তার সাথে আমার যখন দেখা হয়েছিল, তখনও এই শহরে মেট্রোরেল আসে নি। লোকাল বাসে করে যাতায়াত করি মিরপুর-মতিঝিল-মিরপুর। ক্লান্তিকর। সেদিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও সরাসরি মতিঝিলের বাস পাই নি । তাই বাধ্য হয়ে গুলিস্তানের বাসে উঠে বসেছিলাম। লোকাল বাসে জানালার পাশের সিটকে “উইন্ডো সিট” বলে মহিমান্বিত করার কিছু নেই। বরং জানালার পাশ থেকেই ফোন কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সহজ। শীতের দিন নয় যে জানালা বন্ধ রাখা যাবে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে একটু ফোন না গুঁতোলে সময় কাটবে কীভাবে তাই ভাবছিলাম! আমার পাশে একটি মেয়ে বসল। আমি জানালা থেকে ফোন ছিনিয়ে নেয়ার দূরত্ব এবং মেয়েটার স্পর্শ দুটো থেকেই দূরে থেকে কীভাবে ফোনটা রাখা যায় সেই হিসেব কষছিলাম। সেই সময় সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
-আপনি কি অফিসে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ।
আমি উত্তর দিয়েছিলাম।
এতদিন ধরে এতবার ঢাকার বাসে উঠেছি, কখনও কোনো মেয়ে কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া নিজ থেকে কথা বলে নি। এরও নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো দরকার আছে। সে কখন সেই প্রসঙ্গ ওঠাবে অপেক্ষা করছিলাম। দেখা গেল তার তেমন কিছু দরকার নেই। সে এমনিতেই কথা বলতে ভালোবাসে। অফিসে যেতে দেরি হলো কেন, দেরি করে অফিসে গেলে বেতন কাটবে না কি না এসব নিয়ে তার উদ্বিগ্নতা নেই বটে, সে এমনিতেই জানতে চাইছিল, হয়তো বা সময় কাটানোর জন্যে। আমিও খুশি হয়েছিলাম। বাসের মধ্যে প্রায়ই কারো না কারো সাথে আলাপ-সালাপ হয়, তবে তারা বেশিরভাগই জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত, দেশ এবং সমাজের প্রতি বিরক্ত রাগী মধ্যবয়স্ক মানুষজন। তাদের সাথে কখনও খাজুড়ে আলাপ হয় নি। খাজুড়ে আলাপের জন্যে এই মিষ্টি মেয়েটাই উপযুক্ত।
সে কথা বলে চলছিল। কথা বলতে ভালোবাসে সে, কিন্তু বাচাল না। অনেক কথা বলে, কিন্তু হরবর করে না। শ্যামলী আসতে আসতে আমি জেনে গিয়েছিলাম যে তাদের বাসার বড়ই গাছটা তার নানা লাগিয়েছিলেন এবং এখনও তা চমৎকার ফল দিয়ে যাচ্ছে। তার পড়ালেখা শেষের পথে এবং সে চাকরি নিয়ে এখনও তেমন কিছু ভাবছে না। সে কিছুদিন বিশ্রাম চায়। আমি সেই সুযোগে নিজের ক্লান্তি আর বিপন্নতার কথা বলেছিলাম, এমনভাবে যেন নিজেকে খুব বেশি দুর্বল বলে প্রকাশ করা না হয়ে যায়, প্যানপ্যানানি মনে না হয়,এবং শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে জাহির করা যায়।
কিন্তু কেন? কী উদ্দেশে?
এর কোনো উত্তর নেই। আমি বিবাহিত, দায়বদ্ধ। কিন্তু পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি তো এরকমই! আসলে আমি কী ভাবছিলাম তখন?
বাস থেকে নেমে গেলে আর কখনও দেখা হবে না তার সাথে। দরকারও নেই। সাজানো গোছানো এই জীবনটায় কেন অযথা দূর্যোগ ডেকে আনব নিমন্ত্রণ করে? কথা হচ্ছে,হোক। যোগাযোগটা আর বজায় না রাখলেই হলো। কথোপকথনটা যেন সেদিকে না যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। এখন তো ফার্মগেট। সে যাবে যাত্রাবাড়ী। আমি নেমে যাব আগেই, গুলিস্তানে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের গাছ, ফুল এবং সবজি নিয়ে কথা বলে ফেলা যাবে। সে তার ছাদবাগান নিয়ে খুব আগ্রহী।
তবে এতকিছুর মধ্যে তার দেশের বাড়ি যশোর এবং নলেন গুড়ের সন্দেশের কথাও চলে এল। সে মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। তবে আমি যেহেতু ফিটনেস বিষয়ক নানারকম কার্যক্রমের সাথে জড়িত, ফেসবুকে শরীর ফিট তো আপনি হিট! নামক গ্রুপও চালাই,তাই গুড ক্যালরি, ব্যাড ক্যালরি এবং ক্যালরিক ডেফিসিট বিষয়ে নিজের জ্ঞান জাহির করা থেকে বিরত রাখতে পারি নি নিজেকে। এও জানিয়ে দিয়েছিলাম যে গত এক বছরে কত ওজন কমিয়ে ঝরঝরে হয়ে গিয়েছি। মেয়েটি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং জানাল যে তারও ওজন কমানো দরকার। তাকে যে আমি সহায়তা করতে পারি এবং পরবর্তীতে আরো যোগাযোগের প্রয়োজনে হোয়াটসঅ্যাপে সংযুক্ত হয়ে যাওয়া প্রয়োজন, এই প্রসঙ্গ তোলার একটা যথাযথ মুহূর্ত চলে এল। কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম।
কিন্তু কিছু কিছু বিষয় যেন প্রকৃতিই নির্ধারণ করে থাকে। ওখানে মানুষের মাতব্বরি খাটে না। তেমন একটা মুহূর্ত এসে উপস্থিত হলো তোপখানা রোডে। অনেকদিন ধরে বৃষ্টির খবর নেই। যদিও এই মেয়েটির কথা বৃষ্টিধারার মতোই স্নিগ্ধ, কিন্তু সে তো আর সত্যিকারের বৃষ্টি না! তার পাশে বসলেও তাই জানালা খুলে দিয়ে জল আর বাতাসের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। বাসটা যখন বিচ্ছিরি এক সিগন্যালে হাঁসফাঁস করছে, কন্ডাক্টর আর যাত্রীরা একে অপরকে গালাগালি করছে, তখন সে বলল,
“ইস, এখন যদি একটু বৃষ্টি নামত!”
তখনই সিগন্যালটা ছেড়ে দিলো, হু হু করে বাতাস বইতে লাগল এবং…
সত্যি সত্যিই বৃষ্টি নামল!
আমি তাকে বললাম,
-আপনি দেখি বৃষ্টি নামাতে পারেন!
সে কিছু না বলে বিহবলের মতো তাকিয়ে রইল।
ততক্ষণে গুলিস্তান এসে গেছে। আমি নেমে যাব। আর আমরা দুজনেই জেনে গেছি যে বৃষ্টি নামার এই মুহূর্তটা আমরা পরবর্তীতে কোনো একসময় আবার রোমন্থন করব। একসাথে।
এই সিদ্ধান্তটা নেয়ার ফলাফল আমার জীবনে ভালো হয় নি। সে কথা আজ স্বীকার করার সময় এসেছে।
কন্ডাক্টর ডাকছে,
-ঐ গুলিস্তান নামেন!
আমি গুলিস্তানে নামব। কিন্তু বৃষ্টিকন্যাকে ফেলে অনেক দূরে চলে যেতে মন চাইছিল না আমার। আমি চাই নি সে আমার জীবন থেকে মুছে যাক।
-নামি?
জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কাছে, যেন অনুমতি চাইছি।
-আচ্ছা।
যেন সে অনিচ্ছাতেই বলেছিল।
আমি আমার মানিব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ডটা বের করে দিয়ে হুড়মুড় করে নেমে গেলাম। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলো। জানতাম না নিয়ে উপায় নেই তার।
এ যেন বৃষ্টির লেখা কবিতা বোনা নকশীকাঁথা…
অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করে রইলাম। তার ফোন বা মেসেজের। কিচ্ছু এল না। অপেক্ষার মুহূর্তগুলি অসহনীয়। সারাদিন কিছু এল না। কেটে গেল আরেকটা ক্লান্তিকর দিন। শেষ হলো অফিস। আমি মনমরা হয়ে আবার উঠলাম বাসে। আর কোনো রূপকথা ঘটল না। ঘটবে না, জানা কথা। তার জীবনে আমি অপাংক্তেয়। সে হয়তো তার ছাদবাগানে পানি দিচ্ছে আর ভাবছে পরীক্ষার পর কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়। তাহলে হাত বাড়িয়েছিল কেন কার্ডটা নেয়ার জন্যে?
আমি বাস থেকে মিরপুর এক নাম্বারে নেমে ওভারব্রিজে করে রাস্তার ওপাড়ে গেলাম। পেঁপে কিনতে হবে। নামার সময় একজন হাতে একটা কার্ড গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করল। তাতে লেখা
“আবাসিক হোটেল
মধু ভাই
আসার আগে ফোন করে আসবেন”
প্রতিদিন এইসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। বিরক্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে নেমে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ একটা কথা মনে হলো।
আমি তড়িৎগতিতে মানিব্যাগটা বের করলাম। সেখানে আমার ভিজিটিং কার্ড ছিল মাত্র একটাই। এখনও সেটা বহাল তবিয়তেই আছে। কয়েকদিন আগে ওভারব্রিজের এইসব দালালদের কাছ থেকে একটা কার্ড রেখে দিয়েছিলাম সহকর্মী আর বন্ধুদের দেখিয়ে অশ্লীল মজা নেব বলে।
সেই কার্ডটা নেই।
বৃষ্টিকন্যার কাছে আমার ভিজিটিং কার্ডের বদলে মধু ভাই বা চিনি ভাই বা সোনা ভাই,এরকম কারো কার্ড চলে গেছে।
সাধে কী পৃথিবীতে রূপকথা ঘটা বন্ধ আছে?
(গল্প- কার্ড
ভালোবাসার গল্পগ্রন্থ “মেলোডি তোমার নাম” এ এই গল্পটি নেই
মেলোডি তোমার নাম আছে অনুপ্রাণন প্রকাশন এ, স্টল নম্বর ৮৫-৮৬ )
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৯:১৫