আমেরিকানরা নাকি হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে অভ্যস্ত। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পড়ে সেক্ষেত্রে ব্যক্তি বদ্ধ ঘরে পাঁয়চারী করতে থাকে। মনের ভাবনার অভিব্যক্তির বৈচিত্র্যতার দিক হতে লক্ষ্যহীন পাঁয়চারীর স্কোরিং অনেক বেশি। এরা অবশেষে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। এ কারণে এ অবস্খায় সামনের জনকে বিরক্ত করতে নেই।
নাকে হাত দেয়া
এক্ষেত্রে ব্যক্তি চোখ বন্ধ করে নাকের গোড়া চিমটি দিয়ে ধরে থাকে। অনেকে আবার মস্তক সামান্য অবনত করে নেয়। ব্যক্তি যেন পরখ করে নেয় সে স্বপ্নে না বাস্তবে। এটিও প্যাসিং বা হাঁটার মতো গভীর অনুভূতিজ্ঞাপক অভিব্যক্তি। এ সময়ে ব্যক্তিকে কোনোরূপ বিরক্ত না করাই কাáিক্ষত।
বডি ল্যাংগুয়েজ ও পলিটিক্স
পাওয়ার পলিটিক্স! চলতে-ফিরতে আমাদের প্রতিদিন নানা কৃত্রিম আচরণ করতে হয়। মানুষ তার আচরণকে সমাজ নির্দেশিত আঙ্গিকে প্রসারের যতই চেষ্টা চালায় না কেন, ব্যক্তির অগোচরে অনেকটা অবচেতনভাবেই মনের আসল স্বরূপের প্রকাশ ঘটে যায়। অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন শক্তির দাপটের খেলায় মেতে ওঠে, তখন তার প্রকাশ কী? নেতাদের নেতৃত্বের যে নি:শব্দ নির্বাক ভাষা, তার মাঝেও এক ধরনের বিশেষ অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। তাদের অঙ্গভঙ্গিমা আর দেহভাষার মধ্য দিয়ে তাদের নেতৃত্বের আসল সত্যও নাকি বের হয়ে আসে। এমন ধারণা দেন বর্তমানকালের সাইকোলজিস্টরা। তাদের কমান্ডের চরমতম মুহূর্তগুলোতে ক্যামেরায় তোলা ব্রোমাইড প্লেটে ছবির সাথে মনের নেপথ্য সংলাপেরও ছাপ যেন এতে পড়ে যায়। এ কারণে নেতাদের নেতৃত্বের ভঙ্গিমায় অনেক অনন্যতা দেখা যায়।
বিকট মুখবিবর!
‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ বা ‘আলট্রান্যাশনালিজম’ যখন রাজনৈতিক সংগ্রামের মুখ্য লক্ষ্যস্খির হয়ে থাকে, তাতে যে বিশেষ অভিব্যক্তি তা হলো ‘প্রসারিত বিকট মুখবিবর।’ এর মধ্য দিয়েই যেন উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির মাদকতার প্রকাশ ঘটে। এ তালিকাতে ছিলেন জার্মান নেতা হ্যারমান গোরিং আর পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো।
হ্যারম্যান গোরিং ছিলেন হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী এ নাৎসি নেতাকে খাঁটি জার্মান আন্দোলনের একজন পুরোধা বলা হয়ে থাকে। সে ছিল তৎকালীন ইহুদিদের এক মহাআতঙ্কের মতো। তার কথাবার্তা আর আচরণে সর্বদাই জাতীয়তাবাদের চরম উগ্রতা প্রকাশ পেত। ভুট্টো তনয়া পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও এমন ভঙ্গিতে শক্তির মাদকতা প্রকাশ করতেন। তার বক্তৃতায় যখনই কাশ্মীর প্রসঙ্গ আসত, তখনই ‘আজাদী, আজাদী’ উচ্চ প্রকম্পনে চারপাশ আন্দোলিত করে তুলতেন। আর সাথে ছিল সে ভঙ্গি ‘বিকট মুখবিবর সিম্বল’ন্ধএটি ছিল যেন বেনজিরের নেতৃত্বের চরম মুহূর্তের জন্য সংরক্ষিত একটা দেহভাষা।
যেন বিদায়ের অভিবাদন
কারো কারো বেলাতে নেতৃত্বের ভঙ্গিমা ছিল স্রেফ ডান হাত তোলা। ঠিক যেন বিদায় জানানো হচ্ছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো আর রোমানিয়ার নিকোলি চসেঙ্কু এ ভঙ্গিমা ব্যবহার করতেন। দুর্ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এ সারির দুজনই নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার হন।
পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনশাস্ত্রের ডিগ্রিধারী। এ আইনজীবী মিলিটারি জান্তারের কাছ থেকে দেশ উদ্ধার করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের ইতিহাসে এতটা গণতান্ত্রিক আর কোনো নেতা ক্ষমতায় আসীন হননি। তিনি পরবর্তীতে একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন ও বিচারে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট কমরেড চসেঙ্কু। ক্ষমতার অপব্যবহার, বিলাসবহুল জীবনযাত্রার কারণে অর্থনীতি আর রাজনৈতিক ধস নামে। পরিণতিতে তাকে সন্ত্রীক ফায়ারিং স্কোয়াডে মারা হয়, যা কিনা সারাবিশ্বের টেলিভিশনে প্রচার পর্যন্ত করা হয়েছিল। তাদের জীবনের এ করুণ পরিণতি যেন অনেক আগে হতে ‘বিদায়ের অভিবাদন’এ পাওয়ার সিম্বলে তা প্রকাশ পেত।
হাতজোড় ভঙ্গিমা!
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী, দক্ষিন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে এ হাতজোড় ভঙ্গিমাতে দেখা যেত। সাদ্দাম যেন হাতজোড় ভঙ্গিতে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার কাছে আরো শক্তি চাইছে, যেন সে আরো শৌর্যবীর্য শক্তিমান হতে পারে। রাজিব গান্ধীর নমস্কার হাতজোড় মিনতি অভিব্যক্তি জনতার ভালোবাসাই যেন তার চাওয়া-পাওয়ার সবকিছু। নেলসন ম্যান্ডেলার মাঝেও একই অনুভূতি। মাদার তেরেসারও হাতজোড় ভঙ্গিমা; স্রষ্টার কাছে এ যেন তার মিনতি ‘মানুষকে শান্তি দাও, সুখ দাও, স্বস্তি দাও।’
মুখে চুরুট
অনেক বড় বড় নেতার স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল ‘মুখের চুরুট’। শক্তির চরম মুহূর্তগুলোতে এটি একদম সঙ্গীর মতো সাথে থাকা চাই। ইন্ডিয়ার জওহর লাল নেহরু আর কিউবা বলিভিয়ার কমিউনিস্ট নেতা আর্নোস্টা চে গুয়েভারা এ তালিকায় শীর্ষস্খানীয়। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফন্সাঙ্কলিন ডিনাল্ডো রুজভেল্ট, যিনি পরপর তিনবার প্রেসিডেন্ট ছিলেন (১৯৩২-৪০) তারও স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল এটি।
হাত দেখানো
নেতাদের কারো কারো বেলাতে কেবল পাঁচ আঙুলের হাতকে নেতৃত্বের সিম্বল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দুই জন প্রাক্তন ভারতীয় মন্ত্রীদের বেলাতে এটি দেখা যায়। একজন ইন্দিরা গান্ধী আর অপরজন ভিপি সিং। তাদের এ দেহভঙ্গিমাতে নাকি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে। প্রথমজন অবহেলিত উপেক্ষিত দরিদ্র নিম্নবর্ণের লোকদের অবস্খার উন্নতি চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তার শাসনে জরুরি অবস্খার ঘোষণা দিয়ে লোকসভায় তার নির্বাচনসংক্রান্ত কোর্টের একটা অনাস্খা প্রস্তাব বাতিল করে দেন। ঠাকুর গোত্রীয় ভিপি সিং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বাড়তি অধিকার প্রদানে পিছপা হন। তাদের দুজনের নেতৃত্বের মাঝেও অসহিষ্ণুতা ছিল।
নেতৃত্বের হাতের মুঠো
উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতা আর রাষ্ট্রপ্রধান হো চি মিন আর উগান্ডার একনায়ক প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন ‘হাতের মাঝে সর্বক্ষমতা ধরে রাখা চাই এমন ভঙ্গিমা’ দেখাতেন। হো চি মিন তার দেশবাসীকে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। আর তার এ অকপট নিষ্ঠায় নেতৃত্বে ভঙ্গি সত্যিসত্যিই অধিকার অর্জন করে নিতে পেরেছিলেন।
ইদি আমিনও দেশের সমস্ত শক্তি তার হাতে কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিলেন। তার এ অন্ধমোহের কারণে তিনি যথার্থ রাষ্ট্রজ্ঞানবোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন আর একজন জঘন্য একনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। যারা নেতৃত্বের হাতের মুঠোর সিম্বলধারী ছিলেন, তাদের কেউ অধীনস্খ কারোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেননি, পুরো ক্ষমতা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন।
উদ্ধত তর্জনি
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, প্রাক্তন ভারতীয় প্রেসিডেন্ট চন্দ্রশেখর দুজন নেতৃত্বে কেবল ডান তর্জনি আঙুল সিম্বল ব্যবহার করতেন। জন এফ কেনেডির এ উদ্ধত তর্জনিতে প্রকাশ পেত তার প্রচণ্ড দেশপ্রেমবোধ ‘তোমার দেশ তোমার জন্য কী করতে পারবে তা জিজ্ঞাসা করো না। তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তুমি দেশের জন্য কী করবে।’ চন্দ্রশেখর আর শিবসেনা পার্টি প্রধান বাল থেকারে প্রতিপক্ষকে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যকালে এমন ভঙ্গিমা দেখাতেন।
মুষ্টিবদ্ধ হাত
পলিটিক্সের মাইক টাইসন। পলিটিক্সের প্রতিপক্ষকে যেন এ মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে মোকাবেলা করবেন। দুজন বড় বড় প্রধানমন্ত্রী এ ভঙ্গিমার ধারক। একজন ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী নরসিমাও রাও, অন্যজন দক্ষিণ আফিন্সকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। ভারতের জনতা পার্টির নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি মুষ্টিবদ্ধ হাত ব্যবহার করতেন।
প্রসারিত হাত
প্রচণ্ড চরমপন্থী উদ্ধৃত ভঙ্গিমা। উগ্র জাতীয়তাবাদের নীরব ভাষা এটি। এটি নাকি ক্ষমতার সার্বভৌমত্বের নির্দেশক। অনমনীয় আর অপ্রতিরোধ্য নেতৃত্ব। অ্যাডলফ হিটলারকে এমন ভঙ্গিমাতে দেখা যেত। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির মাঝে এ চরম নেতৃত্বের ভঙ্গিমা দেখা যায়। এদের দুজনই উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন, তাদের নেতৃত্ব ক্ষমতার একদম শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৪:৫৯