আমরা অনেক কিছু করতে পারি না, অনেক কিছু শেখা বাকি, অনেককিছুতে দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। কিন্তু একটা বিষয় আমরা খুব ভালো পারি। সেটা আমাদের মতো আর কেউ পারে না। অন্য কাউকে যদি সেই দক্ষতাটা অর্জন করতে হয় তাহলে বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম ও চর্চা করতে হবে, তারপরেও সেটা আমাদের পর্যায়ে যাবে না।
সেটা কী?
আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা নিয়ে অবশ্য কাউকে গর্বিত মনে হয় না। অত্যন্ত কম প্রভাবশালী একটা ভাষা। কিন্তু বাঙালিত্ব থেকে বের হবার কোনো উপায় আমাদের নেই। হয়ত বা ময়মনসিংহে একদল লোক আরবি লেখা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করতে পারে, কিন্তু ব্যথা পেলে তাদের বাংলাতেই চিৎকার করতে হবে “বাবা গো!” বলে , কিংবা পার্শ্ববর্তী জেলার মিষ্টির তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে হলে বলতে হবে “আমরার মন্ডার উপ্রে কিছু নাই”।
উত্তরের দিকে গেলে “আমরার” হয়ে যাবে ‘হামার’ আর দক্ষিণে “আংগো”। কিন্তু কুড়িগ্রামের একজন মানুষ কুমিল্লার চায়ের দোকানে বসে গুলতানি চালিয়ে যেতে কখনই দ্বিধায় ভুগবে না, মাছের যেমন আছে জল, তাদের দুজনের মধ্যে আছে ভাষার সেতু। তখন হয়ত ঢাকা থেকে ভালো ইংরেজি জানা একজন তরুণ এসে বসেছে, কানে হেডফোন লাগিয়ে মগ্ন, শুনছে গানস এন রোজেস। বাংলা গান, সিনেমা, ভাষা কোনোকিছুই তার ভালো লাগে না। সেও কিন্তু মনের ভেতর বাংলা ভাষাতেই শব্দ বুনে চলেছে “এই বালের জায়গাটা থেকে কবে যে ফিরব ঢাকায়, ভাল্লাগে না!”।
তার সাথে কোনো একদিন দেখা হবে একজন আমেরিকান মধ্যবয়স্ক মহিলার। ভদ্রমহিলা চমৎকার বাংলা শিখেছেন। বাংলাকে ভালোবাসেন। কিন্তু বাংলার প্রতি উদাসীন, ইংরেজিকে ভালোবাসা সেই যুবকের কানে ঠিকই বাজবে মহিলার বাচনভঙ্গির খুঁতগুলি। বাঙালির বাংলা বলা আর বিদেশীর বাংলা বলা কি কখনও একরকম হতে পারে? বাংলাকে ভালোবাসা , ভালোবেসে বাংলা শেখা কোনো ভীনদেশীই একজন বাংলাভাষীর সমতুল্য না, এবং হতে পারবেও না কখনও।
বাংলা ভাষা আমাদের কসরত করে শিখতে হয় না। শ্বাস নিতে যেমন শিখতে হয় না, যেমন শিখতে হয় না পানি পান করার নিয়ম। আমাদের কসরত করে শিখতে হয় ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষা। সেই যে কেজি ক্লাস থেকে শিখছি, শেখা শেষ হয় না! নতুন ভাষিক দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীকে চিনছি। উপভোগ করছি উন্নত চলচ্চিত্র, গান, বই, কার্টুন, মিম। এসবের মধ্য থেকেও মনে হয় বাংলার সূক্ষ্ণ থেকে সূক্ষ্ণতর কারুকার্য জানার, বোঝার ও প্রয়োগ করার আনন্দের মতো আর কিছু নেই, এই দক্ষতাটা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অগুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হলে হোক!
বাস্তবতা হচ্ছে, আপনি, কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার মুদী দোকানদার অথবা ঝালকাঠির বিকাশ এজেন্ট এবং আমি-আমরা কেউ বাংলা ভাষা জানার দক্ষতাটাকে আর কোনো দক্ষতা দিয়েই প্রতিস্থাপিত করতে পারব না। বাস্তবতা হচ্ছে, আরবি লেখা কালো পতাকা উত্তোলন করা অথবা ইংরেজি টি-শার্ট পরা আপনার স্বপ্নের মধ্যে যখন প্রাক্তন প্রেমিকা বিলকিসকে মনে পড়বে, তখন আপনি বাংলাতেই ডুকরে কেঁদে উঠবেন “কই গেলা তুমি বিলকিস! ফিরা আসো”- বলে।
বাংলা ভাষায় কথা বলার চেয়ে আর কোনো কিছু আপনি ভালো পারেন না, আমিও না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৪:৪৪