দামালের ট্রেইলার যখন মুক্তি পেলো, তখন পিনাকী উশকে দিলো তার চ্যালাদের, যে এই সিনেমায় ইসলামকে হেয় করা হয়েছে। খুব হম্বিতম্বি শুরু হলো, পরিচালক রায়হান রাফির হাতজোড় করার ইমো দেখে মনে হলো সে আত্মসমর্পণ করেছে। পিনাকীও ফাঁপড় নিলো এই বলে যে রায়হান রাফি না কি তার ফরমায়েশ মতো সিনেমায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনেছে।
গতকাল মুক্তি পেলো সেই সিনেমা। না, পিনাকীর হুমকি-ধামকিতে কিচ্ছু পরিবর্তন হয় নি। এবং মজার ব্যাপার, তার চ্যালা-চামুন্ডারাও সব হাওয়া। হুজুগে নেচে তারা ফিল্ম বর্জন করবে, হ্যান করবে ত্যান করবে এইসব তর্জন গর্জন করলেও সেগুলি এখন উধাও। দর্শক আসছে, উপভোগ করছে। ভবিষ্যতে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি নির্মাণ করবেন, তারা এই কেস স্টাডিটা মাথায় রাখতে পারেন।
এই বছরে বেশ কিছু ভালো বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে। যেমন হাওয়া, রেহানা মরিয়ম নূর, বিউটি সার্কাস। হাওয়া ভিজুয়ালি সুন্দর। ক্রাউড প্লিজিংয়ের এলিমেন্টও আছে। রেহানা মরিয়ম নূর খুব ভালো ছবি, তবে এই ছবি এক মাস ধরে হলে চলবে, এটা মনে হয় পরিচালক নিজেও আশা করেন না। এসব ছবি চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতেই ভালো মানায়। বিউটি সার্কাসে কিছু স্মরনীয় মুহূর্ত আছে, তবে এটা নান্দনিকতা এবং বক্তব্যের দিক দিয়ে যতটা বলিষ্ঠ দর্শক টানার ক্ষেত্রে অতটা না। পুরোনো কিছু হাইপড ছবির কথা বলি। দেবী এবং আয়নাবাজী সিনেমা হিসেবে ভালো, তবে ওরকম না যে পুরা সময়টা দর্শককে নানারকম অনুভূতির দোলাচলে ওঠানামা করাতে পারবে।
দামাল হলো সেই সিনেমা, যেরকম সিনেমা আমরা পয়সা কেটে হলে গিয়ে দেখতে চাই, এবং আরেকবার দেখতেও বোর হবো না। আমি আরেকবার দেখবো। প্রথমবার বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখেছি, দ্বিতীয়বার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখবো।
আমাদের চলচ্চিত্রের অতীত ইতিহাস এতই ম্রিয়মাণ, যে একটু ব্যতিক্রম, একটু ভালো কিছু করলেই আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি এবার বাংলা সিনেমা জাতে উঠে গেলো বলে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি অমুক সিনেমা এসে প্রথমবারের মতো কোন কাজটা করে ফেলেছে। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে দামাল প্রথম নয় কোনোদিক দিয়েই।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি প্রথম ছবি না এটা।
ফুটবল নিয়ে তৈরি প্রথম ছবিও না।
সিনেমাটোগ্রাফি ভালো, অভিনয় ভালো, গান ভালো, কস্টিউম ডিজাইন, সেট সবই ভালো। কিন্তু এমন কিছু কি, যা আগে আমরা কখনও দেখি নি?
না।
কিন্তু দামাল অত্যন্ত উপভোগ্য। দামালের মধ্যে আছে সেই অতিপ্রত্যাশিত “হুকিং এলিমেন্ট” বা ধরে রাখার ক্ষমতা, যা বাংলা সিনেমায় প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। সিনেমা শুরু হবার পাঁচ মিনিটের মাথাতেই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠলৈ টাইটেল লোগো, সাথে একটা আপলিফটিং মিউজিক। তখন প্রথমবারের মতো আমরা সবাই হাততালি দিলাম। এর পরে আরও অনেকবার হাততালি দিতে হয়েছে। গত দশ বছরে যত বাংলা সিনেমা দেখেছি হলে গিয়ে তার সবগুলির হাততালি যোগ করলেও দামালের সমান হবে না।
ইংরেজিতে কী যেন একটা বিচ্ছিরি শব্দ আছে, গুজবাম্প না কী, মনের একটা অতি আবেগীয় অবস্থা প্রকাশ পায় ঐ শব্দটা দিয়ে। ভালো বাংলা বিকল্প না পাওয়ায় এই শব্দটাই ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। গুজবাম্প হয়েছে অনেকবার। চোখ মুছতে হয়েছে, গলার কাছে দলা আটকে এসেছে। সাধারণত সিনেমা দেখে এতবার এ ধরণের অনুভূতি হয় না আমার। দামাল দেখে হয়েছে।
বিশ্ব সিনেমার অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র দেখেও এরকম হয় নি। আসলে এই গল্প, এই বাস্তবতার সাথে আমি যেভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারবো, ভীনদেশের গল্পে ঠিক সেভাবে পারা যাবে না। লুঙ্গি পরা ছেলের গাছ থেকে পড়ন্ত ডাবকে লাত্থি মারতে গিয়ে আহত হওয়া, রান্নাঘরে চা বানাতে থাকা নববধূর রাগ ভাঙানোর জন্যে সেই দুরন্ত ছেলের ঘুরঘুর করা, আবার ড্রইয়িংরুমে বসে থাকা বাবা যেন কিছু টের না পায়, এজন্যেও সতর্ক থাকা, এরকম পরিস্থিতি আমার যত পরিচিত, দুজন ইতালিয়ান নাগরিকের মধ্যে পিজা অথবা কফি নিয়ে আলোচনা ততটা এলিয়েন না হলেও আমরা কখনই একজন ইতালিয়ানের মতো করে সেই স্বাদ উপভোগ করতে পারবো না! তাই ভালো করে বানালে বাংলাদেশী সিনেমা আমাদের যা দিতে পারবে, বিশ্ব সিনেমার কাছে তা পাওয়া যাবে না।
দামাল প্রথম অর্ধে চরিত্র চিত্রনের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। খুনসুটি, রসিকতা, দূরন্তপনা, পারিবারিক বন্ধন, এসবের পরিমিত ব্যবহারে মূল চরিত্রগুলির প্রতি মমতা তৈরি করেছে। ফলে, বাকি সময়টায় চরিত্রগুলির জীবনে যেসব উত্থানপতন ঘটবে সেসব দর্শক অনুভব করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি হলেও এখানে হিউমার আছে, দুষ্টুমী আছে, রক মিউজিক আছে,এমন কি এন্ড ক্রেডিটের সময় আইটেম সংও আছে। ভারী ভারী কথায় ভারাক্রান্ত না। উপভোগ্য, এবং ফিল গুড অনুভূতি দেয়।
বাংলাদেশী নায়ক নায়িকাদের সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে দামাল অনন্য। রাজ, সিয়াম, মিম সবাইকে খুব সুন্দর লেগেছে। স্ক্রিপ্ট রাইটার নাজিম-উদ-দৌলা ছোট ছোট সিচুয়েশনাল হিউমার ব্যবহার করে গল্পের চলার পথকে মসৃণ করে দিয়েছে।
যা যা ভালো লাগে নি
ইন্তেখাব দিনারের অতি অভিনয়। যৌবনকালের অংশে সে মানানসই ছিলো। কিন্তু যখন যে বৃদ্ধ কথকের ভূমিকায় আসে, তখন তার আলগা উইগ থেকে শুরু করে কাঁপা কাঁপা গলা- কোনোটাই ভালো লাগে নি।
সংলাপ কিছু কিছু জায়গায় অতি মেলোড্রামাটিক ছিলো।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের প্রক্রিয়াটা আরও ভালোভাবে দেখানো উচিত ছিলো।
হাসনা চরিত্রের একটি অতি অপ্রোয়জনীয় এবং অবাস্তব টুইস্ট দেখানো হয়েছে (যুদ্ধের ময়দানে না থেকেও কৌশলে পাক হানাদার হত্যার একটি অংশ, যা হলিউডের চিজি থ্রিলারগুলিতে মানায় কেবল, তবে ক্রাউড প্লিজার হিসেবে চমৎকার ছিলো)।
ফুটবল দলের তিনটি চরিত্রকে ফোকাস করা হয়েছে, ঠিক আছে, কিন্তু বাকি খেলোয়াড়েরা প্রায় অদৃশ্য ছিলো। বলছি না তাদেরও চরিত্র চিত্রন, নেপথ্য কাহিনী এসবের দরকার ছিলো, কিন্তু তারা টিম মিটিং বা এসমস্ত জায়গায় ডামির মতো চুপ করে না থেকে কিছু কথাবার্তা বলতে পারতো! মানে বলিয়ে নেয়া উচিত ছিলো আর কী!
বিউটি সার্কাস এবং দামাল, পরপর দুইটি সিনেমায় নারী জাগরণ এবং সমাজের প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলি এলো। তাও আবার এমন সময়ে, যখন নারী ফুটবল দল সাফ চাম্পিয়ান হলো। বিশেষ করে দামালের সাথে বিষয়টা এতো ভালোভাবে মিলে গেছে, যে মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে এর স্ক্রিপ্ট লিখতে বসে গিয়েছিলেন। নারী ফুটবল দলের ছাদখোলা বাসে শহর পাড়ি দেয়ার দৃশ্যটা যোগ করে দেয়ার অসাধারণ সুযোগটি লুফে নিতে তাই দামাল টিম ভুল করে নি!
মুক্তিযুদ্ধ হলো অন্যরকম একটা সময়ের অন্যরকম মানুষদের গল্প। আমরা, এই আমরাই সে সময়ে কী অবিশ্বাস্য আত্মত্যাগ আর আর বীরত্বের পরিচয় দিয়েছি, সেটা ভাবতে অবাক লাগে। আসলে একেকটা সময় এসে এক ধরণের বিশেষ মানুষ তৈরি করে, যেটা আর পরবর্তীতে পুনর্নির্মাণ করা যায় না। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা খেলার আগে জেদ ধরেছিলো বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে নামবে, জাতীয় সঙ্গীত প্রচার করতে হবে। এমন কি তারা পাকিস্তানের পতাকাও পুড়িয়েছিলো। খেলার মধ্যে তারা রাজনীতি মেশাতো। আর এখন? অবশ্য এখনকার খেলোয়াড়েরা খেলার আগের দিন টাকার বিনিময়ে প্রীতিভোজে গিয়ে বিরিয়ানি সাঁটিয়ে আসে। কাকে কী বলবো!
তো, যা গেছে তা যাকগে। সেরকম নেতাও পাবো না, সেরকম যোদ্ধাও পাবো না। যুদ্ধের ময়দান থেকে নিয়ে এসে ফুটবল খেলতে নামিয়ে দেয়ায় মন খারাপ করার মতো আশ্চর্য চরিত্র হয়তো আর নেই, তবে তাদের এই বিরোচিত উপাখ্যানগুলি বলার মতো মানুষ আছে। সিনেমার হলে যেটুকু আর্টিস্টিক স্বাধীনতা নিয়ে, গ্ল্যামার ব্যবহার করে এ ব্যাপারগুলি প্রদর্শন করা যায়, দামাল সিনেমা সেই স্বাধীনতা ব্যবহার করে দর্শকদের জন্যে দিয়েছে একটা দারুণ রোলার কোস্টার রাইড!