সকাল সাড়ে সাতটা। এতো সকালে সচরাচর জহিরের ঘুম ভাঙ্গে না। জানালার পাশে ঘুমানোর বন্দোবস্ত থাকায় রোদের তীব্র স্পর্শে জহিরের ঘুম আজ নিয়ম ভঙ্গ করে একটু আগেভাগেই বিঘ্ন হয়।
শীতের সকাল তবু এতো রোদ কেন আজ?
আজ কি পৃথিবী সূর্যের সবচাইতে কাছে পৌঁছে গেছে?
কি বার আজকে?
কয় তারিখ?
জহিরের নতুন রুমে কোনো ক্যালেন্ডার নেই।ক্যালেন্ডার নেই বলে এর আগে কোনদিন জহিরের কৌতুহলবশত আফসোস হয়নি। প্রায় সবকিছু সম্পর্কে জহিরের চূড়ান্ত প্রকারের উদাসীনতা কাজ করে। অবশ্য এই চূড়ান্ত উদাসীনতার মাত্রা কাটিয়ে একসময় তার মধ্যে প্রচণ্ড কৌতূহলের জন্ম নেয়। এই সময়টায় জহিরের নিজ চরিত্রকে শীতের কুয়াশার মতন মনে হয়। হটাত হটাত নিজেকে বুঝতে না পারাটা মানুষের চিরন্তন দুঃখগুলোর মধ্যে একটি। এই সময় নিজের সম্পর্কে ভেতরের অস্থিরতা জহিরও ভালোভাবে টের পায়।
তবে আজ জহিরের কৌতূহল বাড়লেও অস্থিরতাটুকু নেই। ব্যপারটা তার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হতে লাগলো। ক্যালন্ডার নেই কারণ নতুন বাসায় উঠেছে ওরা। তাছাড়া দেয়াল কেলেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা এখন শেষ হয়ে গেছে। এখন সবাই মোবাইল ব্যবহার করে।
শূন্য দেয়ালে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে সে বালিশের নিচে সময় জানার জন্য হাতড়ে নিজের মোবাইল খুঁজতে লাগলো।
সকাল প্রায় আটটা বাজে। এরই মধ্যে আম্মা রোজ সকালের নাস্তা নিয়ে কিছুক্ষণ আয়োজন করে সোরগোল তুলেন। আফিসে যাওয়ার আগে ছোট বোনের সাথে অহেতুক ঝগড়া করাও তার প্রতিদিনের অভ্যাসের মধ্যে পরে। জহির খাটের উপরে আয়েশি ভঙ্গীতে সেই দৃশ্য দেখার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে থাকলো। আজ সকাল নয়টার আগেই মা মেয়ের ঝগড়া লেগে গেলো। তাদের এই ঝগড়ায় আনন্দ আছে তাই জহির বিষয়টা উপভোগ করে। মা মেয়ের ঝগড়া সারাদিনই চলতে থাকে।
সাড়ে নটা বাজতেই আম্মা অফিসে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, আজ দশটার আগে বাসায় ফিরবি। প্রতিদিন রাত করে বাড়ি ফেরা কোনো ভদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ের কাজ না। তোমার বাবা থাকলে এমন করতে পারতে না।
ছেলে মেয়েগুলোকে মানুষ করতে পারলেন না এমন আক্ষেপ করতে করতে তিনি অফিসে যান। প্রায়ই তিনি এই কথা বলেন।
জহিরের ছোট বোন তৃষ্ণা এখন অন্য রুমে তার নিজের মতন ব্যস্ত। সে ইদানীং ছবি আকে। ছবি আকায় তার প্রিয় বিষয় মানুষ। জহিরদের পরিবার রক্ষণশীল তাই মানুষ আকার কারণে বোনকে নানাসময় নানা কথা শুনতে হয়। জহির অবশ্য এই ব্যাপারে বোনের পক্ষে। জহির বুঝেনা, যে মূর্তি কিংবা মানুষের ছবিকে আমি ঈশ্বরের সাথে তুলনা করিনা সেই মূর্তি আর মানুষের ছবিতে ধর্ম নাশ কিভাবে সম্ভব?
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাসা থেকে বেরিয়েই মনে পড়লো আজকেও শেভ করা হয়নি তার। অন্যদিন হলে নিজের প্রতি এই মূহুর্তে খুব বিরক্ত লাগতো জহিরের। জহিরের ইদানিং মনে হয় দাড়িতে তার বয়স বেশি লাগে। অবশ্য তার এমন মনে হওয়ার পেছনে আম্মা দায়ী।
ছেলের দাড়ি আর চুল একটু বড় দেখতে আম্মার একদম ভালো লাগেনা। আর জহিরের প্রতিদিন শেভ করতে ভালো লাগেনা।
জহিরের সবকিছুই এলোমেলো। কিন্তু একটা জিনিস এলোমেলো না সেটা হচ্ছে চিন্তা। অন্য সবার সবকিছু সাজানো হলেও ওদের চিন্তাগুলো জহিরের কাছে এলোমেলো মনে হয়। অবশ্য সবার বলতে অনেকের কথা বলছে সে। ওদের চিন্তাগুলো কোথায় গিয়ে যেন আটকে যায়। ওদের আগ্রহগুলো যেন খুব বেশি গতানুগতিক।
বাসা থেকে বেরিয়ে ভার্সিটির রাস্তায় নামতে নামতে জহিরের গরম লাগতে শুরু করলো। সোয়েটার থেকে ধোয়া উঠা সিদ্ধ গন্ধ যেন তার নাক স্পর্শ করতে চায়।
এই প্রথম বিরক্ত হয়ে সে নিজেকে আবার প্রশ্ন করলো, আজ কি পৃথিবী সূর্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে?
হাটতে হাটতে একসময় জহির ভার্সিটির কলাভবনের সামনে হাজির হয়। কলাভবনের দিকটায় এই বন্ধের সময় সে কেন আসলো জহির তা ঠিক জানেনা।
শুভ জন্মদিন জহির ভাই!
কে যেন বুঝতে না দিয়েই তাঁকে পেছন পেছন অনুসরণ করছিলো এতক্ষণ। পেছন ফিরে তাকিয়ে জহির দেখলও ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই কমল হাসি হাসি মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
শুভ জন্মদিন! ভাই।
কিছু বুঝতে না উঠার আগেই জহির বলল, ধন্যবাদ।
প্রথমবারের মতন সে বুঝতে পারলো আজ তার জন্মদিন।
কি অবস্থারে তোর কমল? তোদের পরীক্ষা কেমন চলছে?
জী ভাই, ভালো।
এখানে কি করছিস?
না ভাই! ভাবলাম ঘুরে আসি। যদি কোনো নোটিশ থাকে এইজন্য।
আচ্ছা! ঠিক আছে আমি একটু লাইব্রেরীর সামনে যাবো তুই এখানে থাক তাইলে পরে দেখা হবে।
ঠিক আছে ভাই, জন্মদিনের খাওয়া কিন্তু পাওনা রইলো।
হা হা পরীক্ষা ভালো মতন দে জন্মদিন না থাকলেও খাওয়াবো।
কমলকে পিছে ফেলে জহির লাইব্রেরীর সামনে হাটতে থাকলো। কমলের সাথে জহিরের কিভাবে পরিচয় হয়েছিলো এটা খুব অদ্ভুত মনে হল জহিরের কাছে।
আসলে পৃথিবীতে মানুষে মানুষে সব সম্পর্কই অদ্ভুত এবং বিচিত্র। তাই সম্পর্কগুলোর কথা ভাবতে গেলে অবাক হতেই হয়।
লাইব্রেরীর সামনে আসতে আসতে অনেক ছোট ভাই, বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো জহিরের। সবাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভুলল না। প্রত্যেক শুভেচ্ছার বিনিময়ে জহির ধন্যবাদ দিয়ে যবনিকা টানে। এই ধন্যবাদের মধ্যে উদাসীনতা থাকে কিন্তু তার এই ধরনের উদাসীনতায় অন্যরা তেমন অবাক হয়না। এই উদাসীনতাই জহিরের চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য।
লাইব্রেরীর সামনে এসে জহির মজিদুলকে ফোন দেয়। মজিদ এই সময়টায় লাইব্রেরীতে সময় কাটায়। মজিদ ওর ডিপার্টমেন্টের সবচাইতে শান্ত এবং ভদ্র ছেলে। অনার্স পর্যন্ত মজিদ তাঁকে পড়ালেখার বিষয়ে অনেক সাহায্য করেছে। ফোন দিয়ে আজ মজিদকে পাওয়া গেলনা।
যাক ভালোই হয়েছে আজ একাডেমিক বিষয়ে কথা বলতে ভালোও লাগবেনা।
বাজান! কয়টা টেকা দিবা?
জহির পাচটা টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিলো বৃদ্ধা ভিক্ষুককে।
বৃদ্ধা টাকা পেয়ে বৃথা সময় ব্যয় না করে বিদায় নিলো।অবশ্য যাওয়ার সময় দোয়া করতে ভুলল না।
জহিরের মতন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রীর ভাগ্য নির্ভর করে এই ভিখারিদের দোয়া আর বদদোয়ার উপর।
আর ওদের সময় কাটে শিক্ষকদের সমালোচনা করে।অপছন্দের শিক্ষককে গাল দেয়াটা যদিও জহিরের অস্বাভাবিক মনে হয়না কিন্তু অনুচিত।
মাঝে মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে ওদের অনেকই বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিক্ষুক বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভিক্ষুকের প্রতি সহানুভূতি বেশি কাজ করে। দান-খায়রাত থেকে শুরু করে প্রতি মাসেই ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে এখানকার ছাত্রছাত্রীরা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখন রাস্তায় রাস্তায় বিশাল বিশাল বক্স ফেলে রাখা হয়েছে। এইসব বক্সে শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের কাজ চলছে।
জহির ভাইয়া কেমন আছেন?
আরে! মিতা কেমন আছো তুমি?
আর বলবেন না ভাইয়া পরীক্ষা খুব খারাপ হইছে।
কেন পরীক্ষা খারাপ হওয়ার কারণ কি?
স্যার এত কঠিন প্রশ্ন করসে যে একটা প্রশ্ন কমন পড়ে নাই।
ওহ! ব্যাপার না পরের পরীক্ষাগুলো ভালো মতো দেয়ার চেষ্টা করো।
আচ্ছা ভাইয়া ঠিক আছে আজ তাইলে যাই।
ঠিক আছে ভাইয়া! শুভ জন্মদিন।
ধন্যবাদ মিতা।
মিতা ওর ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র। মেয়েটা দেখতে সুন্দর। মিতা আজ কপালে ছোট টিপ পড়েছে। মিতার কথা ভাবলে জহিরের মুখে মাঝে মধ্যেই অহেতুক হাসির রেখা ফুটে উঠে। এই হাসি অবশ্য সবাই টের পায়না। জহির মাঝে মাঝেই ভাবে মিতার কথা।
মিতা চলে গেলে জহির একলা একলা বসে থাকলো অনেকক্ষণ। একলা বসে থাকতে ভালো লাগছে। সে যেখানে বসে আছে এই যায়গার নাম বড়শি চত্বর। এখানে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের দেখতে ভালো লাগছে তার। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ওরা অন্য আরেকজনকে শুভ জন্মদিন বলবে। ওরা জন্মদিন নিয়ে চিন্তা করে জন্ম নিয়ে অতটা চিন্তিত নয়।
জহির ভাবে, এই পৃথিবীতে জহির মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার আগে কি ছিল? সে কি কেবল তার পিতা-মাতার বংশরক্ষার সাক্ষর বহন করে এই পৃথিবীতে এসেছে । নাকি এর আগেও সে এই মহাবিশ্বে ছিল? জন্ম কি একটি অবস্থা থেকে অন্য অবস্থার রূপান্তর? তাহলে মৃত্যুকে কি বলা যায়? এর আগেও কি সে মারা গিয়েছিলো? মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্য?
এইসব ভাবতে ভাবতেই কাছের বন্ধুরা সবাই চলে আসলো। তারা সবাই এখন তাঁকে তার অনাগ্রহের বিষয়টি করতে বাধ্য করবে। পৃথিবীতে অনেক অনাগ্রহের বিষয় অগ্রহের মতো করে করতে হয়। সম্ভবত পৃথিবী নয় সম্ভবত এটা মহাবিশ্বের অন্যতম গুরুত্বহীন অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। জহির হয়তো মানুষ হয়ে জন্ম নিতেই চায়নি।
বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে রাত দশটা বেজে গেলো ।
আশেপাশের চারিদিকে ঘন কুয়াশা। রাস্তায় পাশে বস্তির মানুষেরা আগুন জ্বেলেছে। জহিরের শীত করতে লাগলো। এক সোয়েটারে এই শীত দূর হওয়ার নয়। একবার ভাবল আগুনের পাশে কিছুক্ষণ বসা যাক কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।
এই একা রাস্তায় জহিরের একা লাগতে শুরু করে। তবু আমাদের কুয়াশা কাটিয়ে হেটে চলতে হয়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। রাস্তার পাশের বস্তির মানুষদের জ্বালিয়ে রাখা আগুনে পোকা গুলো নৃত্য করছে। রাত যত বাড়ে শহরের রাস্তা তত শূন্য হতে থাকে। আচ্ছা! পোকাগুলো আগুনের কাছে কেন যায়? ওদের কি বাচতে ইচ্ছা করেনা?
ওই ভাইজানরে একটু জায়গা দে তোরা, ভাইজান বসেন।
বস্তির লোকদের মধ্যে পরিচিত কণ্ঠের অনুকরণে অনুরোধ করলো একজন।
নাহ! আমি বসবোনা আপনারা বসেন।
আচ্ছা আপনারা জানেন এই আগুনে পোকাগুলো মারা যেতে চায়?
ওরা কি মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চায়?
ওরা কি একটা নিখুঁত সময়ের জন্য বারবার এখানে আসে?
আমরা যেটাকে বলি জন্মের দিন?
লোকগুলো কিছুই বুঝতে পারলোনা। ওরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো কেবল কিছুক্ষণ।
খুক খুক করে কাশতে কাশতে এতক্ষণ অদৃশ্য লুকিয়ে থাকা এক বৃদ্ধ হটাত বলল, এতো কিছু তো আমরা জানিনা বাজান তয় আজকা কিন্তু পৃথিবীটা সূর্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছাইব। এই সূর্যের আলোয় কত মাইনসে মইরা গেলে তারপর অল্প কিছু মানুষে জন্ম নিবো। এই দিনটায় জন্ম নিলে অনেক বাধা বিঘ্ন আইলেও মানুষটা ঠিকই টিক্যা যায়। এই দিনে জন্ম নেয়া মানুষগুলা রাইত অইলে পরের দিনের সূর্যের কতা কয়। ওরা তো সূর্যের তেজ দেখছে খুব কাছ থাইকা।
কথা শেষে নিজের পলেথিনের ঘরে ঢুকে পড়লো বৃদ্ধ।
জহির ভাবল, প্রস্থানের সময় লোকটি কি হাসছিলেন?
বৃদ্ধের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল জহির।
তার মুখে অসংখ্য ক্ষত। অন্যসময়ে হয়তো জহিরের খুব অভক্তি লাগতো এমন চেহারা দেখলে।
কিন্তু এই লোকটা জহিরের উদাসীন চরিত্রে মানব জন্মের সময়ের প্রতি যে অদ্ভুত কৌতূহলের জন্ম দিলো তারপর আবার কোনদিন এই অপ্রিয় মুখটি খুঁজে পেতে জহিরদের জীবনের কতটা পথ হাটতে হয় ওরা জানেনা। জহির কি সত্যিই সূর্যকে খুব কাছ থেকে দেখেছে?
এইসব ভাবতে ভাবতে জহির বাসায় খুব কাছে পৌঁছে গেলো। চারিদিকে এখন ঘন কুয়াশা। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো জহির। সে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে। নগরীর সব দেয়াল কুয়াশায় ঢাকা। জহির ভাবছে এই কুয়াশা ভেদ করে কোথায় যায় মানুষ? কোথায় গেলো ওরা? কোথায় গিয়ে থামে মানুষের জীবন











