somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাল-নীল-সাদা

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার মা মারা যায়। আমি সুষমা, তার একমাত্র মেয়ে।
আমার ঠিক মনে নেই, শুধু এটুকু মনে আছে, মায়ের মৃত বিভৎস মুখ দেখে আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমার মা বিষ পান করে মরেছিল। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে।

তাই বলে আমার মেয়েবেলাটা যে নিরানন্দ কেটেছিল, তা নয়। আমি গ্রামের বন্ধুদের সাথে খেলতাম, স্কুলে যেতাম, স্কুলে ভালো রেজাল্ট করতাম ইত্যাদি ইত্যাদি। শৈশবে গাছে গাছে পাখি দেখে বেড়ানো ছিল আমার শখ। অনেক লম্বা দানব সমান গাছের মগডালে হয়ত বসে আছে একটি নিষ্পাপ পাখি। আমি ঢিল ছুড়তাম।

একদিন সত্যি সত্যি আমার ছোড়া ঢিল লেগে গেল এক হলদে রঙ্গের পাখির গায়ে। পাখিটি মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল। নিজেকে তখন পৃথিবীর সবথেকে নিষ্ঠুর মানুষ বলে মনে হচ্ছিল আমার। তারপর থেকে আমি আর কখনও কোন পাখিকে ঢিল ছুড়িনি। ভালোবেসেছি তাদের। পাখিদের ভালোবাসতে বাসতেই মনে হয় আমি মানুষকের ভালোবাসা শিখে ফেলেছি।

শুধু কষ্ট পেয়েছি ঘরে এসে। মা মারা যাবার পর বাবা আরও একটা বিয়ে করে। বাবা আমাকে কখনওই ভালোবাসেনি। মা ভালোবাসত। কিন্তু মা তো চলে গেল। নতুন মা আমাকে দেখতে পারত না। তাই আমাকে অনেক কষ্ট করতে হত।

কিন্তু আমি লেখাপড়াটা ছাড়িনি। বিপদে কেউ না কেউ ঠিক এগিয়ে এসেছে। কেউ স্কুলের বেতন দিয়ে দিয়েছে. কেউ কিনে দিয়েছে পড়ার বই। আমি চোখের জলে ভিজে ভিজে তাদের দান গ্রহণ করেছি। মনে মনে ভেবেছি, একদিন তাদের জন্য আমি অনেক কিছু করব।



তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। বাবার ঔদাসিন্য, সৎ মায়ের যন্ত্রনা, কোনকিছুই আমাকে থামাতে পারছে না।

কিন্তু স্কুল থেকে আসার পথে হঠাৎ একদিন থেমে গেলাম। দেখলাম সাদা শার্ট পড়া এক মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক একটি ফুটফুটে হলদে পাখিকে হাতে নিয়ে আদর করছে। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। বললাম,

‘এই পাখিটা কি আপনার?’

এক অপূর্ব মায়াবী হাসি হেসে লোকটি বলল, ‘হ্যা, আমার। তোমার পছন্দ হয়েছে?’

আমি বললাম, ‘আমার হলদে পাখি খুব পছন্দ।’

‘তাই, ঠিক আছে। আমি তোমাকে পাখিটা দিয়ে দিলাম।’

আমার তো তখন আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা।আবেগ চেপে রেখে বললাম, ‘পাখিটাতো আমাকে চেনে না। ও আমার কাছে থাকবে কেন?’

-‘আমি বলে দিয়েছি। ও আর কোন অসুবিধা করবে না।’

-‘আপনি পাখির সাথে কথা বলতে পারেন?’

লোকটি আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালো। আমার ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি ভয় পেলাম না।বরং আমার লোকটিকে ভালো লাগতে শুরু করল।

‘শুধু কি মুখ দিয়ে কথা হয়? মনে মনে কথা হতে পারেনা?’

-‘হ্যা পারেনা কেন। নিশ্চই পারে। কিন্তু আপনি কি মনের কথা বুঝতে পারেন?’

-‘হ্যা পারি।’

-‘তাহলে বলুন তো এখন আমার মনে কি আছে?’
-‘বলব?’

-‘হ্যা, বলুন।’

-‘এই মুহূর্তে পাখিটার থেকে আমাকে তোমার বেশি ভালো লাগছে।’

আমি লজ্জায় মাথা নামালাম।

-‘কি, তাইতো?’

আমি আর থাকতে পারলাম না। পাখিটাকে ফেলে রেখে দৌড় দিলাম। এক দৌড়ে বাসায় পৌছলাম। বাসায় গিয়ে দেখি মা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেন স্কুল থেকে ফিরতে দেরী করলাম? এই আমার অপরাধ। উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। সত্য কথা বললে পরিণতি আরও খারাপ হবে। আর মিথ্যে কথা আমি বলতে পারিনা।
সৎ মায়ের শক্ত হাতের আঘাতে সেই রাতে পিঠে খুব ব্যথা হয়েছিল। ব্যথার ঘোরে যখন চোখ বন্ধ করছি, তখনই ভেসে আসছে মধ্যবয়েসী লোকটার অপূর্ব সুন্দর মায়াজাগানিয়া চেহারা।নাকের নিচে পুরু গোঁফ। লালচে ঠোঁট। সুঠাম শরীর। ঘুমের ঘোরে লোকটাকে দেখলাম। তার হাতে হলদে রঙ্গের পাখি।


পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি আবচেতন মনেই লোকটিকে খুঁজতে শুরু করলাম। নাহ্। আজ আর লোকটি নেই। সে বোধহয় আমার দিবাস্বপ্ন ছিল। সে আর কখনও আসবে না।মনটা যে কেন খারাপ হয়ে গেল, কে জানে?

একা একা ধীর পায়ে বাড়ি ফিরছি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই সৌম্যদর্শন লোকটি। আজ একটি হালকা নীল রঙ্গের শার্ট পড়েছে সে। কি যে সুন্দর লাগছে তাকে! পৃথিবীর মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে?
আমি আমার বিস্ময় চেপে রাখতে পারিনি। তার কোন চেষ্টাও আমি করিনি।

-‘কি, আমাকে খুঁজছিলে তো?’ হাসি হাসি মুখ করে লোকটি আমাকে বলল।
খুব বলতে ইচ্ছে করল, হ্যা, সত্যিই। সারাটা পথ শুধু আপনাকেই খুঁজেছি। কিন্তু বলতে পারলাম না। বরং বলে ফেললাম, ‘আপনাকে কেন খুঁজব? আমি বাসায় যাচ্ছি।’
-‘তাই?’
-‘হ্যা তাই।’

আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটি পিছন ফিরে হাটা শুরু করল। আমি আর পারলাম না। তাকে ডাকলাম, ‘এই যে, শুনছেন?’

-‘আমি মোস্তফা। তুমি?’

-‘আমি সুষমা। আপনি চলে যাচ্ছিলেন কেন?’

-‘আমি জানি যে তুমি এতক্ষণ আমাকেই খুঁজছিলে। আমি মনের ভাষা পড়তে পারি।কিন্তু কতটা গভীরভাবে খুঁজছিলে সেটি জানার জন্য আমি চলে যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম তুমি আমাকে ডাকবে। একটি মেয়ে যখন পেছন থেকে একটি ছেলেকে সুন্দর করে ডাকে, তখন মেয়েটি ছেলেটির প্রেমে পড়ে যায়।’


কতক্ষণ মোস্তফার সাথে গল্প করেছিলাম সেদিন, জানিনা। মোস্তফা যখন আমাকে বাসার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে চলে গেল, তখন আমার পৃথিবীটা যেন খাঁ খাঁ করছিল। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গিয়েছে। সারাদিন বাসায় ছিলাম না।

আমি জানতাম, বাড়ি ফিরে আমার পরিণতি কি। তাই সং মায়ের বকাবকি, প্রহার খুব সহজভাবেই নিলাম। শক্ত হাতের আঘাতে রাতে শরীরজুড়ে প্রচুর ব্যথা উঠত। মুখ টিপে টিপে কাঁদতাম। বালিশের তলা থেকে লুকিয়ে রাখা মায়ের ছবি বের করে বুকে রাখতাম। একটু যেন শান্তি এল। ঘুমিয়ে পড়তাম ধীরে ধীরে। গভীর রাতে স্বপ্নে আসত মোস্তফা। আর ওর হলদে পাখি।




কষ্টে-সৃষ্টে আমার আর মোস্তফার দুষ্টু মিষ্টি প্রেম চলছিল। এখানে-ওখানে লুকিয়ে, কখনও স্কুলে না গিয়ে দেখা করতাম মোস্তফার সাথে। ওর কন্ঠ ভরাট। কথাগুলো মিষ্টি। বুকের লোমগুলো ঘন কালো। একদিন আমার আঙ্গুল নিয়ে খেলা করতে করতে ও বলল,‘ জানো সুষমা, কি চমৎকার একটি নামের অধিকারিণী তুমি।পৃথিবীর যে ক’টি শব্দে সু আছে, আমার কাছে সেগুলো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর শব্দ। আর সুষমা সুন্দরীতমা। সুষমা মানেই সৌন্দর্য, সুষমা মানেই লাবণ্য।তুমি সুন্দর। তোমার নিদ্রা সুষুপ্তি। আমি তোমার প্রতি রাতের স্বপ্নে আসি। তাই না?’

মোস্তফা আমার মনের সব খবরই জানত। আমার মনের কথা ওকে জানাতে হত না। ও তার আগেই সব জেনে যেত।

আকাশে চাঁদ উঠত। এই চাঁদকে আগে কখনও আমার এত ভালো লাগেনি। জোনাকি ভালো লাগত, ঝি ঝি পোকা ভালো লাগত, অন্ধকার ভালো লাগত। এমনকি আমার কষ্টগুলোকেও আমার ভালো লাগত। পৃথিবীতে যে এত ভালোলাগা আছে, প্রেমে না পড়লে কি আর তা জানা যায়?




বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করা হল। সাতটা আকাশ আমার মাথায় একসাথে ভেঙ্গে পড়ল।

মোস্তফাকে সব বললাম। কোনো উপায় নেই। আমার কথা বাড়িতে কউ শুনবে না। আমি আমার ভালোবাসাকে নিরবে হারাতেও পারব না। ঠিক করলাম, আমরা বাড়ি থেকে পালাবো।

বিয়ের সপ্তাহ দুয়েক এর মত বাকি। গভীর রাতে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। আমার সাথে ছোট্ট একটি ব্যাগ। তাতে আছে কয়েকটি কাপড়, অনেক দিনের কষ্ট করে জমানো কিছু টাকা, আর আমার মায়ের ছবি।

আকাশে একফালি চাঁদ। আবছা আলোয় মোস্তফাকে খুঁজে পেতে আমার অসুবিধা হল না। আমি মোস্তফার বুকে আছড়ে পড়লাম। মোস্তফা আমার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে দিল। আমি বুক তখনও দুরু দুরু করে কাঁপছে।

ভোর হবার আগেই আমরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে পড়লাম। সেখানে মোস্তফার গাড়ি তৈরী করাই ছিল।

আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। দুশ্চিন্তায় আমার চোখ তখন বুজে আসতে চাইছে। এত ছোট্ট মাথায় এত চিন্তা আমি কি করে নেব।

ভোর হয়ে গেল। সকালের হালকা বাতাস শরীর-মন সতেজ করে দেয়। আমার ভালো লাগল। কিন্তু একটু পরে যখন ঘরে আমাকে পাওয়া যাবে না, তখন কি হবে, তা ভেবে আমার তলপেট বারবার পাকিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে বমি হবে।

তেমন কিছু হল না। আমরা রাজশাহী শহরে এলাম। দেখতে দেখতে রাজশাহী পেরিয়ে গেলাম। পেরিয়ে গেলাম চাপাইনবাবগজ্ঞ। পেরোলাম কানসাট। এরপর হাটা পথ। হাটছি তো হাটছিই। কোথায় যাচ্ছি জানি না। সামনে কি আছে জানি না। শুধু এটুকু জানি, মোস্তফা আমার সাথে আছে।
সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। মাথা ঘুরে আসছে বার বার। কিছুই বলছি না। সব কষ্ট নীরবে সহ্য করছি আমার ভালোবাসার জন্য। মনের মানুষকে নিজের করে পাবার জন্য।

নৌকা করে একটি ছোট্ট নদী পার হতে হল।
এরপর একজন লোক এল। মাথায় কালো রঙ্গের পাগড়ি। লম্বা চোয়াল। ঠিক যেন বাঙ্গালী নয়। এ কোথায় এলাম আমরা?

আমার মনে প্রথম ভয় ও সন্দেহ জাগতে শুরু করল, যখন সেই পাগড়ি পরা লোকটা হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করল ও মোস্তফাকে বিজেন্দর বলে ডাকতে লাগল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, পাগড়ি পরা বিদেশী লোকটা মোস্তফাকে বিজেন্দর বলে ডাকছে আর মোস্তফা তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে!


আমার সন্দেহ হল। মনে কিছু প্রশ্ন এল।

যে মোস্তফা ভরাট কন্ঠে এত সুন্দর করে কথা বলে, যে ছেলেটির হৃদয় এত ভালোবাসাময়, সে তার প্রেমিকাকে কাছে পেয়ে ভালোমত কথাও বলছে না, তার যেন আছে শুধু একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা।

এমনটাতো হবার কথা নয়। আমি যে মোস্তফাকে চিনি, সে তো এমন নয়।
মোস্তফার নাম বিজেন্দর কেন?

এই পাগড়ি পরা লোকটা এখানে কেন? সে নিশ্চই বাংলাদেশী নয়। সে হিন্দিতে কথা বলে।

তাহলে কি আমি পাশের দেশ ভারতে চলে এসেছি? মোস্তফা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মানুষ। তাহলে? আমি কি এখানে একা? এরা আমাকে নিয়ে কি করবে? আমি কোথায় যাব?

মোস্তফাকে জিজ্ঞেস করলাম। ও কিচ্ছু বলে না। পাথরের মত মুখ করে আছে। সে মুখে নিষ্ঠুরতা আছে। ভালোবাসার লেশমাত্র নেই।

নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এখানেই শুয়ে পড়ি।

আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন জেগে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি ভুল পথে পা বাড়িয়েছি। আর যে পথে যাচ্ছি, সে পথে খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। তাহলে?

তাহলে নিজেকে বাঁচাতে হবে। কি করে বাঁচাবো। এ তো প্রায় জনমানবহীন এলাকা। আমি চিৎকার করব? মোস্তফা কি মনে করবে? যদি আমার সব ধারণা ভুল হয়? আর ঠিক হলেও বা কি, আমি কি আর বাসায় ফিরতে পারব? এখন বাসায় ফিরলে কেউ কি আমাকে মেনে নেবে?

আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। শরীরের সবটুকু শক্তি উজার করে দিয়ে ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে উঠি মনের অজান্তে। প্রচন্ড রকম ঘাবড়ে ওঠে মোস্তফা ও পাগড়ি পরা লোকটি। মোস্তফা আমার গালে সজোরে আঘাত করে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। জ্ঞান হারানোর আগে একটি গুলি ছোড়ার আওয়াজ পেলাম।


জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে। আমি তখন সোনামসজিদ বর্ডারের পুলিশের কাছে বন্দিনী। খুব ধীরে ধীরে আমার সব কিছু মনে পড়ল। মনে পড়ে গেলে আরও বেশি কষ্ট হতে লাগল।

পুলিশের(ঠিক পুলিশের নয়) একটি লোক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার চুলে নরম করে হাত বুলিয়ে দিল। আমাকে কিছু খাবার দিল। কিন্তু আমি খেতে পারলাম না। আমার শরীরে তখন অনেক জ্বর। কাঁপুনি উঠে গেছে।

লোকটি আমাকে একটি বিছানায় শুইয়ে দিল। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

প্রায় চেতনাহীন থেকেই আমার আরও দু’টো দিন কেটে গেল। তৃতীয় দিনের মাথায় একটু সুস্থ্য বোধ করতে লাগলাম। চোখ মেলে দেখলাম সেই লোকটিকে, যে আমার এতদিন সেবা করেছে।

আমার চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। লোকটি আমাকে জড়িয়ে নিল। আমি বাঁধা দিলাম না।



-‘আমি এখানে কেন?’

-‘তুমি খুব বিপদে পড়েছিলে। আমরা তোমাকে বাঁচিয়েছি।’

-‘কি বিপদে পড়েছিলাম?’

-‘তুমি এক ভয়ঙ্কর নারী পাচারকারীর হাতে পড়েছিলে। আমি সময়মত না গেলে তোমাকে বাঁচাতে পারতাম না।’

-‘ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল?’

-‘ওরা তোমাকে ভারতে পাচার করে দিত।’

-‘কেন?’

-‘ওতে ওরা অনেক টাকা পেত।’

-‘কিন্তু মোস্তফা।ও তো আমাকে অনেক ভালোবাসে।’

-‘ভুল। ওরা শুধু টাকাকেই ভালোবাসে। ওর নাম মোস্তফা নয়। ওর আসল নাম আমরাও জানিনা। ও আসলে নারী পাচারকারী। নানা ছলে-কৌশলে ও তোমার মত সহজ-সরল মেয়েদের ধরে এনে ভারতে পাচার করে দেয়।’
-‘ও কি আমার আগেও অন্য কাউকে পাচার করেছে?’

-‘প্রতি বছর অনেক নারী-শিশু বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১০ বছরে প্রায় তিন লাখ নারী-শিশু বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। যাদেরকে পাচার করা হয়, তাদেরকে দিয়ে নানা রকম অসামাজিক কাজ করানো হয়।তাদের জীবন হয় একটি জ্বলন্ত নরক। তুমিও সে পথে পা দিয়েছিলে। এখন অবশ্য তুমি নিরাপদ।’

-‘আমাকে বাঁচালে কেন?’

-‘আমি একজন বিজিবি সদস্য। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো, নারী পাচার রোধ, এগুলো আমার কাজ।’

-‘কিন্তু আমি বেঁচে থেকে কি করব?’

-‘তুমি আবার বাঁচবে। ভালোমত বাঁচবে। মাথা উঁচু করে বাঁচবে।’
-‘কে বাঁচাবে আমাকে। আমাকে বাঁচানোর কেউ নেই। আমাকে মরতেই হবে। হয় এখানে, নয় ওখানে।’

-‘আমি বাঁচাবো তোমাকে।’



আমাকে বাঁচিয়েছে রোকন নামের এক বিজিবি সদস্য। আমার চিৎকার করেছিলাম ঠিক সীমান্ত এলাকায় এসে। আমার চিৎকার শুনে রোকন এগিয়ে আসে। গুলি ছোড়ে। ও এসে শুধু আমাকেই পড়ে থাকতে দেখে। মোস্তফা পালিয়ে গেছে আরও আগে।



রোকন আমার পাশের গ্রামের মতলব চাচার ছেলে। দেখতে কালো, লম্বা। পাতলা ছিপছিপে শরীর।

রোকনই আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। কিন্তু আমি তো আর আগের সুষমা নই। আমার নামে সুষমা নেই, আমার চেহারায় সুষমা নেই, আমার চরিত্রেও আর সুষমা নেই। আমি আমার নামই ভুলে গিয়েছিলাম। মোস্তফা বলেছিল, আমার নাম নাকি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নামগুলোর একটা। তাই যদি হবে, তবে এমন কেন হবে?

আমি এখন কুলটা, কলঙ্কিনী। আমি এখন খারাপ মেয়ে। যে মেয়ে বিয়ের দু সপ্তাহ আগে বাড়ি থেকে পালায়, তাকে কি কেউ ভালো মেয়ে বলে?
আমি সব হারিয়েছি। আমার ভালোবাসা? সে কথা মনেও আনতে ইচ্ছে করে না।বুকটা চৌচিড় হয়ে ফেটে কষ্ট বেরিয়ে আসতে চায়। পারেনা। আমার শেষ ভরসার সাথী, আমার মায়ের ছবি। আমি সেটিও হারিয়েছি।
অনেক রাত হল। ঘুম আসছে না। বাহিরে ঝিরিঝিরি বাতাস। আকাশে শেষ রাতের মরা চাঁদ।

খুব সম্ভবত আমার আত্মহত্যা করা উচিত। আমার আর বেঁচে থাকা উচিত নয়।

কিন্তু কি করে নিজেকে শেষ করব? শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে মা’কে দেখলাম। মা মিষ্টি হেসে আমাকে ডাকছে। হঠাৎ একটি হলদে পাখি চোখে পড়ল। আমি আতকে উঠলাম। আমার ঘুমটা ভাঙল আতঙ্কে। ঘুম ভাঙ্গার পর সশব্দে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠানামা করছে।

বাইরে কে যেন এসেছে।

জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম। রোকন এসেছে। হাতে মিষ্টি নিয়ে। রোকনকে দেখে আমার বাবা হাসিমুখে কথা বলল। বুঝলাম তারা পূর্ব পরিচিত।

রোকন সরাসরি আমার বাবাকে বলল, সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
এ কি কথা? ও আমাকে কেন বিয়ে করবে? আমি আজ না হয় কাল আত্মহত্যা করব। আমি তো আর বাঁচব না। ও কেন আমাকে বিয়ে করবে?


রোকন আমার ঘরে এল। আমার হাত ধরে বলল, ‘সুষমা, তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?’

-আপনি কেন আমাকে বিয়ে করবেন? আমি তো আর বাঁচবই না।’

-‘তোমার মনে আছে, আমি যে তোমাকে বলেছিলাম, আমি তোমাকে বাঁচাবো?’

-‘হ্যা, আছে।’

-‘আমি কাউকে কথা দিলে তা রাখি।’


রোকন আমার হাত দুটো চেপে ধরে আছে। আমি চোখ বুজে আছি, ভয়ে। আমার দু’চোখে তখন শুধুই আঁধার আর আঁধার।।




(আসলে এ গল্পটির কোন সমাপ্তি নেই। এ গল্পটির কোন পরিপাটি তৃপ্তিদায়ক সমাপ্তি থাকতে পারেনা। ভালবাসা হোক পবিত্র। ভালোবাসার নামে ছলনা ও নোংরামো মুছে যাক। বেঁচে থাক শুধুই ভালোবাসা, নিখাঁদ ভালোবাসা।)
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×