আমি কিন্তু কাউকে হাসাতে পারিনা । এই রেয়ার গুণ আমার নাই ।অবশ্য যখন কোন রোগী আমার কাছে আসে হাসি হাসি মুখে আমি উপদেশ গুলো দিতে থাকি ।
প্রেগনেন্ট মহিলাদের কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয় । এরকম এক রোগী আমার কাছে এল ।উপদেশের মধ্যে একটা ছিল , প্রথম তিন মাস আর শেষ দেড় মাস সহবাস নিষেধ । রোগী মন দিয়ে শুনল । তারপর বলল , মেডাম আমি পুকুরে যেতে পারবোনা ?
>> বেকুব নি কোনো ? আমি কি উপদেশ দিলাম আর সে কি প্রশ্ন করল । আমি বললাম , “ আমি বলেছি স্বামী সহবাস নিষেধ । পুকুরে যাওয়া নিষেধ এটা তো বলিনি । পুকুরে গেলে যাবা সমস্যা কী ?
ভুলবুঝাবুঝির চুড়ান্ত এই অবস্থায় আমার এসিস্টেন্ট পান্না যে আঞ্চলিক বাংলা থেকে শুদ্ধবাংলায় তরজমা করে । সে বিজ্ঞ ভাবে হাসতে হাসতে বলল , স্বামী স্ত্রী মেলামেশা মানেই পুকুরে যাওয়া ।
>>আচ্ছা ! তাই নাকি !
আমার বেকুব অবস্থা দেখে পান্না হাসতে লাগলো । না হাসলে তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে পান্না ।
পরবর্তী রোগীর অবস্থান উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে । এখানে প্রতিটি রোগীর অনেকগুলো বাচ্চা । এক মহিলা রোগীর চারটা বাচ্চা আছে । “ যা নিয়েছেন , নিয়েছেন , আর তো নেয়ার দরকার নাই । দরকার আছে ?
>না
>>তাইলে জন্মনিয়ন্ত্রণের কি কোন পদ্ধতি নিছেন নি ?
রোগী উদাশ গলায় বলল , না স্বামীর সাথে আর তেমন কথা বার্তা হয়না ।
টং করে উঠল মাথা । কথা বার্তা হয়না এই কথাটার অন্য অর্থ থাকতে পারে ।
আমি বললাম , ক্যান স্বামী বাড়ি থাকেনা ? কথা বার্তা হয়না কেন ?
বাড়িতেই থাকে ।
তাও কথা হয়না ? শুন আপনি যদি বাচ্চা হবার ভয়ে জামাই এর লগে কথা না কন তাহলে জামাই তো অন্য মহিলার লগে কাথা বার্তা শুরু করবে । সেটা তো আরেক ভেজাল । তারচেয়ে স্বামী বা স্ত্রী যে কোন একজন জন্মনিয়ন্ত্রনের পদ্ধতি নেন , তারপর কথা বার্তা বলেন সেটাই ভাল , নাকি বলেন ?
প্যাসেন্ট কে আরেকটু কাঊন্সেলিং এর পর উনি সরকার থেকে ফ্রি সাপ্লাইকৃত পদ্ধতি নেন সে দিন ই ।
আরেকটি ঘটনা কি বলব ? আচ্ছা বলি , গর্ভবতী রোগী বললেন , আপা আমার শরীর চুলকায় ।আমি ভেবে ফেললাম , যা ভাবা উচিত । কিকি কারণে একজন গর্ভবতী নারীর শরীর চুলকাতে পারে । খোঁস পাঁচড়া মানে স্কেবিসের কোন লক্ষণ আছে কিনা দেখলাম । অবট্রেটিক কোলেস্টেসিস আছে কিনা বুঝার চেষ্টা করলাম । নাকি অন্য কোন স্কিন ডিজিজ । নাহ ! কিছুই নাই । উপদেশ দিলাম , শীতকাল স্কীন ড্রাইনেসের জন্য চুলকাতে পারে । ভ্যাজলিন লোসন লাগান , ড্রাইনেস কমে যাবে । চুলকানি বন্ধ হবে ।
আমার অনুবাদ কারী পান্না আমার চিকিৎসা দেয়া দেখে এই চিকিৎসা থেকে রোগীকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে আসল । আমাকে বলল , মেডাম এই শরীর সেই শরীর না ।
টং টং টং । থাক থাক আর কইতে হবেনা । বুঝছি যা বুঝার । ভেজাইনাল ক্যান্ডিডিয়াস হয়েছে । যা প্রেগনেন্সীতে কমন । রোগীকে বললাম , আহারে ঠিক মত শব্দ ব্যবহার করবেন না ?
রোগী চলে যাবার পর পান্না বলল ,
ম্যাডাম ভেজলিন লোসন মাখতে থাকলে তার অসুখটা কোন দিকে যেত মেডাম ? পান্না আবার হাসতে লাগলো । পান্না , না হাসলেই তোমাকে সুন্দর লাগে ।
তো যাই হোক , আমরা গ্রামের ডাক্তার । গ্রামের আসল পরিস্থিতি কি সরকারি ডাক্তার হিসেবে গ্রামে না থাকলে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না ।
আমার হাসপাতালে কক্ষে এসে হাসপাতালের এফ , ডাব্লিও, ভি বলল , ম্যাডাম জানেন নি , আমাদের সখিনা গ্রামের এক রোগীকে নরমাল ডেলিভারী করাবে কন্টট্রাক নিল ।
আমি ভাবলাম , ভাল তো , তারপর কি ?
তারপরের ঘটনা শুনে মাথা ঘুরানী দিল । সে যে রোগীর কন্ট্রাক নিল সে হল আগে দুইবার সিজার হওয়া রোগী ।
ওহ মাই আল্লাহ ! এটা তো সিজার করাই ইন্ডিকেশন । অবশ্যই সিজার করতে হবে ।নরমালে করাতে গেলে অবশ্যই মরবে যদিনা আল্লাহ বিশেষ বিবেচনায় না বাঁচায় ।
তাই মিরাকল কিছু ঘটল কিনা শুনার জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
কি হল জরায়ু ফেটে মারা গেল না কি বেঁচে গেল ।
>রোগীটা মারা গেল । ডেলিভারীর পরপর ই । সুন্দর একটা ছেলে সন্তান জন্ম দিয়ে ।
অহ ! আচ্ছা ডাক্তারি করা এত সোজা হইলে কি জন্য এত বছর ধরে পড়তেই আছি আর পড়তেই আছি । এখনো ব্যাগের মধ্যে একটা ভারী বই আছে । কিন্তু সেই কন্ট্রাক্ট ওয়ালীর কি হল ? প্রিভিয়াস টু সিজারের রোগীকে নরমাল ডেলিভারী করাতে যায় । কেউ তারে ধরে নাই ?
>না
কি বিচিত্র ব্যপার । ডাক্তারদের তো পান থেকে চুন খসলেই জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে জাতীয় ভিলেন হিসেবে নাম উঠে যায় । এর কিছুই হইলোনা ?
>মেডাম , কেন বড় স্যারেরা দেখেনা , সে যে এত বড় বড় করে নামের আগে ডাক্তার লাগিয়ে বিশাল চেম্বার দিছে ? আমি একদিন তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তার চেম্বারের সাইন বোর্ড দেখতে দেখতে গাছের লগে এক ধাক্কা খাইছি । ডাক্তার সখিনা বেগম ।নামের সাথে কত এ,বি,সি,ডি ওয়ালা ডিগ্রী । আমি কইলাম এত বড় ডাক্তার আবার কোত্থেকে আইলো । পরে বুঝলাম এইটা আমাদের সখিনা । এগুলি দেখার কেউ নাই ?
কি জানি , কেন সবাই টিনের চশমা পরে আছে । কেউ কিছু দেখেনা । সবাই তো বাংলাদেশের বড় বড় ডাক্তার । ডাক্তারি করাটাই সবচেয়ে সহজ । তার এক নমুনা হল , এক মা এসেছে দেখাতে । তার সাথে তার বাচ্চাটাকে ও দেখাবে । সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের চেম্বারে একই সাথে অনেক রোগী চেম্বারে ঢুকে পড়ে । পেসেন্টদের প্রাইভেসী কম । তো বাচ্চার মা দেখাচ্ছে বাচ্চার গায়ে কিছু স্কিন ডিজিজ হয়েছে ।
রোগীর অসুখ গুলো মন দিয়ে দেখছিলাম । আরেকজন রোগী ও বাচ্চার সমস্যা টা মন দিয়ে দেখল ।
আমি কিছু বলার আগেই সে মাকে বলতে শুরু করল , এগো নিম পাতা আর কেইচ্ছা ( একটা কিলবিলে প্রাণী) বেটে লাগাও নাই কেন ? ভাল হয়ে যাইতো এক রাতের মধ্যে ।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম , দেখি আমাকে দেখতে দেন ...
রোগীনী উতসাহে কোন প্রকার ভাটা পড়ল না , সে আবার বলল , নিম পাতা আর কেইচ্ছা ( এইটা কিন্তু একটা কিলবিলে প্রাণী ) বেটে লাগাইলে ভাল হয়ে যায় আফা ।
এবার আর বিরক্ত হলাম না , বেশ আগ্রহ নিয়ে সিরিয়াসলি বললাম , আচ্ছা , ঠিক আছে আপনি আমার পাশে টেবিল চেয়ার নিয়া আরেকটা চেম্বার খুলে বসে পড়েন ।
রোগীনি হাসছে , আর যাবতীয় রোগী যারা দেখাতে এসেছে তারাও হাহা করে হাসছে ।
আমার আরেক রোগীর হাসবেন্ড অবশ্য ঠিক করলেন , তিনি অবশ্যই একটা চেম্বার দিবেন । “ মেডাম আমি রানুকে নিয়ে ( ওয়াইফের নাম ) ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে দৌড়াতে যে জ্ঞান হাসিল করেছি এটা দিয়ে জনকল্যাণে একটা চেম্বার খুলব ভাবছি । “
আমি বিজ্ঞ মতামত প্রকাশ করার আগেই বেচারার ওয়াইফ বলল , ও বাংলাদেশের জনসংখ্যা এমনিতেই বেশি । কিছু কমানোর প্ল্যান থাকলে চেম্বার খুলে বসে পড় , সমস্যা নাই হাহাহা ।
হাহাহা ।
একদিন ফোন এল , হ্যালো ম্যাডাম , আমি বিলকিস । আমি আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম । আপনি কি শীতের পিঠা পছন্দ করেন ?
>নাহ ! আমি শীতের মিষ্টি পিঠা পছন্দ করিনা
>>ও তাইলে জিজ্ঞেস করছি এইটা তো ভালই হয়েছে । নাহলে তো মিষ্টি পিঠা বানিয়ে নিয়ে আসতাম ।
হুম , আমি ঝাল পিঠা পছন্দ করি । শীত যাক , তুমি তখন ঝাল টাইপের কিছু নিয়ে এস ।
রোগী চিন্তায় পড়ে গেল । ঝাল পিঠা !!!
যাক , কিছুদিন থামানো গেল । যতদূর জানি আমাদের এই অঞ্চলে শীতের বেশির ভাগ পিঠাই মিষ্টি । ঝাল পিঠার চিন্তায় পড়েছে এটা ওর ট্রিটমেন্ট । আমাকে কিছু না খাওয়ালে তার অসুখ ভাল হবেনা । কিন্তু শীতের মধ্যে পিঠা বানানোর হাত থেকে বাঁচুক । সে ভাল হয়ে উঠুক ।
একদিন রাত দেড়টা পর্যন্ত রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে প্যাসেন্ট কে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিলাম ৩ জন ডাক্তার আর হাসপাতালের যাবতীয় স্টাফ মিলে সেই সংগে গভীর রাতে এসেছিলেন ব্লাড ডোনার ( ব্লাড ডোনাররাই প্রকৃত হিরো ) ।
পেসেন্ট সেটেল হবার পর রোগীর ভাইকে বললাম , আপনার রোগীযে খারাপ বুঝতে তো পারছেন । যে ভাবে চিকিৎসা পাবার দরকার সব করা হয়েছে । এই রাতে বড় হাসপাতালে রেফার্ড করা হলনা , কারণ রাতে যেতে যেতে আরো খারাপ হবে । কিন্তু রাতে ধরেন খারাপ হয়ে মরে যেতে পারে ,অনেক কিছুই তো আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাহিরে । এখন আপনারা কি চান অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে ?
> না
তাহলে রোগী যে খারাপ এইটা জেনেছেন এই বিষয়ে একটা লিখিত দিয়ে রাখেন ।
আপনারাতো দেখলেন আমরা আমাদের পক্ষে যা যা সম্ভব সব করেছি । কিন্তু যারা এখানে উপস্থিত নাই তারা এসে হাসপাতাল ভাংচুর করলে আমরা বিপদে পড়ব । বলবে যে আমরা কিছুই করিনাই । রোগী খারাপ আমাদের বলেন নাই কেন , তাহলে আমরা মেডিকেল কলেজ নিতাম , ঢাকায় নিতাম । রোগীর ভাই আমাকে কথা খুঁজে দিল ,
> হু বিদেশ নিতাম।
> হ্যাঁ , বলতে পারে ঢাকা নিতাম , বিদেশ নিতাম । ( কথা জোগাড় করে দেবার জন্য ধন্যবাদ )
>আচ্ছা সাইন দিচ্ছি ।
আল্লাহর রহমতে রোগী ভাল হয়ে উঠেছিল ।এক প্রায় মরে যাওয়া ডি আই সি র রোগী যখন বেঁচে উঠে আর হেসে উঠে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সে অনুভূতী বুঝানো যাবেনা । তাই এঘটনাটা ঠিক মত ফুটিয়ে তোলা গেলনা । এটা শুধু মাত্র সৃষ্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা , যে এ হাসি সৃষ্টির জন্য নিজেও একজন শিল্পী ।
মূল পোস্ট আর লম্বা করলাম না ।
হেই কার কার মন খারাপ ছিল , একটু ভাল লাগছে আমি শিওর । আমার নিজেরই তো মন খারাপ । মন কেন খারাপ এইটা জিগায়া লাভ নাই ,এইটা এক জাতীয় ব্যাধী ।
পোস্ট ডেডিকেট করা হল , একজন ২৩ বছর বয়সী শ্যাম বরণ কন্যাকে যার নাম পান্না , আমার ছায়া সংগী । যার কাছে আমি এক বিস্ময়কর নারী , যিনি বাসে , সিএনজিতে ঘুমিয়ে পড়ে ঠিকাছে কিন্তু রিকশায় কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ে ?
( আমার বক্তব্য ঃআমার হাসপাতাল বাসা থেকে ১৮ কিমি দূরে দূরে , অবরোধের কারণে এই রাস্তা রিকশায় যেতে হয় । এতক্ষণ জেগে থেকে লাভ কী । )