সর্ব্বোচ্চ নেতার পদ নেয় ২০০৩ সালে। আগের দুজনের মৃততুর পর।
তারপর?
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে দশ লক্ষেরও বেশি সংখ্যক হিজবুত তাহরির সদস্য। এরা সবাই ব্রেইনওয়শড।
নীতিটা সুস্পষ্ট।
সামরিক কু' করবে তারা। সেখানে জারি করবে খিলাফাত।
সদস্য: ভয়ের আরেক কারণ
ছবি: ইন্দোনেশিয়ায় হিজবুত তাহরিরের সম্মেলনের উন্মত্ততা।
প্রত্যেক পুরুষ মুসলিম, পনের বছর বা তারচে বেশি বয়সি, বাধ্য থাকবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে জিহাদের জন্য প্রস্তুত থাকতে।
-আর্টিকেল ফিফটি সিক্স, হিজবুত তাহরীর প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধান।
হিজবুত তাহরিরের সদস্য কিন্তু কওমী মাদ্রাসা তথা তালেবান ধরনের নয়, যে জিহাদি জোশে নেমে পড়বে। এবং ঘোড়া নিয়ে গুলির সামনে চলে যাবে। তারা আরো একটু শিক্ষিত।
কতটা শিক্ষিত? শিবিরের মত?
না। শিবির-জামাত থেকেও শিক্ষিত। শিবির-জামাতে শিক্ষা যেমন আছে, তেমনি আছে প্রান্তিক কু-সংস্কারাচ্ছন্ন অসংখ্য মানুষ।
তাদের জ্ঞান-বিবেক-বোধের পর্যায় ও সামাজিক অবস্থান এত নিম্নে যে, তারা 'আল্লাহর আইন' ও 'সৎ' লোকের শাসন জারি করার জন্য সব ক্ষমা করতে প্রস্তুত।
স্বাভাবিকভাবেই, শিবির-জামাতও কখনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বাংলাদেশে।
কিন্তু হিজবুত ভয়ের কারণ। বড় ভয়ের কারণ।
হিজবুত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেনি।
হিজবুত প্রচলিত কু-সংস্কারের পথ ধরে না যা জামাত ও তালেবান পন্থীরা ধরে।
ফলে তারা সমর্থন পাচ্ছে এমন শ্রেণীর কাছ থেকে, যে ছেলেগুলো, মেয়েগুলো কদিন পর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-আর্কিটেক্ট-সিভিল সার্ভিস হোল্ডার বা এমনকি আর্মি অফিসার হবে।
এই ছেলেমেয়েগুলো তাদের ধর্মের প্রতি একটু দায়বদ্ধতা অনুভব করে। নিজের পরিচয় জানতে চায়। আর এই দায়বদ্ধতা তাদের চালিত করছে অতল গহ্বরে।
আমরা বাংলাদেশে সবচে অগ্রসর, সবচে যোগ্য এবং সত্যিকার কন্সট্যান্ট মেধাবী ছেলেমেয়েগুলোকে ভবিষ্যতের হিজবুতি হিসাবে পাচ্ছি, যা আসলেই ভয়ানক।
বিশেষ করে প্রতিটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের থানা।
আরেকটা ভয়ের কারণ, হিজবুত পুরোপুরি তাদের নীতিতে অটল নয়। যারা পুরোপুরি নীতিতে অটল নয়, তাদের বিষয়ে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না। গণতন্ত্র ও ভোটিং ব্যবস্থাকে হারাম ঘোষণার পরও হিজবুত কিরঘিজিস্তানে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দিয়েছিল।
তাদের কাজের ধারা সারা পৃথিবীতে একই রকম। প্রথমে নতুন সদস্য সংগ্রহ করবে। আর সেজন্য এগিয়ে যাবে শুধু অগ্রসর শ্রেণীর শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কাছে। দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠা করবে গোপন শাখা ও সেল। তৃতীয়ত সরকারের ভিতরে সর্বস্তরে প্রতিনিধি তৈরি করা শুরু করবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রথম দুটা ধাপ তারা সফলভাবে শেষ করেছে এবং তৃতীয় ধাপটায়, দু:খজনক হলেও সত্যি, অনেকটা অগ্রসর হয়েছে।
ইসলাম: হিজবুত তাহরীর সব স্তরের মুসলিমদের মধ্যে গ্রহণীয় নয়
এখানকার (ইন্দোনেশিয়া) আরো অনেক ইসলামপন্থি আন্দোলনের সাথে একটা দিক দিয়ে অমিল আছে হিজবুত তাহরিরের। বিশাল জনগোষ্ঠীকে অনুসারীতে পরিণত করার দিকে তাদের মনোযোগ খুবই কম। বরং তাদের চাই পুরোপুরি নিবেদিতপ্রাণ স্বল্পসংখ্যক অনুসারী, যাদের অনেকেই আসছে ইন্দোনেশিয়ার মিডল ক্লাস শিক্ষিত পরিবার ও শ্রেণী থেকে।
-বিবিসির এই কথার সাথে সারা পৃথিবীতে হিজবুতের কাজের ধারার মিল পাই আমরা।
আল ক্বায়িদাহ্ নেটওঅর্ক, হিজবুত তাহরির, জামাতে ইসলামি বা তালেবানকে সারা পৃথিবীর মুসলিমদের সাথে মিলিয়ে ফেলার কোন কারণ নেই।
ইসলাম ভাল কি মন্দ সে প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, হিজবুত তাহরীর যে নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, সেটার সাথে সারা পৃথিবীর মুসলিমরা আদর্শের দিক দিয়ে ও ধর্মের দিক দিয়ে কতটা যুক্ত?
এজন্য আমাদের যেতে হবে আজ থেকে বেশ কয়েকশত বছর আগে। হিজবুত তাহরীর, আল ক্বায়িদাহ্ , তালিবান বা জামাতে ইসলামী যে আন্দোলন দ্বারা অনুঘটিত, সেটার শুরু হয় দামাস্কাস অধিবাসী একজন নব্য ইসলাম-বিশারদ ইবনে তাইমিয়্যাহ (১২৬৩-১৩২৮) এর কাছে।
ইবন তাইমিয়্যাহ ছিলেন একজন পরিপূর্ণ জ্ঞানে মনোনিবেশকারী ব্যক্তি যিনি সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ইসলামের রূপকে পরিপূর্ণভাবে অস্বীকার করে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ভাবধারা প্রচলন করেন, শত শত বই লেখেন যা সারা পৃথিবীর প্রচলিত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন এবং স্বাক্ষর করেন তখনকার আড়াইশো আরব-অনারব ইসলাম বিশারদ।
কী বিষ লুকিয়ে ছিল ইবনে তাইমিয়্যার আন্দোলনে?
ইসলামে কোন দিক নির্দেশক ধর্ম-নির্দেশদাতা বলতে কিছু নেই। যে কোন মুসলিমের ইজতিহাদ (ইসলাম বিষয়ক যে কোন সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া, কারো নির্দেশনা বা কোন ধরনের গাইডেন্স ব্যতীত) করার অধিকার রয়েছে। (ব্যক্তি পর্যায়ে, নিজের ইচ্ছামত আইন মনে করে) যে কোন কাজ করাই সঠিক যদি তা কুরআন থেকে নিষেধ করা না থাকে।
- উইকিপিডিয়া
উল্লেখ্য, এই বিষয় তাইমিয়ার আগেও কোনদিন ছিল না, তাইমিয়ার অনুসারী ছাড়া আর কারো কাছেও কোনদিন নেই। এই অনুসিদ্ধান্তই আল ক্বায়িদাহ বিপর্যয়, তালিবান বিপর্যয় ও জামাতে ইসলামি বিপর্যয়ের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।
তিনি মুসলিম-অমুসলিম সহাবস্থান সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন, মুসলিমদের জন্য যুদ্ধের একটা বাড়তি জোর আরোপ করেন এবং যে কোন প্রকারে যুদ্ধলিপ্ত হওয়ার যে ধরণটা এখন দেখা যায়, সেটা প্রবর্তন করেন। তাঁর সম্পর্কে অসংখ্য তৎকালীন ইসলাম বিশারদের মন্তব্য, ইবনে তাইমিয়্যার ইলম (জ্ঞান) খুবই বেশি কিন্তু আক্বল (বিশ্লেষণী ক্ষমতা/বিবেক) অত্যন্ত কম। এ যৌগিকতা বিপর্যয় নিয়ে আসবে।
ঠিক এই যৌগিকতাই বিপর্যয় নিয়ে এল যখন ইবনে আবদুল ওয়াহহাব আন্ নাজদী (১৭০৩-১৭৯২) একজন ব্রিটিশ বহুভাষাবিদ ড. হামফ্রের সহায়তায় তুর্কি খিলাফাতের বিরুদ্ধে এবং প্রচলিত সারা পৃথিবীর ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করেন, ইচ্ছা অনিচ্ছা নির্বিশেষে পুরো আরবের তরুণদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মসজিদে আটকে রেখে তীরন্দাজী, তলোয়ারবাজি ও জিহাদি মন্ত্রে উজ্জীবীত করেন। মক্কা থেকে মদীনার তিনশ কিলো পথে হাজারো সাধারণ মুসলিমদের তাবু জ্বালিয়ে দেন এবং পুরো মক্কা-মদীনায় বিশ হাজার সাহাবীর কবর-চিহ্ন পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে যুদ্ধংদেহী তীব্র একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর পরিবারের সাথে বিবাহ সম্পর্কে যুক্ত হয় সৌদি জমিদার। এই আস সাউদ জমিদারের নামে তিনি দেশের নাম করেন সৌদি আরব এবং পুরো জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে মিশর-জর্ডান সর্বত্র শুধু এই যুদ্ধংদেহী মতবাদ প্রচার করে বাকী ক্ল্যাসিক ইসলামকে পুরোপুরি বিতাড়িত করেন।
তাইমিয়্যাহ- ওয়াহাব নীতি আরবে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে থাকা শক্তিগুলোও তাইমিয়্যাহ-ওয়াহাব নীতি অনুসরণ করে।
আল ক্বায়িদাহ্'র মত উন্মাদ সঙ্গঠন, জামাতে ইসলামীর মত দেশদ্রোহী সঙ্গঠন বা তালিবানের মত অপরিণামদর্শী ছাত্র সঙ্গঠন যেমন এই আদর্শের সরাসরি অনুসারি তেমনি কট্টর অনুসারী হিজবুত তাহরীর।
কিন্তু পুরো পৃথিবীতে মুসলিম জনসংখ্যার কিয়দংশই এই মত ও চরমপন্থীতা সাপোর্ট করে।
মানচিত্র: পৃথিবীতে মুসলিম স্কুল অভ থটের বিস্তৃতি। এখানে আরব ভূমিতে (মূলত সৌদি আরবে) সীমাবদ্ধ যে সেক্টটাকে হাম্বলি হিসাবে দেখানো হচ্ছে মূলত তা আর হাম্বলি নেই। তারা এখন আর হাম্বলি মতাদর্শ গ্রহণ করেন না, প্রকাশ্যে রিজেক্ট করেন। অথচ বাকি সারা পৃথিবীতে দেখানো হানাফি, শাফিই, মালিকি, হাম্বলিরা স্কুল অভ থটে আলাদা হলেও তাদের পারস্পরিক স্বীকৃতি সর্বকালীন। এই স্কুলস অভ থট বা মাজহাবের অনুসারীরা বলেন, যে কোন একটা মাজহাব অনুসরণে কোন সমস্যা নেই, সবই সঠিক এবং অনুসরণযোগ্য। কিন্তু তাইমিয়া-ওয়াহাব মতবাদের সামান্য আঞ্চলিক বিশ্বাস এখন হিজবুত তাহরির-তালিবান-আলক্বায়িদাহ বা জামাতে ইসলামি নাম দিয়ে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে যার পরিণাম সংঘর্ষ। কারণ তাদের নব্য বিশ্বাস অনুযায়ী, বাকি সব অনুসারীরা কোন না কোনভাবে মুরতাদ এবং হত্যার-উপযোগী!
হয়ত এ কারণেই হিজবুত তাহরীর কখনো জনসমর্থন চায় না, বরং ক্ষমতাবানদের হাত দিয়ে ক্ষমতা দখলের সমর্থন চায়।
এবং তাদের দৃষ্টিতে, তাদের প্রতি যারা তাদের প্রতিষ্ঠিত স্টেটে অনুগত না থাকবে, সেই মুসলিমদের কী হবে?
যারা নিজেদের সাথে ইসলামকে যুক্ত করে, কিন্তু ইসলাম থেকে বিচু্তির দোষে দুষ্ট, তাদের মৃততুদন্ড প্রদান করা হবে।
-হিজবুত খিলাফাতের খসড়া সংবিধানের আর্টিকেল সেভেন ।
হিজবুত তাহরীর উলাইয়া বাংলাদেশ: কীভাবে চলে?
যেসব দেশে হিজবুত তাহরির বেআইনি ঘোষিত হয়েছে, সেসব দেশে সংগঠনটি শক্তভাবে সেন্ট্রালাইজড হয়ে পড়ে। এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পুরোপুরি ফিলিস্তিন নির্ভর। এই কেন্দ্রের নিচে থাকে জাতীয় সঙ্ঘ বা উলাইয়া। স্থানীয় কমিটি ও সেলগুলো চালনার জন্য তাদের থাকে সাধারণত বারোজনের একটা সঙ্ঘ।
-মালিক শিভ, ফর আল্লাহ অ্যান্ড দ্য খিলাফাত, নিউ স্টেটসম্যান, ২০০৪
পার্টির মৌলিক ইউনিটে মাত্র পাঁচজন থাকে, যাদের ডাকা হয় মুশরিফ নামে। তারাই জানে অন্য সেলগুলোর সদস্যদের নাম। আর কেউ নয়।
-গ্লোবাল সিকিউরিটি ডট অর্গ, হিজবুত তাহরির আল ইসলামি।
বোঝাই যাচ্ছে, হিজবুত তাহরির উলাইয়া বাংলাদেশ হল এমন একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সঙ্ঘ, যার গঠন প্রকৃতি পুরোপুরি জঙ্গি সঙ্ঘের সাথেই তুলনীয়।
তবু আমরা এই ব্লগেই, অথবা অন্যান্য ব্লগে ও অন্যান্য ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগের অসংখ্য প্লাটফর্মে দেখতে পাই, জিহাদি মৃততুর হাতছানি।
এই হাতছানি যদি আমার বাসার ছোট ভাইটা বুঝে না ওঠে,
এই হাতছানিতে যদি সে সাড়া দেয়, অথবা আপনার কোন কাজিন-
কিছু অংশে দায়ী আমরাও থাকব।
নীতির প্রতিফলন যদি বাংলাদেশে হয়
ছবি: এক সময়ের প্রকাশ্য হিজবুত তাহরির পরিণত হয়েছে হিজবুত তাহরির উলাইয়া বাংলাদেশ এ
মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট ভ্যানগার্ড পার্টির মত, তারাও গুরুত্বপূর্ণ পদ-অবস্থানে থাকা শতশত অনুসারী দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়, হাজার হাজার পদাতিক সৈন্য দিয়ে নয়।
- জেয়নো বারান, নিক্সন সেন্টারের থিঙ্কট্যাঙ্ক, ওয়াশিংটন ডিসি।
হ্যা, প্রথমে তারা তীব্র অটুট আনুগত্য তৈরি করবে একদল অগ্রসর অনুসারীর ভিতরে। এই আনুগত্য এমনি, নেতৃত্ব যা বলবে, তারা তাই করবে। এরপর তারা এগিয়ে যাবে সাধারণ জনমতের দিকে। বিতর্ক, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোপন সভার মাধ্যমে তৈরি করবে জনমত। সবশেষে তা চলতে থাকবে পোস্টার, লিফলেট, জিহাদি বই ইত্যাদির মাধ্যমে। এবং এসব শেষ হবার পর একটা মাত্র চেষ্টা, আর্মি জেনারেল, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলা- এদেরকে হাত করা পাশাপাশি ওইসব প্রশাসনে প্রাথমিক স্তরে নিজেদের সদস্য ঢোকানো।
আমরা সেই তীব্র অটুট আনুগত্য তৈরি করতে দেখেছি নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় হিজবুত তাহরিরের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ওয়র্কশপ করা শুরু হয়। আমরা যথারীতি তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড যেতে দেখেছি। এবং ভয়ের কথা হল, তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা মানুষকে নিজেদের দিকে আনার চেষ্টাও দেখেছি।
আমরা এখনো পথে পথে দেখি, উলাইয়া বাংলাদেশ বাংলাদেশের মানুষকে উলাচ্ছে এই বলে যে, আমাদের সামরিক অফিসারদের হত্যা করেছে আমাদের দেশের কোন একটা রাজনৈতিক দল। এই কথাটার সত্য-মিথ্যায় যেতে চাই না। শুধু একটা বিষয়ে যেতে চাই, এই কথাটা যদি সামরিক বাহিনীতে ব্যাপকহারে বিশ্বাস করা শুরু হয়, তাহলে দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
নিশ্চই ব্লগের নিয়মিত যারা, তাদের মনে আছে, কিছুদিন আগে কথিত একজন মেজর এর ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে কপি করা একটা চিঠি সারা অনলাইন কমুনিটিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
যথারীতি সেদিকে চোখও দেইনি প্রথম প্রথম। চিল ও কান বিষয়ক কোন কাজ হবে ভেবেছিলাম।
কিন্তু পরে দেখা গেল, আসলেই সেই মেজর, আরো বেশ কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সামরিক অভু্ত্থানের চেষ্টা করেছিলেন যেটার বিষয়ে এমনকি সামরিক বাহিনীতে উচ্চতর পদে থাকা অফিসারদেরও কোন সম্মতি ছিল না।
ধরা যাক, সেই অভিযান সফল হতো, ফলাফল কী দাঁড়াত বাংলাদেশে?
তরুণ কয়েকজন অফিসার ক্ষমতায় যেতে চেষ্টা করত। যা ৭৫ এ কোনভাবে সম্ভব হয়ে থাকলেও, এবার সম্ভব হওয়া কঠিন ছিল। ফলে, আওয়ামীলীগ সমর্থকরা গণহত্যা শুরু করত বিএনপি ও বিশেষ করে জামাত সমর্থকদের বিরুদ্ধে। জামাত-বিএনপি শুরু করত আওয়ামী ও কথিত আওয়ামী বিরুদ্ধে। যা হয়েছিল আশির দশকের শুরুতে ইন্দিরা-শিখ ঘটনায়।
পুরো দেশের এই অরাজকতায় তিনটা মাত্র ঘটনা ঘটতে পারত-
১. কোন শীর্ষ সামরিক অফিসার ক্ষমতা দখল করতেন হয়ত রাষ্ট্রের জন্যই।
২. অবশ্যই জামাত দৌড়ে এগিয়ে আছে। তারা প্রশাসন ও সরকারি বড় কোন ক্ষেত্র থেকে ক্ষমতার দিকে এগুত।
৩. কোনক্রমে হয়ত হিজবুত ক্ষমতা দখল করত।
৪. ভগ্ন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকত এবং নিজেরাও মারামারি শুরু করত।
যদি ২ বা ৩ ঘটে যেত কোনক্রমে, তাহলে এর ফলাফল কী দাঁড়াত?
যে ফলাফল দাঁড়িয়েছিল আফগানিস্তানে, যে ফলাফল দাঁড়িয়েছিল ইরাক-লিবিয়া-পাকিস্তানে, ঠিক সেটাই।
বাংলাদেশের মানুষকে একটু সচেতন হতেই হবে।
উলাইয়া বাংলাদেশ ব্যাপক প্রচার চালায়, পোস্টের সবচে উপরের কথাগুলো নিয়ে। সাধারণ মুসলিম মানুষ, আটপৌরে মুসলিম মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে।
আর এই দ্বিধা সরাতে হলে শুধু তাহরিরকে ব্যান করলেই হবে না।
এই দ্বিধা সরাতে হলে শুধু তাহরিরকে গ্রেপ্তার করলেই হবে না।
এই দ্বিধা সরানোর জন্য চাই ব্যাপক মৌলিক বিশ্লেষণ।
চাই তীব্রভাবে সাধারণ মানুষের কাছে ও বিশেষ করে শিক্ষিত নেটগামী তারুণ্যের কাছে তাহরিরের প্রকৃত রূপ তুলে ধরা।
তা নাহলে আসন্ন বিপর্যয় ঠেকানোর কোন পথ আমাদের সামনে খোলা থাকবে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা তিন সহস্র সহস্র প্রাণ আর দুইশত সহস্র নারীর বিনিময়ে যে দেশটাকে এনে দিয়েছিলেন, তার ভবিষ্যতের দিকে চোখ রাখার দায়িত্ব একটু হলেও আমাদের উপর বর্তায়।
হিজবুত তাহরিরে অনুসারী দেশে সব মিলিয়ে মাত্র দশ বিশ হাজার বা একলাখ হতে পারে, কিন্তু এই দেশটাকে পূর্ণরূপে প্রস্তরযুগে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এই সংখ্যাই যথেষ্ট।