ব্লগার শায়মা আপুনীর রাগ বিষয়ক পোস্ট টি পড়লাম , তারপর আত্ম সমালোচনা করতে বসলাম । রাগ সংগীত শোনার মতই বিরক্তিকর এই রাগ বিষয়ক পোস্ট আগেই বলেদিলাম , রেগে গিয়ে আমাকে কেউ বকা দিবেন না যেন ।
আমার শিশুকালের কথা । আমি একটা বই পড়ছিলাম । তার একটা লাইন হল , “ অমুক রাশির মেয়েরা উগ্র মেজাজের । “ উগ্র মেজাজ শব্দটির মানে আমি বুঝতে না পেরে আম্মাকে গিয়ে বললাম , আম্মা আম্মা , উগ্র মেজাজ কি ?
আম্মা বললেন , “আমার মেজাজকে উগ্র মেজাজ বলে । “
সম্ভবত এই উত্তরটা দিতে আম্মার খারাপ লেগেছিল । নিজের মেজাজকে উগ্র মেজাজ বলে স্বীকার করে নেয়াটা কষ্ট কর তাই না? আপাতদৃষ্টিতে ভদ্র কিন্তু লেজবিশিষ্ট একেবারেই পিঠাপিঠি চারটা সন্তান কে একা হাতে মানুষ করা কতটা কঠিন ছিল আজ বুঝি । আব্বা চাকরির কারণে অন্য জায়গায় থাকতেন
বড়টা ( আমি ) সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে , খুব ভাল কথা । কিন্তু সব পাঠ্যবই এর নীচে গল্পের বই । লেপের নীচে , তোষকের নীচে , বালিশের ভিতর গল্পের বই আর গল্পের বই । আসল পড়ার আর সময় নাই । মেঝ জন অবশ্য লক্ষি ।
ছোট দুজন পুরা বিচ্ছু । ভিডিও গেমসের দোকান থেকে তাদের উদ্ধার করে আনতে হয় । ছলে , বলে , কৌশলে , রেগে গিয়ে , মেরে ধরে লাইনে রাখতে গিয়ে আম্মাকে হতে হয়েছে উগ্র মেজাজের ।
“ আমার মেজাজকে উগ্র মেজাজ বলে “ এই কথাটার সাথের দীর্ঘশ্বাস টুকু বুঝার ক্ষমতা ছোট্ট আমার ছিলনা ।
তারপর একটু বড় হবার পর একটা ইংরেজি মুভি দেখছিলাম , অনেকদিন আগে তো , নাম মনে নেই মুভির । এক মা তার ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে গ্রামে একলা থাকেন । সারাদিন ক্ষেতে খামারে কাজ করেন । একদিন তার কিশোর ছেলেটি বিড়ি খেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে ।
মা বললেন , বাবা আমি দুঃখিত , তোমাকে শাস্তি দিতে আমারও খারাপ লাগছে । কিন্তু তুমি একটা অপরাধ করে ফেলেছো । বেতের বাড়ি এর শাস্তি ।
কিশোর ছলছল চোখে তার পিঠ পেতে দেয় । তার পর সপাং সপাং করে বেতের বাড়ি পড়তে থাকে পিঠে ।
যেই সব মা বাবা একেবারেই রাগেনা , এমন একটা গল্প বলি এবার ।
এই গল্প অনেকের জানা । তবুও প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আবার বলি । এক ডাকাতির আসামিকে ১০ বছরের জেল দিলেন বিচারক । তারপর জিজ্ঞেস করলেন , তার কিছু বলার আছে কিনা ।
আসামি বলল , আমার অনুরোধ আমার বাবা মাকেও জেলে পাঠিয়ে দিন ।
বিচারকের বললেন , কেন ??
আসামি জবাব দিল , আমি যখন ছোট ছিলাম , তখন স্কুলের একজনের পেন্সিল চুরি করেছিলাম । আমার বাবা মা এ নিয়ে আমাকে কিছু বলেন নি ।
পরে একটা পেন চুরি করলাম , তখন ও তারা চুপ ছিলেন । তখন আমি স্কুল থেকে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে জিনিস চুরি করতে থাকলাম । শেষপর্যন্ত এটি অভ্যাসে পরিণত হল । বাবা মা সব ই জানতেন , কিন্তু এ বিষয়ে তারা কখনো কিছু বলেননি । “আমার সংগে যদি কারো জেলে যাওয়া উচিত মনে হয় তবে তাদেরই যাওয়া উচিত । “ একেবারে না রেগে যাওয়া কি সবসময় ভাল? নাহ!
আবারো আমার ছোট বেলার কথা । সেই সময় আমি এক মহিলাকে নিয়ে খুব ভাবতাম । তাঁর অত্যন্ত ব্যাক্তিত্বময়ী চেহারা । কিন্তু কোনদিন হাসতে দেখিনি । জানতাম তিনি খুব রাগী । তিনি আমাদের ভাইসপ্রিন্সিপল ম্যাডাম । আমি ভাবতাম , ‘ কেন ম্যাডাম এতটা রাগী ।
আমি কি রাগী ?
ডাক্তারি কিন্তু একটা টিম ওয়ার্কের ব্যাপার ।
একজন ভাল সার্জন ভাল অপারেশন করলেন , ( সিনেমার যেমন দেখায় ডাঃ ওটি থেকে বের হয়ে এসে বলে অপারেশন সাকসেসফুল )
কিন্তু পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার ভাল না হলে রোগী মরে যাওয়া স্বাভাবিক । অর্থাৎ ভাল সিস্টার , ব্রাদার এমন কি আয়াকেও দক্ষ হতে হয় ।
আমি গ্রামের একটি হাসপাতালে কাজ করতে আসি , তখন এদের কাছ থেকে স্কয়ার বা এপোলো হাসপাতালের দক্ষতা আশা অবশ্যই করবোনা । কিন্তু তাদের অদক্ষতা এমন পর্যায়ের আমার প্রায় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা ।
তারসাথে একটা খারাপ ব্যাপার যুক্ত হয়েছিল যে তারা আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে । দশবার বলেও অর্ডার ফলো করানো যায়না । কী আজব !!
সারাক্ষণ খেয়ালে না রাখলে এরা কি যে করে ফেলবে এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় । তাদের ভুল রোগীদের জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবে । আমার কোকিল কণ্ঠ কাকের কণ্ঠে বিবর্তিত হয়ে যাওয়ার এটা একটা ইতিহাস ।
আমি ইচ্ছে করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছি যেন তারা ভাবে আপা অত্যন্ত রাগী । এই কাজ ঠিক মত না করলে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে ।
আমাদের হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তারও এমন হয়ে গেছেন । রাগী লোকদের কেউ দেখতে পারেনা । সুতরাং কর্মচারীরা আমাদের পছন্দ করবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই ।
কিন্তু দুনিয়া টা বড় আজব জায়গা । এত শাসনের ভিড়ে কোন দিক দিয়ে স্নেহ প্রকাশ পায় আমি জানিনা । কেন তাদের চোখে আমার জন্য মায়া দেখি ? আমি কি ভাল না তারা ভাল ?
আরেকবার এক গ্রাম্য ডাক্তার একজন রোগীকে আমার দেয়া টেস্টের উপর দিয়ে দামী দামী হরমোন টেস্ট দিয়ে দেয় কমিশনের আশায় । রোগী তো অতশত বুঝেনা , রোগীকে বলেছে এটা আমি ই করতে দিয়েছি ।
আমি কি করবো ? গ্রাম্য ডাক্তারের এই অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ব্যাপারে হেল্প করব?
আমি তাকে বললাম , শুনেন আমি যা করতে দিয়েছি অগুলির রিপোর্ট আমি দেখবো । আপনি যা করতে দিয়েছেন অগুলি আপনি দেখবেন । ওই রিপোর্ট আমার কাছে আনার দরকার নাই । সে লোক আমার উপর রেগে গেলো
এরকম ভাবে আমাকে খারাপ হতে হয়েছে নকল ওষুধ বিক্রেতার কাছে । যে প্রতিটি ভিটামিন প্রেসক্রাইভ করলে ফোনে একশটাকা রি চার্জ করে দিবে বলেছে ।
আমি নকল ওষুধ আর গ্রাম্য ডাক্তারের কমিশন বান্ধব নই । তাই আমাকে কঠোর হতে হয়েছে আমার মত একটা জগত গড়ে তুলতে । সবকিছু মিষ্টি কথায় হয়ে যায়নি ।
মেয়েরা রেগে যায় । জীবনের কোন কোন সময় হরমোনের এদিক সেদিকের কারণে খিটখিটে মেজাজের হয় । রাগ করা ভাল না ।
আপনি রাগ করে কাউকে চড় মারলে বিরাট সমস্যা কিন্তু রাগ করে ঠাণ্ডা মাথায় চুপচাপ খুন করে ফেললে অত সমস্যা নাই ।
এই কথাটা শুনলাম কয়েকদিন আগে ।
ঠাণ্ডা মাথার খুনিরা তাহলে এমনই হয় । হুম, আমি এই লম্বা জীবনে আমি এমন মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি যারা বলতে পছন্দ করে , “ আমার কোন রাগ নাই । আমি রাগী না । “
রাগ করলে আপনার মাথা থেকেও জিহ্বা আগে ছুটে । রাগের পর এর ফলাফল দেখলে নিজের ই কান্না আসে । হায় আমি কি করলাম ।
তবে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস লাগে তাদের যারা রাগ পুষে রেখে দেয় । তারপর সব রাগ একত্রিত করে একদিন চরম প্রতিশোধ নেয় ।
কে আমার উপর রেগে আছে তাও মনে রাখতে পারিনা , আমি কার উপর রেগে আছি তাও মনে রাখতে পারিনা । ব্রেইনের সালকাস জাইরাস গুলকে বহু কিছু মনে রাখতে হয় । এই সব তথ্য কে তারা আজাইরা ভেবে ফেলে দেয় ।
যাই হোক , রাগ করলে গুনাহ হয় ।
সুরা আল ইমরান ১৩৪ নং আয়াতে আছে ,
এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ ত্রুটি মাফ করে দেয় । এ ধরনের লোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালবাসেন ।
একই সুরার ১৫৯ নং আয়াতে আছে ,
( হে নবী ! ) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে , তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল । নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে , তাহলে তারা সবই তোমার আশপাশ থেকে সরে যেত । তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও । তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করো । ।
এইবার হাদিসে যাই । বুখারি শরীফের ৯ম খন্ড থেকে ৫৬৮৪ নং হাদিসটি খুব সুন্দর ।
“ প্রকৃত বীর সে নয় যে কাউকে কুস্তীতে হারিয়ে দেয় । বরং সেই প্রকৃত বাহাদুর যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম । “
৫৬৮৫ নং হাদিস হল ,
একবার নবী ( সাঃ ) এর সামনে দুই ব্যক্তি গালাগালি করছিল । তারা এতই রেগেছিল যে তাদের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল । তখন রাসুল ( সাঃ ) বললেন , আমি একটি কলেমা জানি যদি এ লোকটি পড়তো তাহলে তার ক্রোধ চলে যেত । লোকটি যদি আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম পড়তো ।
আজকের মত পড়াশোনা এখানেই শেষ । যতক্ষন বেলা আছে কারেকশানের জন্য চেস্টা করে যাই ।
রাগ হলে পড়বো আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম । আজকের সমালোচনা থেকে এটাই শিখলাম ।
কৃতজ্ঞতা ঃ ব্লগার শায়মা , তাঁর রাগ বিষয়ক পোস্ট টির জন্য
পোস্ট উতসর্গ আমার মামনি কে ।