"তুমি চেয়ে আছ তাই আমি পথে হেঁটে যাই
হেঁটে হেঁটে বহু দূর , বহু দূর যেতে চাই
কামাল মিয়া তার বউ এর দিকে তাকায় । কালো বোরখায় ঢাকা বউ । বড় পুরাতন রং চটা বোরখার আড়ালে পুরাতন একটা বউ । বোরখার মলিনতার আড়ালে তার বউ এর হীন রুগ্ন , ভগ্ন স্বাস্থ্য যেন ঢাকা পড়েনা ।
বউরে তবুও তুই বেঁচে থাক ।বউ চোখে কাজল দিয়েছে । তাকে বেশ সুন্দর লাগছে ।
মোমেনার স্বামীর দিকে চোখ পড়ে । এতটা বছর পরও চোখে ভালবাসার দৃষ্টি নববিবাহিতার মতই তাকে লাজুক করে দেয় । সে হাসে মুখ টিপে ।নেকাবের আড়ালে । কিন্তু চোখে হাসির ঢেউ কামাল মিয়ার কাছে অধরা থকেনা ।
দুজনে পা বাড়ায় । সকালের সোনালী রোদের ভিতর দিয়ে । সুন্দর বাতাস । রাস্তার দুপাশে অযত্নে বেড়েওঠা ডোল কলমি ফুলে পুরো বেগুনি হয়ে আছে । তারপরই বিশাল ধান ক্ষেত । বাতাস বয়ে চলেছে , যেন মেঘনার ঢেউ । ঝাঁকে ঝাঁকে চড়াই পাখি সাঁই করে ধানের উপর পড়ছে । আবার আরেক ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে । ধানে শিষ এসে গেছে । ধানের ফুল গুলিও ধানের মত হয় দেখতে । সেই ফুলে দানা বেঁধে যাচ্ছে । তারা যাচ্ছে শহরে । শহরের শেষ প্রান্তের হাসপাতালে । কামাল মিয়ার হাতে একটা বাজারের ব্যাগে সেই হাসপাতালের ডাক্তার আপার জন্য কিছু পিঠা ।
(২)
তারপরের ঘটনার আকস্মিকতায় ডাক্তার আয়শা বিব্রত । মেয়েটি দৌড়ে এসে মা মা বলে তাঁকে জড়িয়ে ধরল । এই মেয়ে তার জন্য নানা পদের পিঠা , জাম্বুরা , আমড়া নিয়ে এসেছে । শুধু তাই নয় টাকা খরচ করে আবার আপেল মাল্টা ও নিয়ে এসেছে । বেশভুসায় গরীব এরা ।
এই খরচান্ত ভালবাসার প্রকাশ দেখে লজ্জিত হয়ে পড়েছেন ।
তিনি আরও লজ্জিত রোগীটাকে চিনতে না পারার কারণে । চিনতে না পারার কারণ আছে । রোগী গুলো অসুস্থ অবস্থায় থাকে একরকম । সুস্থ হয়ে গেলে চেহারা পালটে হয়ে যায় অন্যরকম । রোগীটার কি সমস্যা ছিল ? কবে ভর্তি ছিল এখানে ?
তারপরই কামাল মিয়াকে দেখে মনে পড়ে যায়, মোমেনার স্বামী কামাল মিয়া । মোমেনা রাপচার ইউটেরাস নিয়ে এসেছিল প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় । সে ও অনেকদিন আগে ।
" আপনার ওয়াইফের অবস্থা খুব খারাপ , তাকে বাঁচাতে হলে তার জরায়ু ফেলে দিতে হবে । তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে পেটের ভিতরে । বাচ্চা টা মারা গেছে । মাকে বাঁচানোর জন্য এ ছাড়া আর উপায় নেই ।
' আপা , আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে , যা করা লাগে করেন , শুধু তাকে জ্যান্ত ফেরত দিন । সে শুধু আমার সংসারের দিকে শুধু চেয়ে থাকতে পারলেই হবে , আমার আর কিচ্ছু চাইনা । "
তারপর আবারো সে একই কথা বলেছিল , যখন তাকে জানানো হয় , এই অপারেশনের পর রোগীর বিশ্রাম দরকার । দেড় মাস তার সাথে মেলামেশা করা যাবে না ।
" আমি তার সব কাজ করে দিব , সে ফিরে আসছে , আল্লাহর কাছে আমি লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই , আমি আর কিচ্ছু চাইনা । "
একটা প্রকৃত ভালবাসার সুমিষ্ট ঢেউ এখানেও এসে আছড়ে পড়েছিল । তাঁর মনে হল পৃথিবী অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত , যদিনা এই মায়া , দয়া , ভালবাসা না থাকত । তিনি মনে মনে বললেন , তোমার বউ এর প্রতি তোমার এই ভালবাসা আমি হৃদয়ে রেখে দিলাম । কারণ আমাকে এই পুঁজি দিয়ে কিছু কিছু দয়া হীন ঘটনা দেখতে হবে ।
এই ঘটনা অনেকদিন আগের হলেও আজ দুজনকে দেখে সেই ভালবাসার সুরভী পেলেন ।
(১)
' ওরে ওরে হাওয়া থাম নারে
বন্ধু আসছে বহুদিন পরে
রোজীর বয়স ২৩
তার হাসবেন্ড বিদেশ থেকে এসেছে অনেক দিন পর ।
গোছানো ছিল অনেক স্বপ্ন । সব ছারখার । রোজীর হাসবেন্ড নানা রকম কমপ্লেইন করছে রোজীর শরীর নিয়ে ।
' আচ্ছা আপা আপনিই বলেন , একটা বাচ্চা হয়ে গেলে ব্রেস্ট কি আগের মত থাকবে ?
তাছাড়া সে মেলামেশা করতে গেলেও আমাকে নিয়ে অভিযোগ তুলছে । "
এবার মেয়েটার চোখে পানি । সে কাঁদছে যেমন মায়ের কোলে এসে সন্তান দুঃখের কথা বলে ।
মায়ের মতই ডা; আয়শার মন অস্থির হয়ে ওঠে । রোজীর স্বামী রোজীর ব্রেস্ট আর ভেজাইনা নিয়ে কমপ্লেইন করছে ।
"আচ্ছা আমি দেখছি সমস্যা কোথায় । আমি সলভ করে দেয়ার চেষ্টা করব । আচ্ছা চোখ মোছ । "
রোজী যে বিবাহিত আর ৩ বছরের বাচ্চার মা , না বলে দিলে বোঝা সম্ভবনা । নিখুঁত বি, এম, আই এর নিখুঁত মেয়ে । লম্বা , শ্যাম বর্ণ , দীঘল চুলে বেণী করা । রোজীর কোন সমস্যাই দেখতে পেলেন না ।
সমস্যা কি নাই ? রোজীর যদি সমস্যা না থাকে তাহলে সমস্যাটা কার ?
ডাঃ আয়েশা মনে মনে বললেন , এখানে রোগী রোজী , নাকি রোগী তার স্বামী?
সুস্বাস্থ্য তাকেই বলে যদি কোন ব্যক্তি শারীরিক ভাবে ভাল থাকবেন তা না , মানুষিক ভাবেও ভাল থাকবেন । এখানে রোগী তাহলে রোজীর স্বামী । স্বামীটা মন বৈকল্যে ভুগছে । বেচারা তার স্ত্রী কে নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেনা , নিজের সমস্যার কারণে ।
তার পর স্বামী এলেন । ডাঃ ভেবেছিলেন , মেয়েটার স্বামী না জানি কত স্বাস্থ্য সচেতন সুন্দর পুরুষ কিন্তু দেখলেন বেচারা ভুঁড়িওয়ালা , টাক ওয়ালা এবং টাকাওয়ালা । টাকার জোর মনে হয় বেড়েছে ।
আহারে যুগের হাওয়ায় আজ ভাল ভাল মেয়েগুলোর সংসারে অশান্তি । ২ বছর পর জামাই টা এলো , আর স্বামী যদি এভাবে ব্লেম দিতে থাকে , মেয়েটা মনে মনে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকবে ।
খুবই সাবধানে স্বামীটাকে কাউন্সেলিং করতে হবে । কিন্তু কোনভাবেই অনেক তিতা কথাকে মিষ্টি বানানো যায়না ।
"রহমান সাহেব,২ বছর আপনি আপনার ওয়াইফ কে দেখেন নি , মহিলা বলতে আপনার সামনে ছিল টিভি সিনেমার নায়িকা , মডেল রা । আপনার ওয়াইফ মডেলদের মত ফিগার হোক এটাই ছিল আপনার কল্পনায় । দোষ যতনা আপনার , তারচেয়ে বেশি মিডিয়ার । টিভি খুললেই শরীর প্রদর্শন করা মেয়েরা । আসলে তারা ভাল মেয়ে না । ভাল মেয়ে হলে শরীর দেখিয়ে বেড়াতনা ।ওই সব মেয়েদের কারণেই আজ আপনার বউ সার্বিক ভাবে ভাল থাকার পরও আপনার ভাল লাগেনা ।
আর , আপনি কি আয়নায় নিজেকে দেখেছেন ? আপনার মাথায় চুল প্রায় পড়ে গেছে । আপনার একটা বিশাল ভুঁড়ি আছে । আপনার ওয়াইফ এর কথা একটু ভাবেন । সে ও যখন টিভি খোলে তখন জন আব্রাহাম আর সালমান খানের ফিগার দেখে । সেও ত ভাবতে পারে সুন্দর চুলের ভালো ফিগারের সুপুরুষ হয়ে থাকুক তার স্বামী ।
সব মেয়ের কথা বলবনা , কিন্তু অনেক মেয়েই আছে শুধু একটু ভালবাসা পেলে স্বামী সংসারের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে পারে । আল্লাহর রহমতে আপনি তেমন বউ পেয়েছেন ।
একই দিনে দুটি ঘটনা । দরিদ্র ঘরের মেয়ে মোমেনা । গায়ে একরত্তি মাংস নাই । কোন দিন ই তেমন মত মোটা গাটা ছিল বলে মনে হয়না । অথচ উপচে পড়া ভাল বাসায় আছে সে । অনেকদিন আগে ভাল হয়ে গিয়ে আজ এসেছে কৃতজ্ঞতা জানাতে স্বামীকে সংগে নিয়ে ।
আর রোজী সব ঠিক থাকার পরও তার সমস্যার অন্ত নাই । আচ্ছা যদি ঠিক নাও থাকে , ধরা যাক একদিন রোজী মোমেনার মত হয়ে গেল । এরকম লীন এন্ড থিন , সেদিন কি হবে ? রহমান সাহেবের সংসারে তার সারা জীবন দিয়ে দেয়াটা কাজের স্বীকৃতি কি পাবে ?
এরকম প্রায় ঘটে । এরা একধরনের পারভার্ট পুরুষ ।প্রায়ই ভিমরতি ধরা পুরুষের বউ গুলো এ সমস্যা নিয়ে আসে । পুরুষগুলো কেউ কেউ আরেকটা শাদি মোবারক করে ফেলে , কেউ কেউ খারাপ এরিয়ায় যায় ।
আসলে ভালবাসার বাসা কোথায় ? কোথায় ধরা দেয় সেই সোনার হরিণ ? বড়ই জটিল প্রশ্ন ।