আজকের কিস্তিতে বলব ইয়ামাতো কোফুন, ইয়ামাতো আসুকা, পিরিয়ড (সময়কাল) নিয়ে। এর মাঝে ইয়ামাতো কোফুনেই প্রাচীন জাপানের অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। বাকিটা ক্লাসিকাল জাপানের শুরু।
প্রথমেই ইয়ামাতো নিয়ে কিছু বলি। বিষয়টা অনেক বড়। বলা যায় আমি তার কিছুই বলছি না। কেবল এর পরিচয় দিচ্ছি।
ইয়ামাতো জাপানের প্রাক্তন এক প্রদেশ যা কিনাই অঞ্চলের পাঁচটি প্রদেশের অন্যতম। এটা বর্তমানে হনশু'র নারা প্রশাসনিক অঞ্চলের (prefecture) মধ্যে পরে।
এই হল বর্তমান নারা। লাল অংশটা।
কমলা রঙের অংশটা কিনাই অঞ্চল।
এই হল ইয়ামাতো। রঙ্গীন অংশটা।
ইয়ামাতো-কোফুন পিরিয়ড: 250 – 538 AD
ইয়ায়াইও এর পর পর বা বলা যায় প্রায় শেষ দিকে ইয়ামাতো ( বর্তমান নারা ) এলাকায় নতুন এক সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। যা ইয়াইওই থেকে একেবারেই আলাদা। এই সংস্কৃতি ছিল অনেক বেশি ক্ষমতাকেন্দ্রমুখী, পিতৃপ্রধান আর সমরবাদী। মনে করা হয় ইয়াইওইরা কোফুন পিরিয়ডে এই কোফুনদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। কোফুন আরও একটা কারণ এতটা পরিচিত; তা হল জাপানের রাজদরবার এই সময়কালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেটা তৎকালীন ইয়ামাতো থেকে পরিচালিত হত। কিন্তু এই দরবারের প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ অজানাই রয়ে গেছে। এর মেয়াদকাল ছিল ২৫০ থেকে ৭১০ খ্রিষ্টাব্দ।
বস্তুত কোফুন শব্দের জাপানি অর্থ হল সমাধিস্তুপ। এই পিরিয়ডে অধিকাংশ সমাধি পাওয়া যায় এখনকার ওসাকাতে। নিচের ছবি দিলাম
ছবিটা আসল কি না জানি না। তবে এটা রাণী হিমিকার সমাধি বলে গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য আমি ছবিটা দিয়েছি সমাধির সত্যিকারের আকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণার জন্য।
এই সমাধিগুলো কয়েকমিটার থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত হয়। এদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত এবং পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সমাধি হল সম্রাট নিনতোকু'র কি-হোল আকৃতির সমাধি। এটা উচ্চতায় ২৭ মি, এবং লম্বায় ৪৮৬ মি,।
কি হোল সমাধিটা।
বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু সিরামিকে তৈরি বস্তু পেয়েছেন এই সমাধিগুলো। যেগুলোর নাম হানিওয়া। হানিওয়াগুলো মুলত মানুষ, বিভিন্ন প্রাণী, সৈনিক ইত্যাদির অবয়ব হত। মুলত গবেষকরা যেটুকু তথ্য পেয়েছেন এই পিরিয়ড সম্পর্কে তার প্রায় সবটুকুই এসেছে এই হানিওয়া থেকে।
এটা শেফতেইন হানিওয়া। ব্রিটিশ জাদুঘরে আছে।
কোফুন সৈনিকের হানিওয়া।
ঘোড়ার হানিওয়া।
মৃৎশিল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছিল তখন। এই সময়েই সুয়েকি পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন শুরু হয়। এগুলো তৈরি হত ধূসর নীল কাদামাটি থেকে এবং বেশ শক্ত কিন্তু পাতলা হত। পাশাপাশি বানানোর সময় এদের ১০০০ থেকে ১২০০ ডি,সেলসিয়াসে পোড়ানো হত। যা এখনকার সময়ে পোর্সেলিন বানাতে করা হয়। যদিও এই পদ্ধতি চায়না উদ্ভাবিত হয়েছিল তবে কোরিয়াই এর ব্যাপক প্রচলনের অগ্রদূত। সুয়েকিকে অবশ্য একটা কোরিয়ান চুলায় পোড়ানো হত যার নাম আনাগামা।
সুয়েকি দ্রব্য।
এখনকার দিনের আনাগামা।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক খুব সুবিধের ছিল না। তবে চীন, এবং কোরিয়া উপদ্বীপের তিন রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। তবে কোনো প্রত্নতত্ববিদের মতে কোরিয়া তিন রাজ্য ( বায়েকজে, সিল্লা, আর গোগুরিও) জাপান দখল করে ফেলেছিল। কিন্তু বেশির ভাগই গবেষক বলেন এর কোনো প্রমাণ তারা পান নি।
তবে হ্যাঁ চীনা সংস্কৃতি জাপানের পুরোটা জুড়েই আছে। চীনের কনফুসিয়ানিসম, লেখার ধরণ, বয়নশিল্প, নির্মাণ পদ্ধতি ইত্যাদি সবই জাপান ধার করেছে।
এই পিরিয়ডের শেষ দিকে এসে ( ৫ম শতকে ) ইয়ামাতো রাষ্ট্র তৈরি হয়। এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের বলা হত ও-মুরাজি, এবং ও-অমি।
কোফুন অলংকার।
কোফুন আমলের ওয়্যার হাউস।
কোফুন হেলমেট, লোহা আর তামার।
আর এখানেই শেষ হল জাপানের প্রাচীন সময়কাল।
এবারে আসি ইয়ামাতো আসুকা পিরিয়ড 538 – 710 AD:
এটা ক্লাসিকাল জাপানের শুরু।
এই পিরিয়ডের নামকরণ করা হয়েছে আসুকা এলাকার নামানুসারে। যা বর্তমান নারা'র ২৫ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। এই সময়ে চিত্রকলা, সমাজ, এবং রাজনীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছিল।
সমাধির গায়ের চিত্রকলা। অষ্টম শতাব্দীর।
এসব পরিবর্তনের শুরু কোফুন পিরিয়ডে হয়েছিল। তবে আসুকা পিরিয়ডে এসে বুদ্ধের মতবাদের দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়ে যায়। এসময় রাষ্ট্রের নাম পাল্টে গিয়ে ওয়া থেকে নিহোন হয়ে যায়। এই পিরিয়ডকে চাইলে আরও দু'টো ভাগে ভাগ করা যায়। আসুকা আর হাকুশো। আসুকাতে তাইকা পুনর্গঠন পর্যন্ত উত্তর ওয়েই আর বায়েকজে থেকে প্রভাব আসে। আর পরে হাকুশোতে অনেক বেশি সুই আর ত্যাং প্রভাব দেখা যায়।
হাকুশো আমলের প্যাগোডা।
তবে দু'টো উপ-পিরিয়ডেই অবারিতভাবে বুদ্ধের আচার সংস্কার আসতে থাকে।
Taika Reforms:
এটা একটা তত্ত্ব যা লেখা হয়েছে সম্রাট কোতোকু'র কর্তৃপক্ষের তত্বাবধানে।
সম্রাট কোতোকু জন্মঃ ২২ এপ্রিল, ৫৯৬ AD মৃত্যুঃ নভেম্বর ২৪,৬৫৪ AD
এর কারণ ছিল সম্রাটকে ক্ষমতার কেন্দ্র করা এবং তার দরবারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সম্রাট এর নাম দিয়েছিলেন তাইকা যার অর্থ " বড় পরিবর্তন "।
চীনা কনফুসিয়াসের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে তাইকা রিফর্ম শুরু হয় ভূমি দিয়ে। সম্রাটের দরবার ছিল চীনা সরকারের কাঠামো অনুকরণে তৈরি করা। এসময় জাপানি সম্রাট কোতোকু তার দরবারের অনেক পন্ডিত মানুষকে চীনে পাঠিয়েছিলেন চীনা বর্ণ-মালা, বুদ্ধ-বাদ, সাহিত্য, স্থাপত্য, কৃষি, চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য। এই অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব আজ পর্যন্ত জাপানের সংস্কৃতিতে পাওয়া যায়।
আনুষ্ঠানিক ভাবে বৌদ্ধধর্ম চালুঃ
নিহোন সুকি'র মতে জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম চালু হয় ৫৫২ খ্রিষ্টাব্দে, আবার যুবরাজ শোতোকু'র আত্মজীবনী থেকে জানা যায় ৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।
যুবরাজ শোতোকু।
যদিও জাপানে অনেক আগে থেকেই কোনো কোনো গোত্র বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল, তবে এই সময়েই তা ব্যাপকতা পায়। তবে এই বৌদ্ধ ধর্ম জাপানের সবাই বলা মাত্র মেনে নেয় নি। অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে।
তবে সব মিটে যাওয়ার পর জাপান থেকে চীনে একটা কুটনৈতিক দল গিয়েছিল।
জাদুঘরে সংরক্ষিত আসুকা আমলের জিনেসের কিছু ছবি দিলাম নিচে।
kannon
sarira
sariracontents
shokannon
আসুকা পিরিয়ডে যে সরকার ব্যবস্থা ছিল তাকে বলা হত গোকিশিচিদো। এর আইন-কানুনগুলো চীন থেকে ধার করা। গোকিশিচিদো ছিল পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করা যারা ৭ টি সার্কিটে উপ-বিভক্ত ছিল। আবার সার্কিটগুলো বিভক্ত ছিল অনেক উপ-প্রদেশে। এই ব্যবস্থা প্রায় ৭০০ বছর টিকে ছিল।
এতেই শেষ হল আসুকা পিরিয়ড।
আমার উদ্দেশ্য প্রাচীন জাপান নিয়ে লেখা। প্রাচীন জাপান কোফুন পিরিয়ডেই শেষ। তাই এটাই এই সিরিজের শেষ কিস্তি।
কোফুনের পর জাপান তার ক্লাসিকাল যুগে ঢুকে যায়। আর এই ক্লাসিকাল যুগ শেষ হলে জাপান সাম্রাজ্য চলে আসে। যেখান থেকে জাপান আধুনিকতার দিকে এগোতে থাকে।
ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে অনেক। ' মন্তব্যে জানাবেন চোখে পড়লে।
আগের কিস্তিগুলোর লিংক
প্রাচীন জাপান --- ১
প্রাচীন জাপান --- ২
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৮