২০০২ সালের ঘটনা। আমার বয়স তখন ১২-১৩ হবে। ১১ জৈষ্ঠ্যের সন্ধ্যেবেলা। নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে চুপচাপ এককোণায় বসে আবৃত্তি শুনছি। চশমা পড়া এক লোক মঞ্চে এলেন। মাইক্রোফোন হাতে নিলেন।আবৃত্তি শুরু করলেন। দু’লাইন আবৃত্তি করার পর ভুল করলেন। তারপর আবার শুরু থেকে শুরু করলেন। ভরাট কণ্ঠের সেই আবৃত্তিটি সারারাত আমার কানে আঁঠার মত লেগে থাকল।
সেদিনের সেই কবিতাটির নাম ছিল ‘সব্যসাচী’।আমার দিদি গান গেয়ে সব প্রতিযোগীতার প্রথম পুরস্কারগুলো বাসায় নিয়ে আসত। আর সেই পুরস্কারগুলোর সবই ছিল বই। যদিও ছোট থেকেই খুব পড়াচোর ছিলাম,তবুও চমৎকার করে বাঁধানো বইগুলো একসাথে সাজানো আছে, দেখলেই মনটা ভরে যেত।মাঝে-মাঝে বইগুলোতে হাত দিয়ে দেখতাম। হাত দিয়ে বই ছোঁয়ার যে আলাদা একটা অনুভূতি আছে, তা অল্প অল্প করে বুঝতে শিখলাম।
সেদিন রাতে বাসায় এসে পাগলের মত নজরুল ইসলামের কোন কবিতার বই আছে কি না খুঁজতে লাগলাম। অনেক বইয়ের মাঝ থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক প্রচেষ্টার পর হাতে পেলাম গাড় খয়েরি মলাটে বাঁধা একটিবই। মলাটের উপর সোনালী রঙ্গে লেখা আছে ‘সঞ্চিতা’, নিচে কাজী নজরুল ইসলামের একটি সোনালী রঙ্গের প্যাচানো স্বাক্ষর।
খুঁজে পেলাম বইয়ের ৭৮ পৃ্ষ্ঠায় আছে ‘সব্যসাচী’ কবিতাটি। ধীরে ধীরে কবিতাটি বের করলাম। আরও ধীরে কবিতাটি মনে মনে পড়তে লাগলাম। অনেক কঠিন কঠিন কথা। এতসব বুঝি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে কবি বিদ্রোহের কথা লিখেছেন। সেজন্যই তো তিনি বিদ্রোহের কবি।
কবিতার অর্থ তেমন একটা উদ্ধার করতে না পারলেও যে বিষয়টার প্রেমে পড়লাম, তা হল কবিতার ছন্দ।একটি চরণ যেখান থেকে শুরু হল, পরের চরণ যেন ঠিক সেখানে গিয়েই মিলিয়ে গেল। ছোট করে উদাহরণ দিই,
‘বিরাটকালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে,
গান্ডীবধনু রাঙিয়া উঠিল লক্ষ লাক্ষরাগে!
বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য,
সাথে রথাশ্ব, হাঁকিছে সৈন্য,
ঝড়ের ফুঁ দিয়া নাচে অরণ্য, রসাতলে দোলা লাগে,
দোলায় বসিয়া হাসিছে জীবন মৃত্যুর অনুরাগে।’ (সব্যসাচী)
এতসব কঠিন কথা আমার মত আনাড়ির পক্ষে বুঝে ওঠা বেশ কষ্টকর। কিন্তু খুব সহজেই কবিতার কথা না বুঝেও ছন্দের প্রেমে পড়া যায়। অনেকটা এভাবে উদাহরণ দেয়া যায়, হাতে গোনা কয়েকটি হিন্দি গান আমার খুব ভালো লাগে। আমি হিন্দি বুঝি না। তাহলে ভালো লাগে কেন? গানগুলোর সুরের জন্য। ভাললাগার জন্য বোঝার খুব একটা দরকার নেই। ভালোলাগা পৃথিবীর সহজতম কাজগুলোর মধ্যে একটি। যদিও বোদ্ধারা নিশ্চয়ই এমন হঠকারী কথার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু, আমরা যারা কমবুঝি, কম জানি, আমাদের ভালোলাগাকে বোদ্ধারা কি দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?
কবিতাটি আরও এগিয়ে যায়। আমিও এগিয়ে যাই। বাংলা একাডেমীর ‘সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ দেখে শিখেনিই ‘সব্যসাচী’ কথাটার অর্থ। এরপর বুঝতে পারি কবিতার একেবারে শেষের ক’টি চরণ,
“মশা মেরে ঐ গরজে কামান-‘বিপ্লব মারিয়াছি’
আমাদের ডান হাতে হাতকড়া, আর বাম হাতে মারি মাছি!
মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি,
টিকি দাড়ি দিয়ে আজো বেঁচে আছি!
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী,
যাহোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম’রে বাঁচি।”
নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় এ তো আমরা ক্লাস ওয়ানে সবাই শিখে ফেলি। মুখস্ত করে ফেলি ‘ভোর হল, দোর খোলো খুকু মনি ওঠরে’ থেকে শুরু করে ‘রোজ তাই চাঁদা ভাই টিপ দেয় কপালে’ পর্যন্ত। আমার সাথেও এমনটাই হল। আবৃত্তি ক্লাসে গিয়ে শিখে ফেললাম বিদ্রোহী কবির ‘লিচুচোর’, ‘খাঁদু-দাদু’,‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’র মত অসম্ভব রকম মজার মজার সব কবিতা। কিন্তু তাঁকে কেন বিদ্রোহী কবি বলা হয়, এমন প্রশ্ন মাথায় খুব বেশি আসত না। কারন, ছোটতে তাঁর যেসব কবিতা পড়তাম, সেগুলোতে বিদ্রোহের কোন উপাদান ছিল না।
‘সব্যসাচী’ কবিতাটি কবি নজরুলের সাথে হঠাৎ করে আমার এক নতুন পরিচয় করিয়ে দিল। ধীরে ধীরে কবি সম্পর্কে আমার জানার ইচ্ছে অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। ‘সঞ্চিতা’ বইটির সবক’টি কবিতা অল্প ক’দিনের মধ্যে পড়ে শেষ করে ফেললাম। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি মাথা এলোমেলো করে দিল। দুপুরে স্নানে গিয়ে গায়ে জল ঢেলেও মনের অজান্তে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবৃত্তি করা শুরু করে দিতাম। সবাই শুনে হাসত। রাতে বিছানায় শোবার সময় মাথার ভেতর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কথাগুলো আগুনের ফুলকির মত বারবার ঘোরাফেরা করত। স্বপ্নে দেখতাম, আমি উন্মুক্ত মাঠে গলার সমস্ত জোর খাটিয়ে‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করছি। পাশ থেকে মা ডেকে দিত। ভাবত, ঘুমের মাঝে আমাকে বোবা রোগে ধরেছে!
জানতে পারলাম, ‘ভোর হল, দোর খোলো’ কবিতাটির আসল নাম ‘প্রভাতী’, তবে কবিতাটি আমরা যতটুকু শিখি,আসলে কবিতাটি তার থেকে বেশ বড়। এখন ভেবে আমার সত্যিই খুব অবাক লাগে যে ওই সময়ে, ওই বয়সে আমার গোটা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটা মুখস্ত ছিল। মনের অজান্তে আমি যখন আবৃত্তি করতাম,আশে-পাশের মানুষজন চুপ করে শুনত। সম্বিত ফিরে আসার পর আমি লজ্জা পেতাম। কিন্তু তারা মুগ্ধ হত।
২
আমার দিদি নজরুল সংগীতের শিল্পি। তাই খুব ছোট থেকে অনেক রকমের নজরুলগীতি শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দিদির গানের ডায়েরীতে নজরুলগীতি গুলো লেখা থাকত। আমি লুকিয়ে সেগুলো পড়তাম। অবাকহয়ে ভাবতাম, এই মানুষটি ‘বিদ্রোহী’ বা ‘সব্যসাচী’র মত কবিতা লিখেছেন, আবার এই মানুষটিই কত প্রেমের গানও লিখে গিয়েছেন! যেমন,
“মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে…”
অথবা,
“আমার ঘরের মলিন দ্বীপালোকে
জল দেখেছি যেন তোমার চোখে…”
অথবা,
“মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল ।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির,
চৈতী চাঁদের দুল ।”
নতুন করে তাঁর জীবনী পড়ার বড় ইচ্ছে জাগল। নতুন করে তাঁর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘাটাঘাটি করে ফেললাম। ভেতরে কষ্ট জমল, ভালোবাসা জমল এই মানুষটির জন্য। আমি ভাবতে শুরু করলাম, এই লোকটি তো মনে হয় পৃথিবীর সব বই পড়ে ফেলেছেন, পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ তিনি জানেন। পৃথিবীর সব জ্ঞান তাঁর মাথার ভেতর। কিন্তু তিনি তো পড়াশোর একদম সুযোগই পাননি। তাহলে উনি এগুলো কি করে জানলেন? আর কোন সময়ই বা এত মোটা মোটা সব বই পড়ে শেষ করে ফেললেন? প্রশ্ন করলাম বড়দেরকে। মনের মত উত্তর কারো কাছে পেলাম না। এই প্রশ্নটির মনের মত উত্তর আমার আজও পাওয়া হয়নি। বুঝলাম, তিনি এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁকে নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। কিন্তু তাঁর জীবনী পড়ে আমার একটা বিষয়ে ভীষণ উপকার হল। আমি ভাবতাম, পড়াশোর জন্য অবশ্যই চমৎকার নির্জন একটি পরিবেশ দরকার। জীবনে জ্ঞানী হবার জন্য প্রয়োজন একেবারে ঝামেলামুক্ত একটি জীবন। এছাড়া পড়াশোনা বা জ্ঞানী মানুষ হওয়া সম্ভব না। নজরুল ইসলামের জীবনী পড়ারপর আমার এসব ভুতুড়ে ধারণা চলে গেল। শিখলাম, পড়াশোনা করতে চাইলে আসলে যেকোন পরিবেশেই তা করা যায়। জীবনে বড় হতে চাইলে যেকোন অবস্থাতেই হওয়া যায়। জীবনে ব্যর্থতার জন্য কোনকিছুকে দায়ী করা অনুচিত। ছোটবয়সের এই শিক্ষাগুলো আমার পরবর্তীতে খুব কাজে লেগেছিল।কারন, আমাকে পরবতী সময়ে হঠাৎই অনেক মারাত্মক সব ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। হয়ত থেমে যায়নি, ভেতরে নজরুল ছিল বলে।
৩
এই লোকটিকে নিয়ে আমি আজও পড়াশোনা করি। তাঁর প্রতি জন্মজয়ন্তীতে আমি আর কিছু না হোক, অন্তত ‘বিদ্রোহী’ আর ‘সব্যসাচী’ কবিতাদুটি আবৃত্তি করি। কেউ না শুনলে শুধু নিজেই নিজেকে শোনাই।যদিও আবৃত্তিটা আমি একেবারে খারাপ করি না, কিন্তু মানুষ-জন আজকাল আর শুকনো আবৃত্তি শুনতে পছন্দ করে না। কেন করে না, কে জানে।
আবার অবাক হয়ে ভাবি, এই মানুষটিই নিজের সময়ে কত নিগৃহীত হয়েছিলেন। কতটা অত্যাচার সহ্য করলেএকজন মানুষের মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আমার জানা নেই। আবার এই লোকটিকেই ‘মুর্তাদ’ নামে গালি-গালাজ করেছিল কিছু ধর্মান্ধ মানুষ। আজ তারা চুপচাপ থাকে। কবির জন্মজয়ন্তীতে চুপচাপ ফুল দিয়ে চলে আসে। আজকাল কবিকে নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে, বড় বড় বক্তৃতা দেয়, কিন্তু কবিকে বুকে ধরে রাখে না। কবির ‘নারী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘মানুষ’ কবিতা গুলোর যদি চুলচেড়া বিশ্লেষন করা হয়, অবাক হয়ে গোটা জাতি দেখবে, কবিকে ‘নাস্তিক’,‘মুর্তাদ’ অ্যাখ্যা দেয়ার মানুষের অভাব হচ্ছে না আজকের বাংলাদেশেও!
আমি এতসব জানতে চাই না। এতসব জানবেন গবেষকরা। আমি গবেষক না, হতেও চাই না। আমি একজন সাধারণ পাঠক। ভালোলাগা থেকে যতটুকু জানতে ইচ্ছে করে, ততটুকুই জানি।
আজকাল অনেকেই কবিতা লেখেন। সেই কবিতাগুলো পড়ে আমার দৃষ্টি ও মনস্তাত্ত্বিক- উভয় শক্তিরই বেশ অপচয় হয়। যে কথাগুলো খুব সহজ করে বলা যেত, সে কথাগুলো কেন এত কঠিন করে বলতে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাইনা। কবিতায় অবশ্যই কঠিন কঠিন শব্দের সমাহার থাকতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কবে কে তৈরী করল? আর কবিতার শব্দ কঠিন করলেই তো আর অর্থ উন্নত হয়না। আবার অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি নজরুল নিয়ে লেখেন। সেসব লেখা এতটাই কঠিন যে, আমার মত অশিক্ষিত মানুষগুলোর পক্ষে সেগুলোবুঝে ওঠা সম্ভব না। আমি আকুল অপেক্ষায় আছি, কবে কেউ খুব সহজ ভাষায় কবি নজরুলে জীবন,আদর্শ আর কবিতার তাৎপর্য গুলো আমাকে বুঝিয়ে দেবেন, কবে বাজারে এমন সহজ কথার একটি বই প্রকাশিত হবে আর আমি প্রাণভরে সেটি পড়ব। কবিগুরু বলেছিলেন,
“সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে
সহজ কথা যায় না বলা সহজে…”
সহজ কথা বলা কঠিন। এটুকু আমি জানি। তবে দেশের জ্ঞানী-গুণীরা, নজরুল গবেষকরা যেন সর্বস্তরের মানুষের জন্য সহজ কথায় নজরুলের জীবনী তুলে ধরার এই কঠিন কাজটা করেন, সে অনুরোধ আমারঅনেক দিনের।
৪
কবি নজরুল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। এখান-ওখান থেকে পড়ে বা শুনে যা একটু-আধটু জানতে পারি, তাই বলি, তাই লিখি। আমার শুধু এটুকুই মনে হয়, জীবনে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নজরুল একটি অসম্ভব প্রেরণার নাম হতে পারে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, নজরুল নিশ্চয়ই ততদিন থাকবেন। আজকের বাংলাদেশে নজরুলের এই উপস্থিতি অনেক বেশি দরকার। নজরুলের নাম মনে পড়লেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিদ্রোহ, চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা। আজকের বাংলাদেশে এই তিনটিরই খুব বেশি প্রয়োজন।
নজরুল কেন আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না।।