আমাদের দেয়ালগুলো ছিলো স্যাঁতসেঁতে নোনাধরা, সে দেয়ালে ছিলো সস্তা ডিসটেম্পার, বছর দুবছরে তার রঙ পালটানো হতো, কখনো টিয়া কালার, কখনো হলুদ আবার কখনো বা সাদা। তখনো আমাদের মেঝেতে টাইলস ওঠেনি, টয়লেটে ছিলোনা হ্যান্ড শাওয়ার, ছিলো না হাই কমোড। তখনো থাই গ্লাসের চল হয়নি, আমাদের চৌকাঠ ছিল কেরোসিন কাঠের, আমাদের পর্দাগুলো ঝুলতো নাইলনের টানটান দড়িতে। আমাদের বাসার সামনে বাগান বিলাস, পাতাবাহার কিংবা মানিপ্ল্যান্ট গাছ থাকতো, কখনো শখ করে এনে লাগানো হতো দুয়েকটা বিদেশী ফুলগাছ, বিচ্ছিন্ন ডালিয়া কিংবা চন্দ্রমল্লিকা। আমি শুধু আমার কথা বলছিনা, আমি লেট এইটিজ কিংবা আর্লি নাইন্টিজের সমস্ত মধ্যবিত্ত সমাজের কথা বলছি।
আমরা লম্বা তারের দুইপাশে কন্ডেন্সমিল্কের কৌটা লাগিয়ে হ্যালো হ্যালো বলে অপর পাড়ের কথা শুনতে পাওয়ার ভান করতাম, প্রতিবেশীর বাসার ল্যান্ডফোনে অন রিকোয়েস্টে আসা ফোন ধরতে যেতাম খানিকটা সংকুচিত হয়ে। তখনো ভিডিও গেমস এসে আমাদের বিকেলের দখল নেয়নি, আমরা বিকেলে খেলতাম গোল্লাছুট, বরফপানি কিংবা কুতকুত, ছুটির দিনের সকালে আমরা সকালের পড়া শেষ করে খেলতে বসতাম ‘ধনী হবার মজার খেলা’ অথবা লুডু কিংবা দাবা। শীতের দিনে খেলতাম ব্যাডমিন্টন, নাহ তখনো নেট কিংবা বাতি লাগিয়ে খেলা শুরু হয়নি, কেউ কাউকে হারানোর মনোবৃত্তি নিয়ে নয়, আমরা দুই সহ খেলোয়াড় মিলে চেষ্টা করতাম যত বেশী সময় সম্ভব কর্কটাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখতে।
আমাদের ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ছিলো না, আমরা রাতের পড়া শেষ করে আমাদের শাদাকালো টিভির এন্টেনাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু স্পষ্ট ছবি দেখার আশা করতাম; আলিফ লায়লা, রবিনহুড, নিউ এডভেঞ্চার অফ সিনবাদই ছিলো আমাদের একমাত্র ডিজিটাল বিনোদন। আমরা সেই পাঁচ মিনিটের বিজ্ঞাপন বিরতিতেই অসহ্যবোধ করতাম, ছোট মাথায় বুঝে উঠতে পারতাম না টিভিওয়ালারা এইরকম দুমুখো কেন- একবার বলে পেপসোডেন্ট টুথপেস্টই সেরা, আবার বলে কোলগেটের উপরে নাকি কোন টুথপেস্ট নাই!! আমরা গল্পের বই পড়তাম, টেক্সট বইয়ের ভেতরে রেখে, ডিমলাইট জ্বালিয়ে, টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে; তিনগোয়েন্দা, কিশোর ক্লাসিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই। ফেসবুকের নীল দুনিয়া তখনো আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে পারেনি!!
আমরা দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমাতাম, বিকেলের আযান পড়লে খেলতে বের হতাম, সন্ধ্যার আযানে বাসায় ফিরতাম। আমাদের মারামারি ছিলো অল্প একটু ধাক্কাধাক্কি আর বন্ধুর মায়ের কাছে বিচার দেয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ, আমরা মাঝে মাঝে রাগ করে আড়ি নিতাম, আবার দুয়েকদিনের মাঝেই তর্জনী বাঁকা করে মিলিয়ে মিল হয়ে যেতাম। কোথাও যাওয়ার আগে আমরা মাথায় অল্প একটু সরিষার তেল দিতাম, অল্প একটু পাউডার মেখে চুল আঁচড়ে নিতাম। প্রতিবেশী কিংবা দূরের আত্নীয়স্বজনের বিয়েতে আমরা গ্লাস সেট কিংবা ফিরনি সেট উপহার দিতাম, দই দিয়ে বিয়ের খাবারের ফিনিশিং দিয়ে কসকো সাবান দিয়ে হাত ধুইতাম। আমরা হাফ প্যান্টের সাথে শার্ট ইন করে পড়তাম, আমাদের পায়ে পায়ে ছিলো জাম্প কেডস্!!!
আমাদের বিকেলগুলো সোনালী ছিলো, খোলা মাঠে পড়ন্ত বিকেল আমাদের সামনে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে রাতে পরিণত হতো, আমাদের বিকেলগুলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিলো, মনে হতো চোখের পলকে যেন আরেকটা বিকেল শেষ হয়ে গেলো। আমরা সন্ধ্যার আযানে বাসায় যেতে যেতে পরের বিকেলের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, আজকের খাওয়া গোল্লাটা পরেরদিন শোধ করার প্ল্যান করতাম... রইলো না... রইলো না... সেইযে আমার নানা রঙের দিনগুলি...
২০১৫ এর শেষের দিকে তোলা কক্সবাজারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪৮