(১)
আমার ছেলে অভ্র ইদানিং প্রায়ই বায়না ধরে মাংস খাবে বলে। মুরগীর মাংস হলে একটা কথা ছিলো, কিন্তু তার বায়না রেডমিটের। গরু বা খাসীর মাংস চাই তার। এখানে আমার প্রবল আপত্তি আছে। আমাদের পরিবারে কেউ খুব বেশিদিন বাঁচে না। আমার বাপ-দাদা-চাচারা সবাই মোটামুটি ৪৫থেকে ৫৫'র মধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। এর পেছনে তাদের বাজে খাদ্যাভ্যাস ছিলো প্রধানতম কারণ। তারা সবাই ধরে সাঁপটে রেডমিট খেতেন। আমি এই মধ্যতিরিশে এসে ব্যাপারটার উপলদ্ধিগত দিকটা অনুভব করি। নাহ! ইতিমধ্যেই আমার কোলেস্টরেল বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। লিপিড প্রোফাইল খুব একটু ভালো কোনো বার্তা দেয় নি। তাই বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতেই হলো! শুধু আমি যে বাদ দিয়েছি তা না। পরিবারের সবার ওপরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি। সবাই বলতে আমার স্ত্রী হরিণা, আর আমাদের ছয় বছরের ছেলে অভ্র। অভ্রই বেশি ঝামেলা করছে। যদিও আমি তার সব আবদারই পূরণ করার চেষ্টা করি, কিন্তু এক্ষেত্রে আমি অনড়। একদম ছোটবেলা থেকে এই সুঅভ্যাসটি গড়ে তুললে বয়সকালে ছাড়তে এত কষ্ট করতে হবে না আমার মতো। তারপরেও, আদরের একমাত্র ছেলে বলে কথা। হয়তো বা খুব শীঘ্রই তার অনুরোধে আমাকে সাড়া দিতেই হবে। আমিও খাবো অল্প।
(২)
হরিণা ইদানিং খুব ব্যস্ত থাকে। আমার সাথে খুব একটু দেখা হয় না তার। হরিণা বরাবরই একটু বহির্মুখী, অস্থির, চঞ্চল। বিয়ের পর বছর চারেক সে কোন চাকরি করে নি। তাই বলে ঘরেও বসে থাকে নি। বন্ধু-বান্ধব, ভ্রমণ, আড্ডা,রি ইউনিয়ন, প্রভৃতি নিয়ে সে মেতে থাকতো। আমার অবশ্য তেমন কোন আপত্তি ছিলো না এতে। ওকে সেই কলেজজীবন থেকে জানি। হয়তো বা ওর এই চঞ্চল, অস্থির সত্ত্বাটাই আমাকে তার ওপর আকৃষ্ট করেছে। আমি নিজেও তো কম লাফাঙ্গা ছিলাম না! হুল্লোড়ের কোন একটা উপলক্ষ্য পেলেই হলো, আমাকে আর পায় কে! কতবার আধাঘন্টার নোটিশে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে গেছি পাহাড়-সমুদ্রে! এর মধ্যে অনেকবারই হরিণা আমার সঙ্গী ছিলো। আর এভাবেই আমাদের ভালোবাসার শুরু। বিয়ে করার পরে আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার ভেতরের বোহেমিয়ান সত্ত্বাটা অনেকটাই চাপা পড়ে গেলো। আমার তাতে খুব একটা আক্ষেপ ছিলো না। জীবনের প্রয়োজনে নিজেকে বদলে নিতে হয়, এই সত্যের মুখোমুখি হবার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম। আর জানতাম হরিণাও পাল্টে যাবে। আমার অনুমানটাকে সত্যি প্রমাণ করে সে বিয়ের চার বছরের মাথায় একটি চাকুরিতে ঢুকে গেলো।
(৩)
-বাবা, মাংস খাবো।
-হ্যাঁ বাবা, নিশ্চয়ই খাবে। এত অধৈর্য্য হয়ো না।
-কবে খাবো! তুমি সেই কবে থেকে বলছো খাওয়াবে!
-বলেছি যখন, খাওয়াবো তো নিশ্চয়ই বাবা। আমি যখন দেরী করছি, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, তাই না? আমি তো তোমার ভালোর জন্যেই করছি। প্লিজ বাবা, বোঝার চেষ্টা করো! এই হরিণা, ওকে একটু বোঝাও না!
আমার কথা শুনে হরিণা কিছুটা বিরক্তি ভরে ঠোঁট ওল্টালো।
-ওকে কী বোঝাবো! তোমার ব্যাপার স্যাপার আমিই কি ছাই কিছু বুঝতে পারছি? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। ছেলেটা সেই কবে থেকে মাংস খাবে বলছে, ওর এইটুকু আব্দার পূরণ করলে কী হয়!
-আহা... তোমাকে কতবার বোঝাবো, আমাদের বংশে কারো শরীরে মাংস সয় না। সবাই তাড়াতাড়ি মারা যায়। তুমি হয়তো বলবে, একটু খেলে কি হয়! কিছুই হয় না। কিন্তু একটু একটু করেই অনেক কিছু হয়। আমার ছেলে গত প্রায় কয়েকমাস ধরে মাংস খায় না। কিন্তু তার লোভটা কমে নি এখনও। সে সুযোগ পেলেই পেট পুরে মাংস খাবে। আমি চাই ওর মাংস খাওয়ার লোভটা সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হোক। তারপর না হয়...
-হয়েছে বাবা, মানলাম! খুব তুমি জিতসো। মেনে নিলাম তোমার কথা।
আমাদের পারস্পরিক সম্মতি দেখে ছেলে করুণ চোখে তাকালো আমাদের দিকে। আমি মনে মনে বললাম ওকে, খুব শিঘ্রই মাংস খাবে তুমি বাবা। খুব স্বাদের মাংস খাবে। একটু খালি ধৈর্য্য ধরো।
(৪)
ছুটির দিন। রঙিন। অবসর। সে অপর (?)
নাহ সে কেন অপর হতে যাবে? সে কি জানে না আমি অপার হয়ে বসে আছি? এই এতদিন পর একটা ছুটিতে আমরা তিনজন একসাথে। তারপরেও তাকে বেরুতে হলো বিশেষ কাজে? কি এমন কাজ তার?
তার চোখ। অপলক। দেখে যায়। কাকে হায়!
সে অন্য একজনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সন্দেহ। শবদেহ (ভালোবাসার?)। অনুভূতি অসার।
ভাবনারা এলোমেলো। মাথার ভেতরের নিউরনের কোষে কোষে জটিল গিঁঠ। সবকিছুই কি একসময় এমন জটিল হয়ে যায়? এটাই কি পৃথিবীর নিয়ম? ভাবনায় ছেদ পড়লো মাংসের গন্ধে। কাবাবের ঝাঁঝালো গন্ধ। আমার ছেলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার নিজেরই লোভ লাগছে, ওকে কী বলবো? ওর দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিয়ে পিঠ চাপড়ে দেই। যার অর্থ, মাংস আসছে খুব শিগগীর।
(৫)
"এ আমার এক অদ্ভুত খেয়াল বলতে পারেন আপনারা। আমি ঠিক করেছি বাজার থেকে মাংস কিনে না এনে একটা আস্ত পশুই কিনে আনবো। তারপর নিজেই সেটা জবাই করে কাটাছেরা করে ফ্রিজে রেখে দেবো। আর কিছু অংশ রান্না করবো। কেন এরকম করবো? অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি দুই সপ্তাহের জন্যে। বড্ড ক্লান্ত বোধ করছিলাম কিছুদিন যাবৎ। আর আমার কাছে বিশ্রাম মানেই হলো ঘোরাঘুরি করা। হরিণাকে বললাম, চলো সাজেকে যাই। বাংলাদেশের মধ্যে স্বর্গ। সেই কবে গিয়েছি! ও জবাবে বললো যে ওর অফিস থেকে নাকি সপ্তাহ খানেকের একটা ট্যুরে যেতে হচ্ছে বগুরায়। আর জায়গা পেলো না, বগুরা! কি আছে বগুরায়? মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। ওর ইচ্ছায় বা কাজে কোনদিন বাধা দেই নি। এবারও দিলাম না। কিন্তু মনে মনে ফুলতে লাগলাম। তাই দেখে সে নানারকম ন্যাকাবোকা কথা বলে আমাকে বশ মানানোর চেষ্টা করলো। তার পাল্টা হিসেবে আমি খুবই কনফিউজিং আচরণ করলাম। ও ঠিক বুঝতে পারলো না আমি ঠিক কোন টোনে আছি! দ্বিধাগ্রস্ত এবং শঙ্কিত মন নিয়ে সে চলে গেলো শপিং করতে। এরপর আমি শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম এই ছুটিতে বাসায় বসে কী করবো। সম্পূর্ণ নতুন কিছু করবো বলে ঠিক করলাম। আর তখনই মাথায় এলো মাংস কাটার আইডিয়া। মেজাজ মর্জি যথেষ্ট খারাপ। এই ঝালটা না হয় অবোধ পশুদের ওপরেই ঝারবো। খুব একটু খারাপ হবে না ব্যাপারটা। আর ছেলের আব্দারও পূরণ করা হবে। অনেক চিন্তার পর এটাকেই আমার সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান মনে হয়"
(৬)
-আমি যাচ্ছি হান।
-চলো তোমাকে এগিয়ে দেই।
-বেশ তো, চলো!
-তোমার মনে হয় মন খারাপ, তাই না?
-হ্যাঁ, তোমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়াটা... বড্ড অপরাধবোধে ভুগছি।
-আরে বাদ দাও। সময় কাটানোর জন্যে একটা ভালো বন্দোবস্ত করে ফেলেছি আমি।
-কী সেটা?
-বাদ দাও, তোমার শুনতে খুব একটু ভালো লাগবে না।
-আরে, বলো না!
-বাদ দাও না!
আগস্টের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা দরদর করে ঘামছি। সামনে বাঁক ঘুরলেই বাসস্টেশন। হরিণা কি একটু তাড়াহুড়ো করছে?
-আচ্ছা তুমি চলে যাও বরং, হ্যাঁ? বাসস্ট্যান্ডের গরমে তোমার মাথা বিগড়ে যেতে পারে। হিহি।
যেন খুব একটা উচ্চাঙ্গের রসিকতা করেছে এমন ভাব করে সে নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসলো।
-আচ্ছা হান। যাই।
-বাই বাই বেইবি।
-নেভার সে গুডবাই হান! ইউ জাস্ট ক্যান্ট সে ইট।
নেভার সে গুডবাই। জন বন জভির গান। আমার খুব পছন্দের।
(৭)
জবাই করা এবং মাংস কাটার ব্যাপারটা যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। আমি ভাবি নি ব্যাপারটায় এতটা মজা পাবো। আসলে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তো, তাই এমন রক্তাক্ত ব্যাপার আমাকে আনন্দ যোগাচ্ছে। হরিণা... কোথায় তুমি এখন? অভ্র গেছে স্কুলে। ওকে আজকে বলেছি দুপুরে মাংস খাওয়াবো। খুব খুশি হয়েছে বেচারা শুনে। তবে এ মাংস কি ওর ভালো লাগবে? লাগবে নিশ্চয়ই! এতদিন পর আমরা মাংস খেতে যাচ্ছি, পেট ভরে খাবো। বেশ নরম মাংস। পেটের মধ্যে ছুরি ঢোকাতেই উত্তপ্ত লোহা দিয়ে মোম কাটার মত করে আয়েশে ঢুকে গেলো। পায়ের অংশটা ফ্রিজে রেখে দিলাম। ও দিয়ে কাল সকালে নেহারি বানিয়ে পরোটা দিয়ে খাবো। মগজটাও পরোটার সাথে স্ন্যাকস হিসেবে দারুণ হবে। আপাতত আমি রান্না করবো পশ্চাদ্দেশের মাংস। এখানকার মাংসটা সবচেয়ে নরম। কতদিন পর মাংস খেতে যাচ্ছি, জিভে জল এসে যাচ্ছে আমার!
(৮)
-হ্যালো। হ্যালো হরিণা। হ্যালো, কথা বলছো না কেনো? বাসের সময় হয়ে এলো, তুমি কখন আসবে?
ফোনটা ধরে আমি খুব মোলায়েম স্বরে বললাম,
-হরিণা তো আসতে পারবে না, আপনারও আর গিয়ে কাজ নেই। আপনি বরং চলে আসুন আমাদের বাসায়। দুপুরে লাঞ্চের দাওয়াত রইলো।
ওপাশ থেকে অভদ্রের মতো কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলো বেয়াদব লোকটা। যাকগে, কী আর করা! মাংসের সুবাস ছুটেছে। আমি আর অভ্র মিলেই খেয়ে নেই।
-বাবা এটা কিসের মাংস? খেতে কিন্তু খুব টেস্ট!
(৯)
'আপনা মা'সে হরিণা বৈরি' প্রবাদটি চর্যাপদকর্তা ভুসুকু ব্যবহার করেন; তাঁর আবির্ভাবকাল এগারো শতক। চৌদ্দ শতকে বড়ু চন্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এবং ষোল শতকে মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গলে একই প্রবাদ ব্যবহার করেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটলে প্রবাদের ব্যবহার আরও বিস্তৃত হয়। প্রবাদের শ্রেণিকরণ একটি জটিল বিষয়। (উইকিপিডিয়া)
(১০)
লিখেই ফেললাম বিজ্ঞাপনটা। বড় লোভ হয় আবারো মাংস খেতে। সুন্দরীতমা আমার, তুমি অবিশ্বস্ত থেকে আমার মধ্যে ঘৃণার বারুদ জ্বালিয়ে তোমাকে খাবার টেবিলে পরিবেশনযোগ্য করে ফেলো!
পাত্রী চাই
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরিরত মাসে ছয় অংকের বেতনপ্রাপ্ত ৩৪ বছর বয়সের বিপত্নীক পুরুষের জন্যে সুন্দরী, পৃথুলা, অবিশ্বস্ত পাত্রী চাই।
ভালো হয়েছে না লেখাটা?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪১