কোথায় যেন ঘন্টা বাজছে। ধীরলয়ে। থেমে থেমে। একটা গম্ভীর আবহ তৈরি হয়েছে। একটা বিশাল বিষাদী উৎসবের আয়োজন করছে কারা যেন। কোথায় ঘন্টা বাজছে? কেন বাজছে? শেষরাতের তন্দ্রা কেটে যায় আমার। অনেকদিন আমি ঘুমুতে পারি না রাতভর। শেষরাতের দিকে তন্দ্রামতন আসে, ব্যাস এটুকুই আমার ঘুম। এই মহা মূল্যবান তন্দ্রাটুকুও কেড়ে নিলো ঘন্টার মন্দ্র ধ্বনি। কিন্তু আমার মোটেও রাগ হচ্ছে না। কেমন যেন সম্মোহিতের মত শুনতে থাকি আমি, উঠে বসি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঘন্টার দিক নির্ণয়ের চেষ্টা করি। কিন্তু ওপাশে কেবল অন্ধকার। অন্ধকারের আড়ালে ঘন্টাধ্বনিটা আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে। মনে হয় কে যেন আমাকে ডাকছে। হঠাৎ করে আমার বুকটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। জানালা দিয়ে অসংখ্য অন্ধকার ঘুটঘুটিয়ে প্রবেশ করে। আমার ইনসমনিয়াগ্রস্ত রাত অন্ধকারের সাথে আঁতাত করে আমাকে ঠেলতে থাকে আরো গহীনে, যেখান থেকে ঘন্টাটা বাজছে। আমার শূন্য বুকের ফাঁকা জায়গা দখল করে নেয় দুর্বৃত্ত অন্ধকার। ওরা আমাকে জেঁকে ধরেছে। আর নিস্তার নেই। ঘন্টাধ্বনিটা এগিয়ে আসছে। আমি নিকষ কালো আঁধারের খোঁজে অভিযানরত এক মোহগ্রস্ত অভিযাত্রী। কেমন যেন নেশা নেশা লাগে আমার। এভাবে কেউ ডাকতে পারে? এভাবেও ডাকা যায়? এতদিন কেন ডাকে নি? নাকি ডেকেছে আমিই বুঝি নি? কে ডাকছে আমায়? পুরোনো শ্যাওলা ধরা পুকুরঘাটের সিঁড়িতে একবার পা পিছলে পড়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম। এখন কেন এসব কথা মনে পড়ছে? তবে কি আমার এই যাত্রা মরণের অভিমুখে? অনেকদিন আগে, আমার কিশোরবেলায় রক্তসম্পর্কের একজন আত্মীয় আমার সাথে কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছিলো, তখন সেটা বুঝি নি, এখন জানি সেটাকে বলা হয় যৌন হয়রানি। এই ঘন্টার আওয়াজটা কেন মনে করিয়ে দিচ্ছে এসব? তবে কি আমার এই যাত্রা আরো একবার নিষ্পেষিত হবার জন্যে? ঘন্টার আওয়াজটা পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন দুটি আওয়াজের মাঝখানের সময়টা আরো বর্ধিত হয়েছে। স্তব্ধ রাত্তিরে এই অতি স্লথ ঘন্টাবাদন মনের ওপর চাপ ফেলছে প্রচণ্ড। নানা দুর্বিপাকে ক্ষয়িষ্ণু আমার স্নায়ু আর কতক্ষণ সইতে পারবে এই ভুতুড়ে মেলোডি?
আমি যখন ঘন্টাটার কাছে পৌঁছুলাম, তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। ওটা টাঙানো ছিলো একটা প্রাচীন, পরিত্যক্ত বাড়ির সদর দরজায়। একজন বৃদ্ধ ঘন্টাটি বাজিয়ে চলেছেন নিরলস। কিন্তু আমি যখন পৌঁছুলাম, তখন সে ঘন্টাটি খুলে রাখার উপক্রম করছে। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বাধা দিলাম,
=এই যে জনাব, ঘন্টাটি খুলে রাখছেন কী মনে করে? আমি সেই কতদূর থেকে এসেছি এটার আহবানে।
=বাছা, তুমি কি এই প্রথম এই ঘন্টাধ্বনি শুনলে?
=হ্যাঁ!
=অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে। এই ঘন্টাধ্বনি সবাই শুনতে পায় না। আর শুনলেও অনেকেই এর কাছে আসতে আসতেই হয়রান হয়ে যায়, অথবা হদীশ পায় না।
=কী আছে এই ঘন্টাধ্বনির ভেতরে? কেন এর আওয়াজে আমার মন এমন উচাটন হয়?
=ধৈর্য্য ধরো, সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।
বুড়ো অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ঘন্টাটি নিয়ে ভেতরে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিলেন।
ব্যর্থ এবং প্রত্যাখ্যাত আমি ভগ্ন হৃদয়ে বাসার পথে রওনা দেই। গোসল করে, দাড়ি কামিয়ে অফিসে যেতে হবে।
অফিসের কাজে মন দিতে পারি না। বারবার ভুল হয়ে যায়। সহকর্মীদের টিপ্পনি অসহ্য লাগে।
=কী মিয়া! এত অমোনোযোগী কেন? রাইতে ভালো ঘুম হয় নাই? আইচ্ছা, ভাবীরে অনেক রাত পর্যন্ত জাগায়া রাখেন নাকি? তা অবশ্য হবারই কথা। ইয়ং ম্যান...
চিঠি আর আমি এখন আর একসাথে থাকি না। সে কথাটা ওদেরকে বলা বৃথা। এদের সবগুলোর মাথায় আদিম প্রবৃত্তি কিলবিল করে। খালি সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। জানি তো, যদি বলি যে আমরা আর একসাথে থাকি না, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া হবে এমন,
"ভাবী চইলা গেছে? কেন কোনো সমস্যা আছে নাকি আপনার?" বলে চোখ টিপ দিয়ে কদর্য একটা ভঙ্গি করবে। মাদারচোৎ সবগুলো।
দেখতে দেখতে লাঞ্চ আওয়ার হয়ে যায়। খেতে গিয়ে কিছুই ভালো লাগে না। রূচিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। খাবারগুলো একটু নাড়াচাড়া করে রেখে দেই। আজ কেন যেন চিঠির কথা খুব মনে পড়ছে। এজন্যে অবশ্য পান খেয়ে দাঁত নষ্ট করা, আর পিক মুখে নিয়ে কথা বলা সেইসব প্রৌঢ় কর্মচারীদের ভূমিকা আছে। অনেকদিন চিঠির কথা ভাবি না। ভেবেই বা লাভ কী! যে সেচ্ছায় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, সে কি ফিরে আসবে আবার? মনে পড়ে...
যখন আমরা তরুণ ছিলাম, যখন আমাদের প্রাণশক্তি অনেক বেশি ছিলো, যখন আমরা লেকের ধারে বসে গোধূলিবেলায় অস্তগামী সূর্যের ছায়া দেখতাম তন্ময় হয়ে, যখন ট্যাক্সিক্যাবের ভেতরে বন্য চুম্বনে জাগ্রত হতো আমাদের শরীর, যখন আমরা নিজেদের বলতাম wildest couple of the city, সেই সময়টা আমাদের বৈবাহিক জীবনে অনুদিত হয় নি। কত কিছু নিয়ে খিটিমিটি লেগেই থাকতো। এলোচুল, এলোপ্যাথি, কাঁচপুতুল, হোমিওপ্যাথি, প্রেগনেন্সি, লোকে বলে ছিহ, কনডম, বোরডম, সবুজ পার্ক, ঘাতক ট্রাক, কত কিছু নিয়ে বাদানুবাদ! আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে জমতে জমতে সম্পর্ক ভাঙার বোমালয়ে অত্যন্ত বিপদজনক অবস্থানে চলে যায়। আর সেই সাথে কিছু জটিল এবং বড় সংঘাত বাড়তে থাকে।
=তুমি বর্ষার সাথে ছবি তুলতে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখেছিলে কেনো?
=তুমি ফেসবূকে হেনতেন প্রভৃতি নারীর সাথে চ্যাট করেছো কেন?
=তুমি ছবি তোলার সময় মুখটা রোবটের মত করে রাখো কেনো?
=তুমি আমার মায়ের বানানো জর্দা প্রায় পুরোটা খেয়ে ফেললে কেন? অবশ্য এমনই হবার কথা, তোমার বাবাও এরকম খাওয়ার সময় কারো কথা বিবেচনা করে না।
বেশিরভাগ সময় আমি চুপচাপ শুনতাম, কিন্তু আমার বাবাকে নিয়ে, আমার পরিবারকে নিয়ে কটুক্তি করার পর আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। এভাবেই শুরু। তারপর ব্যক্তিত্বের সংঘাত, এবং আরো, আরো অনেক ছোটখাটো বিষয়ের সম্মিলনে আমাদের এই সেপারেশন।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে শাওয়ারটা নিয়ে বিছানায় শুয়েছি কি শুই নি, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি। আহা! কী নিশ্চিন্ত, প্রশান্ত একটা ঘুম! অনেকদিন পর এমন ঘুমোতে পারলাম আমি। ঘুমের মাঝে নানারকম স্বপ্ন দেখলাম, আজগুবি। তবে একটা স্বপ্ন ঘুরেফিরে বারবার আসছিলো, সেই ঘন্টা বাজানো বুড়োটি। তার খ্যানখ্যানে স্বরে আমাকে বলছিলো, তোমার সময় হয়ে আসছে বাছা, প্রস্তুত হও!"
রাত বারোটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। হু, এইবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলা যায়। ঘন্টা বাজতে আরো কয়েক ঘন্টা দেরী আছে বোধ হয়। ততক্ষণ কী করবো? চিঠির কথা ভাবা যাক বরঙ। এটা ঠিক, আমার মধ্যে অনেক দোষ ছিলো। আমি ছিলাম দায়িত্বজ্ঞানহীন একজন পুরুষ। ভবিষ্যতের কথা মোটেও ভাবতাম না। পানাসক্তি ছিলো। কিন্তু আমি চেষ্টা করছিলাম এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে। যখন আমি ভাবতে শুরু করেছি যে আবার সেই নিষ্কলুষ দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আমার একটা সামান্য ত্রুটিকে কেন্দ্র করে যাচ্ছেতাই আচরণ করলো। সবার সামনে অপমান করলো আমাকে। আমি তখন...
ভাবনায় ছেদ পড়লো ঘন্টাধ্বনিতে। সেই মাতাল , বিবশ করা সুর! আমি জানলা খুলে দিলাম অন্ধকারদের প্রবেশ তরান্বিত করতে। কিন্তু এ কী! জানলা খোলার সাথে সাথেই আমার এই ক্ষুদ্র ঘরে শুরু হলো আলোর নাচন। কোথায় যেন বাজছে মাউথঅর্গান, সুমধুর। আমি চোখ ভর্তি করে দেখতে শুরু করলাম আলোর নৃত্য। কখনও তারা অশ্বারোহী, কখনও তারা সপ্তর্ষি, কখনও উর্বশী, কখনও ধ্যানী ঋষি। আমি থই খুঁজে পাচ্ছি না। এত আলো আমার এই ভাঙা ঘরে! কেন! ওদিকে ঘন্টাটাও বেজে চলেছে বিরামহীন। আজ আর ঐ ঘন্টা নিয়ন্ত্রক খনখনে বুড়োকে চালাকি করতে দেবো না। চড়ে বসি আলোকঅশ্বতে। দ্রুত ছুটতে থাকে সে। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে আমার। একে তো ঘুমটা ভালো হয়েছে, তারপর সেই রহস্যময় ঘন্টার স্বরূপ উন্মোচিত হতে চলেছে। তারপরেও মনে শঙ্কা জাগে। সবকিছু ঠিকঠাক মত হবে তো? তবে এমন আনন্দভ্রমণে সেইসব উৎকণ্ঠা তৎক্ষনাৎ উবে যায়। ঘন্টাঘরে এসে পৌঁছেছি আমি। বুড়োটা হাঁপাচ্ছে, তবুও এক মুহূর্তের বিরাম নেই। আমাকে দেখে সে তার থ্যাবরানো দাঁত দেখিয়ে হাসে।
=তুমি তো সৌভাগ্যবান বাছা! দ্রুতই ঘন্টাঘরে আসতে পারলে। অনেকেই বছরের পর বছর চেষ্টা করেও পারে না।
=সেদিন তো ভাব দেখিয়ে চলে গেলেন। এখন বলেন তো এর রহস্যটা কী! দয়া করে বলবেন না যে সময় হলেই জানতে পারবো। আমি এখনই জানতে চাই!
=হাহাহা! আরে বাপু, একটু অপেক্ষা না হয় করলে! ক্ষতি কী তাতে! তবে এবার নিশ্চিন্ত হতে পারো যে তোমার জন্যে ভালো খবর আছে।
=ও তাই? তা আপনারা কবে থেকে মানুষদেরকে এই ঘন্টা বাজিয়ে সম্মোহন করে ভালো খবর দেয়ার দায়িত্বটা নিয়েছেন?
=যখন থেকে মানুষের সৃষ্টি, তখন থেকেই। কেউ শোনে, কেউ শোনে না। কেউ সারাজীবন খুঁজে মরে, কেউ না চাইতেই পেয়ে যায়।
=বাই দ্যা ফাকিং ওয়ে, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনারা আমার ম্যারেজ কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার সন্দেহটা কি সত্যি?
=বাহ! বেড়ে বুদ্ধিমান ছেলে তো তুমি! হ্যাঁ অনেকটা সেরকমই। আমরা লটারি করে খুব অল্প সংখ্যক জুটিকে বেছে নেই। তোমরা সুখী হও, এই আমাদের প্রত্যাশা। তোমাদের...
আমি তার কথা শেষ করতে দিলাম না।
=আগে জানলে আমি আসতামই না। যত্তসব ন্যাকামী!
=বলছো বটে, তবে তুমি খুব ভালো করেই জানো যে এটা পুরোপুরি সত্যি না। তোমার মনের কোথাও না কোথাও এখনও কিছু লুকিয়ে আছে, না থাকলে তুমি আসতেই পারতে না। না থাকলে তুমি ঘন্টাধ্বনি শুনতেই না।
তার কথা শুনে আমি নিরুত্তর থাকি। সে কি ভুল বলছে? নাকি আমার চিন্তাই ভুল? তবে কি চিঠি আসবে আজকে?
এসব ভাবতে ভাবতেই চিঠি চলে এলো। আমার মতোই এক আলোকযানে চড়ে। আমার মতো সেও খানিকটা উদভ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত। আমাকে দেখে সংকোচ জড়ানো কণ্ঠে বললো,
=কেমন আছো তুমি?
=ভালো। তুমি ভালো তো?
=এই তো...
অনেকদিনের অনভ্যাসে আমাদের কথা আর এগোয় না।
=তারপর...লেখালেখি করো না কি এখনও?
=এই তো টুকটাক। তোমার টেইলারিং শেখার কদ্দুর?
=চলছে আর কী...খারাপ না।
আমরা দুজনেই বুঝতে পারি হবে না, এইভাবে হবে না। আদৌ কি হবার দরকার আছে? এই প্রশ্নটাও মাথায় ঘোরে। হঠাৎ এক চিৎকারে আমাদের সম্বিত ফেরে। ঘন্টাধ্বনি থেমে যায়। বুড়ো ঘন্টাবাদক বুক চেপে ধরে বসে আছে। চারিদিকের সব আলো নিভে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চড়ুই পাখির টুইটকার, আর অজানা বাদকের মাউথঅর্গান। চারিপাশের সবুজ প্রকৃতি শীতকালের রূক্ষ মরণ থাবায় রঙ হারিয়ে ফেলছে।
আমরা বুঝে ফেলি আমাদের হবে না। তবুও চিঠি একটা শেষ চেষ্টা করে। কিভাবে যে ওর মনের মধ্যে এমন প্রেমভাব জেগে উঠলো তা আমার বাকি জীবনে একটা রহস্য হয়ে থাকবে। আমাকে সে দেখেছে পাঁড় মাতাল, দায়িত্বজ্ঞানহীন, নোংরা, অগোছালো, এলোমেলো হিসেবে। আমার পরিবারকে সে তুচ্ছ করেছে তার পরিবারের সাথে মেলাতে গিয়ে। তারপরেও সে কেন যেন বললো, "দেখো, আরেকটা সুযোগ নেই আমরা। আমার হাতটা ধরো"
হাত ধরাতে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে এই হাত আমাকে কতদূরে নিয়ে যাবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
=কিছু বলবে না তুমি?
আমার চোখে চোখ রেখে সে সুধোলো। আমি বললাম,
=দেখো চিঠি, একসময় ভাবতাম আমাদের সম্পর্কটা নিয়তি নির্ধারিত। আমরা অতীত ভুলে এই মন্ত্রে দিক্ষিত হয়েছিলাম, "তুমি প্রথম, বলি না এমন/ শেষ হতে পারো কি? তাই নিয়েছি শেষবিকেলে নিঃস্ব হবার ঝুঁকি"। কখনও ভুলেও ভাবতাম না আমাদের মধ্যে কোন দেয়াল তৈরি হতে পারে। হ্যাঁ এটা সত্যি, তোমার অনেক চাওয়া আমি পূরণ করতে পারি নি। তোমার নিশ্চুপতা আর স্তব্ধ অভিযোগ মাথা কুটে ঠুকড়ে মরেছে আমার মনের দেয়ালে। কিন্তু যখন আমি ফিরতে শুরু করেছি তোমার কাছে, তখনই তুমি আমাকে মস্ত আঘাতটা দিলে। সবার সামনে আমাকে অপমান করলে, আমার পরিবারকেও ছাড়ো নি। তাই, বলি কি, থাক! "আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে নিয়েছি"। আমি ছাপোষা মানুষ, আমাকে তুমি অপমান করতেই পারো, তার পাল্টা দেয়ার সময় এখনই। দেখো,গত দুইরাতের ঘন্টাধ্বনি এখন উইন্ড চাইমে পরিণত হয়েছে। এভাবেই শব্দেরা হারিয়ে যায়, শোকাতুর শব্দের শবদেহ নিয়ে লাল পিঁপড়ের দল মার্চপাস্ট করে পৌঁছে দেয় ভিমরুলদের কাছে। ওরা হুল ফোটায়। যা বলছিলাম, পাল্টা দেয়ার কথা, আমার এই ছন্নছাড়া জীবন, ঘরের কোণে একাকী বসে আজগুবী চিন্তাভাবনা করা, দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে ওঠা, নতুন কোন গান লেখা, আর নিজেই সেটা সুর করে শোনানো, স্নিকার্স চকলেট ভাগাভাগি করে খাওয়া, বসুন্ধরা সিটিতে থ্রিডি মুভি দেখা, মোহামেডান, বার্সেলোনা, আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে মাতামাতি, পহেলা বৈশাখে টিএসসি, চারুকলা, শাহবাগ, বইমেলার জন্যে ম্যালা বই কেনা হবে বলে টাকা জমানো, কোনকিছুই আর তোমার জন্যে না। ধন্যবাদ তোমাকে ভালোবেসেছিলে বলে, প্রশংসা করি তোমার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়েছো বলে। এখন আমি যাই, কেমন?
চিঠি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো বা দুই এক ফোঁটা অশ্রূ ঝরে তার চোখ থেকে। আমি নিশ্চিত নই অবশ্য। রাত এখনও অনেক বাকি। কী মনে করে যেন ঘন্টাবুড়োটা উঠে পড়ে পাগলের মতো ঘন্টা বাজাতে থাকে। আমার চারিপাশ আলোয় আলোয় ভরে যায়। একটা প্রচণ্ড টান অনুভব করি আমি। তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, আমি জেনে গেছি এই টান অগ্রাহ্য করার শক্তি আমার আছে। আমি এগিয়ে যাই। ঘন্টাধ্বনি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:২২