১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস! বাংলাদেশের জন্যও তাই? বাংলাদেশে কি বিশ্বের বাইরের কোনো দেশ নাকি! ফলে মুদ্রণ ও সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে রঙিন সব বিশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠান। মোবাইল অপারেটরগুলোতে দারুন সব অফার, কনসার্টের তোড়জোড়। ফুলের দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড় আর গিফটের দোকানগুলোতে রমরমা ব্যবসা। ভালোবাসার এমন বন্যায় প্লাবিত চারপাশ- এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছে। এতসব উৎসবের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে আমাদের মহত্তর সংগ্রাম ও অর্জনের ইতিহাস। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা মহানগর ব্যাপী এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে শুধু মহানগর ব্যাপী ১০ জন শহীদ হন ও শতাধিক আহত হন। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার পঞ্চাশ ভাগ ব্যয় শিক্ষার্থীর পরিবারকে বহন করতে হতো। ফলে শিক্ষা একটি শ্রেণী হাতে আরো কুক্ষিগত হতো, শিক্ষার অধিকার হতে বঞ্চিত হতো অনেক মানুষ। শিক্ষা অর্জনের জন্য মাতৃভাষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কিন্তু এ নীতি অনুযায়ী শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই বাংলার সঙ্গে আরবি ও ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় যা ছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থি এবং পশ্চাৎপদ ও উপনিবেশিক সংস্কৃতির আগ্রাসনের বন্দোবস্ত। শিশুদের জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে তা হতো নিপীড়নমূলক। বুকের রক্ত ঢেলে জীবন দিয়ে সেদিন ছাত্র-জনতা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে ভাষা সংস্কৃতি রক্ষার্থে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং স্বৈরাচারী সরকার ও প্রশাসনকে বাধ্য করেছিল এ বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি স্থগিত করতে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এ আন্দোলনই বলা যায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রথম বিস্ফোরণ। এরপর গোটা আশির দশকজুড়ে প্রতি বছর এদিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তখন আওয়ামীলীগ, বিএনপি, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বাম প্রগতিশীল ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি দিয়ে দিবসটি পালন করে এবং সংবাদ মাধ্যমগুলোও এর পক্ষে প্রচার চালায়।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পত্তন ঘটে। সেই গণতন্ত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় স্বৈরাচার। জনগণের আত্মদানের ফসল ঘরে তোলে সামন্তবাদের রক্ষক ও সাম্রাজ্যবাদের সেবক-দালাল রাজনৈতিক দলগুলোই। জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মদানের ফসল শাসক শ্রেণীর কাজে লাগানো বা শাসনক্ষমতা শ্রেণী বিশেষের বিকাশের স্বার্থে ব্যবহার নজির বাংলাদেশ এবং বিশ্বের ইতিহাসে ভূরি ভূরি পাওয়া যায়। স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলে ক্ষমতাসীন শ্রেণীই জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জনগণের ওপর চালু করে নতুন শোষণমূলক ব্যবস্থা। শোষণ টিকিয়ে রাখতে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আইন, প্রথা, ভাষা, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে শোষণের অনুকূলে প্রবাহিত করতে তৎপর হয়েছে। তেমনি ১৯৯০-উত্তর ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী তার সংসদীয় স্বৈরাচার অটুট রাখতে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জনগণের অর্জনগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করে। তারই অংশ হিসেবে এদেশে আমদানি করা হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে। কথাটা হয়তো অনেকের কাছে নির্মম লাগতে পারে। কিন্তু এ সত্যকে আমরা এড়াতে পারি না। ১৯৯২ সালেই এর আমদানি ও বাজারজাতকরণের কাজ শুরু হয় এবং দীর্ঘ ১৮ বছরের নিরন্তর প্রচারে ও চর্চায় শাসক শ্রেণী বেশ সফলতায় আমাদের স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের নাম ভুলিয়ে দিতে কৃতিত্বের সঙ্গে সক্ষম হয়েছে। আজ খুব সামান্যই প্রচারে আসে দিবসটির কথা। তৎকালের জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক দিবসটিকে বাংলাদেশে পরিচিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। পরে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে আরো ঢালাও এবং আকর্ষণীয় করে প্রচার ব্যবসায়িক স্বার্থকে কোনো প্রচার মাধ্যমই এড়াতে পারেনি। আজ বাংলা দৈনিকের পাতার নাম হয় ‘রাজনীতি’র বদলে ‘পলিটিক্স’, ‘খেলাধুলা’র বদলে ‘স্পোর্টস’, ফিচার পাতার নাম ‘বিজনেস অ্যান্ড ক্যারিয়ার ক্লাব’! চলছে সংবাদের বিবৃতিতে ইংরেজি শব্দ বাংলায় লেখার চর্চা। একই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখি ডিজুস সংস্কৃতির প্রতাপ- ইংরেজিতে বাংলা লেখার উদ্ভট চর্চা; উর্দু হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগের সঙ্গে এর অনেক মিল। এ পাঁয়তারা কি মহান একুশের চেতনার পরিপন্থী নয়? এই ভাষা আন্দোলনের মাসে ১৪ ফেব্রুয়ারি টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছে ‘ভালোবাসা’ আর ‘ভাষা’ মিশিয়ে চমৎকার ন্যাকামি সমৃদ্ধ প্রতিবেদন এবং অনুষ্ঠান। ভালোবাসা আমাদের জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের মতো দেশে যেখানে আধা সামন্তীয় সংস্কৃতি বিদ্যমান সেখানে যখন ভালোবাসা দিবসকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সংস্থাপনের চেষ্টা চলে তখন তা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। এগুলো আমাদের ছাত্র, যুবক ও মেহনিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে অন্ধ-বধির-মূক করে রেখে ‘আমি-তুমি’র আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থসর্বস্ব সম্পর্কে বেঁধে রাখার পাঁয়তারা মাত্র। প্রতিবাদের ভাষা ও অর্জনগুলো বিস্মৃত করার কৌশল।
সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পুরুষের অধিকৃত নারী। আজ পর্যন্ত নারী-পুরুষের প্রেম ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা ব্যক্তি মালিকানা দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ আজও নারী পুরুষের সম্পর্ক শ্রেণীস্বার্থ দ্বারা পরাধীন। তাই পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে প্রেম নারী-পুরষের পারস্পরিক সমতাকে স্বীকার করে না। ফলে তা নানান বিকৃতির স্বীকার হয়। এ জন্য যতদিন শ্রেণী থাকবে এবং সম্পদের সামাজিকীকরণ হবে না ততদিন নারী-পুরুষের ভালোবাসাও মুক্ত হতে পারবে না। ফলে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আন্দোলন পক্ষান্তরে প্রেমের পক্ষেই আন্দোলন।
যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান তরুণ-যুবকদের যুদ্ধে মনোযোগী করতে সব বিয়ে ও বাগদানকে বেআইনি এবং বাতিল ঘোষণা করে। যুদ্ধবাজ সম্রাটের এ নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন-এর সংগ্রাম ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম। অথচ আজ সেই মহান ভ্যালেন্টাইনের প্রেমের সংগ্রামী চেতনা থেকে সংগ্রামটুকু বাদ দিয়ে কেবল ভালোবাসাটুকু নিয়ে শাসকশ্রেণী নিজের কাজেই লাগাচ্ছে। অবশ্যই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন স্মরণীয়, শ্রদ্ধেয় ও অনুসরণীয়।
আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ফেব্রুয়ারি মাসটা আমাদের জাতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ২৪ ও ২১ ফেব্রুয়ারি বেদনা এবং গৌরবের এক আশ্চর্য মিশ্র চেতনার জন্ম দেয়। প্রকৃতিতেও বসন্তের সূচনা হয় এ মাসেই। বসন্ত যৌবনের প্রতীক। যৌবনই হলো প্রেম ও বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ জন্মভূমি। প্রেম থেকে সংগ্রামটুকু বাদ দিলে যৌবন আর যৌবন থাকে না, তাকে বলে বার্ধক্য। তাতে নারীর মুক্তি নেই। প্রেমের ধারণা সেখানে অলীক। যখন চারদিকে শোষণ-নিপীড়ন-পরাধীনতার নতুন কৌশল রচনা হচ্ছে তখন সংগ্রামের চেতনাকে ভুলিয়ে দিতে তৎপর আত্মকেন্দ্রিক প্রেমের এ সংস্কৃতি কখনো আমাদের কল্যাণ বয়ে আনবে না।
অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কানসাট, ফুলবাড়ি, রূপগঞ্জে গণহত্যায় ক্ষরিত রক্ত এখনো শুকায়নি। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর এখন সংসদীয় উপায়ে জনগণের উপর শোষণমূলক ব্যবস্থা বজায় রেখেছে এবং রাখছে। জনগণের ভাত-কাপড় নিশ্চিত না করে, প্রকৃত ক্ষমতার মালিকানা না দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে কেবল ভোট দেওয়াকেই শিখিয়েছে। ‘টেকসই উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধি’র ধারণায় সাম্রাজ্যবাদের সেবার অর্থনীতি কায়েম করেছে আর ‘সুশাসন’এর নামে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ব্যাপক জনগণের উপর কায়েম করেছে স্বৈরাচারি ব্যবস্থা। সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী মহাজোট সরকার। দ্রব্যমূল্যের ধারাবাহিক উর্ধ্বগতিতে কেবল গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসেই দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১৬%। গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শ্রমিকদের জন্য অন্যায্য মজুরি কাঠামো, শিল্প-পুলিশ গঠন, ভারতকে ট্রানজিট প্রদান ও দেশবিরোধী হাসিনা-মনেোহন চুক্তি, সাম্রাজ্যবাদের হাতে তেল-গ্যাস-কয়লাসহ খনিজ সম্পদ তুলে দিতে কয়লানীতি, মডেল পিএসসি ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিল পাশ করেছে। বন্দর ও গভীর সমুদ্র সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। সমাজের সকল স্তরে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। শ্রমিক হত্যা ও নির্যাতন, ছাত্র হত্যা, পাহাড়িসহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার ওপর দমন, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম সীমা ছাড়িয়েছে। চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন, ইভ টিজিং, শিক্ষক হত্যা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দোহাই দিয়ে চলছে লুটপাট আর দেশ বিক্রির মহোৎসব। এসবের বিপরীতে জনগণও নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে। শিল্পাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমিক হত্যা-নির্যাতন বিরোধী ধারাবাহিক শ্রমিক বিক্ষোভ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্ধিত ফি ও অগণতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, বিকশিত হচ্ছে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, জাতিসত্ত্বার আন্দোলন, আড়িয়াল বিলে ভূমি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধেও চলছে গণপ্রতিরোধ। শাসকশ্রেণীর ভুয়া ‘স্বাধীনতা’, ‘গণতন্ত্র’র বিপরীতে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শর্ত তৈরি হচ্ছে ।
কিন্তু আমরা আজ যে কতটা অথর্ব এবং জাতীয় স্বার্থবিমুখ তার প্রমাণ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আমরা জেনে-বুঝে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি।
আজ কোনটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ- গণতন্ত্রের জন্য জনগণের সংগ্রামের চেতনা, নাকি সেই চেতনাকে আড়াল করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতিষ্ঠিত আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থবাদী ভালোবাসার চেতনা? আমাদেরই ঠিক করতে হবে পথ।
(অনিন্দ্য মোস্তফা মাহবুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)