তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো বছরখানেক আগে। আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম, হঠাৎ করে সিগন্যাল অমান্য করে একটা ট্রাক দ্রুতবেগে আমার দিকে চলে আসতে লাগলো। সামনে বা পেছনে কোথাও যাবার সুযোগ নেই এই গতিদানবের কাছ থেকে মুক্তি পেতে। এই তাহলে মৃত্যু! আমি নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি যন্ত্রদানবের দিকে। ঠিক সেই সময় ট্রাকটি প্রচণ্ডরকম ব্রেক করে থেমে যায় আমার থেকে এক চুল দূরে। চেতনা হারানোর পূর্বে আমি একটা বিষণ্ণ মুখকে দেখি। তার বয়স অনুমান করা দুঃসাধ্য। এই গরমেও একটা লাল মাফলার পরা। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। খাড়া নাক, আর তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে দ্রষ্টব্য হলো জ্বলজ্বল করতে থাকা দুটো চোখ। সে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, "এই বেলা খুব বেঁচে গেলে মেয়ে! তবে তোমার সাথে আমার দেখা হবেই একদিন না একদিন। তৈরি থেকো।"
সেই প্রথম আমার মৃত্যুর সাথে দেখা। এতদিন জেনে এসেছি মৃত্যু একটা বিমূর্ত ব্যাপার, কিন্তু আমার এ ধারণা ভুল ছিলো। আমি তাকে কায়ারূপে দেখেছি। মৃত্যুর সাথে আমার সখ্যতা নতুন নয়। অভিমানী এক বালিকা আমি, সামান্য কারণে গাল ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ডেটল/স্যাভনল খেয়ে মৃত্যুপ্রচেষ্টা করেছি এর আগেও। কিন্তু তখন মৃত্যু আমাকে তার নিজ চেহারায় দেখা দেয় নি। অবশেষে যেদিন দেখা হলো, আমার ভেতর একটা আশ্চর্য অনুভূতির জন্ম নিলো। আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। তার মাঝে রয়েছে একটা নাছোড় ভাব, সে কাউকে পরোয়া করে না। তার আশ্চর্য শীতল দুই চোখে তাকালে হুহু করে ওঠে বুক। সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত মৃত আত্মারা তার মুঠোর ভেতর থেকে এক ভীতিকর সুরে বীণা বাজাতে থাকে। তার খাড়া নাকের ঔদ্ধত্য আর তীক্ষ্ণ কানের বিচক্ষণতায় নৃশংস সুরে অর্কেষ্ট্রা বাজে। আমি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ি। অদ্ভুত এ সুর। ভয়ংকর এ সুর। সবাই এই সুরের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু আমি পারলাম। মৃত্যুর সাথে জীবনের বন্ধনে হাজার আত্মার ক্রন্দন লীন হয়ে থাকে। যদিও বেশিরভাগ মানুষই জীবনের শেষ মুহূর্তে বেঁচে থাকার আকূল অণ্বেষায় আরো একটু সময় বেঁচে থাকার জন্যেই আকূল প্রার্থনায় মগ্ন হয়। মৃত্যু তাদের কাছে এক বিমূর্ত আতঙ্কলিপি। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যে মৃত্যুর নিষ্ঠুর সৌন্দর্যকে অবলোকন করতে পেরেছি। এজন্যে আমি প্রতিদিন সেই ভয়ংকর গতিতে ছুটে আসা ট্রাকটিকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাই।
সেই দিনের পর থেকে আমার কেবল উন্মনা আর উদাস উদাস লাগে। কবে আবার দেখা পাবো মৃত্যুর? কবে তাকে জড়িয়ে ধরবো? কবে তাকে চুম্বন করবো? কবে তার হিমশীতল হাতটা নিজের হাতে ধরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভবে তিরতির করে কাঁপতে থাকবো? এভাবে তার কথা ভাবতে ভাবতে আমি এতটাই মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম যে আবারও আত্মহত্যার চেষ্টা করি আমি। ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে দিই। কিন্তু এরপর অনেক রক্ত ঝরলো, প্রাণবায়ু প্রায় বের হয়ে যাবার উপক্রম হলো, কিন্তু তার দেখা আর পেলাম না। পরবর্তীতে এটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে এই উত্তর পেয়েছি যে, নিজেকে ধ্বংস করে দেয়া বা আত্মহত্যার চেষ্টা করলে সে দেখা দেয় না। ইচ্ছে করলেই তাকে ডেকে আনা যায় না, এমন অহম তার। তবে কেউ যদি নিজের অনিচ্ছায় মারা যেতে থাকে, এবং সে যদি মৃত্যুকে ভালোবাসা দিয়ে বরণ করার জন্যে প্রস্তুত থাকে, তবে সে দেখা দিলেও দিতে পারে। এসব ভাবি আর হতাশায় নুয়ে পড়ি ক্রমশ। কবে তার দেখা পাবো? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেই তাকে চিঠি লেখার। সে হবে আমার পত্রমিতা। মৃত্যুকে পত্রমিতা করার চিন্তা কে কবে করেছে! কিন্তু আমার এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। একদিন এক ঘোর লাগা রাত্তিরে তাকে আমি প্রথম পত্রটি লিখি,
প্রিয় মৃত্যুমিতা,
কেমন আছো তুমি? আমাদের এই অশ্লীল, অসাড় এবং ফূর্তিবাজ জীবন থেকে মুক্তি পেতে খুব ইচ্ছে করে আমার। তোমার শীতল চোখের ভেতর আমি যে অমোঘ আহবান দেখেছি তা নাকচ করার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু তোমার কাছে যাবার উপায়টাও ভীষণ বিটকেলে। কবে না কবে আমার অসুখ হবে, অথবা দুর্ঘটনায় পতিত হবো তা কে জানে! আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে দেখেছি, তাতে তোমার সায় নেই। কেন যে এত দূরত্ব তৈরি করে রাখো! তুমিহীনা আমার প্রতিটি পল কাটছে অপেক্ষার অসহনীয় যন্ত্রণায়। কবে দেখা দেবে আমায়? আমি জানি পৃথিবীতে তোমার খুব ব্যস্ত দিন যায় সবসময়ই। যুদ্ধ, দুর্ঘটনা, অসুখ, আত্মহত্যা, কতরকম ভাবেই না মানুষ মারা যাচ্ছে! বর্ধিত হচ্ছে তোমার রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদের রাণী হয়ে থাকতে চাই আমি। আমাকে অবহেলা করো না প্লিজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা দাও। আমাদের এখানে সবাই তোমাকে ঘৃণা করে, ভয় পায়। প্রেমে ব্যর্থতা, কর্মহীনতা, অভাব, ক্ষুধার তাড়নায় অনেকে তোমাকে কামনা করে। সুখের অসুখে ভোগা ঐশ্বর্যমণ্ডিত জীবন উপভোগ করা মানুষেরাও নানারকম মানসিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে তোমাকে কাছে পেতে চায়। তুমি রোজদিনের নিয়ম করে অফিস করা কেরাণীদের মত তাদের কাছে গিয়ে তোমার কর্ম সম্পন্ন করো। কিন্তু তাদের কাউকে তুমি ভালোবাসো না বা তারা কেউ তোমাকে আমার মত আপন করে দেখে না। সেদিনের সেই সর্বনাশা গোধূলির আলোয় তোমার চোখে আমি আমার সর্বনাশ দেখেছি। এখন পার্থিব বা জীবন্ত সবকিছুই আমার কাছে বিরক্ত লাগে। আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে, তা না করলে অন্তত একবার হলেও দেখা দাও! এক পলকের দেখার সুখে আমি কাটিয়ে দিতে পারবো বাকি জীবনটা।
ইতি
মৃন্ময়ী
চিঠিতো লেখা হলো, এখন পোস্ট করা যায় কোথায়? অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের বাসার পাশের একটা শিউলি গাছে রেখে আসলাম চিঠিটা সকালবেলা। এর পরের কয়েকদিন আমার কাটলো কিশোরীসুলভ চপলতায়। মেয়েরা প্রথমবার প্রেমে পড়লে যেমন আচরণ করে, ঠিক তেমনই ছিলো তা। অধৈর্য্য, অস্থির, চিন্তাক্লিষ্ট, হাওয়াই মনোভাব! যে কেউ আমাকে দেখলেই আচরণের পার্থক্যটা বুঝতে পারতো এবং জিজ্ঞেস করতো, "কী হয়েছে মৃন্ময়ী? এত খুশী কেন? প্রেমে পড়েছো নাকি?"। আমিও কিছুটা রাঙা হয়ে তাদের প্রশ্নগুলিকে চাতুর্যের সাথে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। এরপর হঠাৎ একদিন.... মৃত্যুমিতার কাছে চিঠি পাঠানোর মাত্র তিন দিন পরেই আমি তার জবাব পেলাম। রাতের বেলা বিছানা গোছগাছ করে যখন শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন বালিসটা সরাতেই একটা খাম বেরিয়ে পড়লো। কালচে খয়েরি রঙের একটা খাম, তার ভেতরে একটা চিঠি। আমার আর তর সইছে না পড়ার...
প্রিয় মৃন্ময়ী,
তোমার চিঠি পড়লাম। সত্যি কথা বলতে কী, সেদিন তোমার সেই ভীত হরিণীর মত চাহনি আমাকে একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আমি খুব করে চাচ্ছিলাম ট্রাকটা তোমাকে চাপা দিক, যেন আমি তোমাকে আমার রাজ্যে নিয়ে আসতে পারি। নারীর কারণে কতরকম প্রলয় ঘটে গেলো পৃথিবীতে! এখনও ঘটছে। আমি কখনও ভাবি নি এইসব আমাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করবে। আমি তো আর রক্তেমাংসে গড়া মানুষ না! যদিও তুমি সেদিন আমাকে একটা অবয়বে দেখেছো। আমার নির্দিষ্ট কোনো চেহারা নেই। তোমার দেখাটাই তোমার কাছে ঠিক। আমি কখন কার কাছে কিভাবে আবির্ভূত হই তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। হাজার লক্ষ কোটি বছর ধরে আমার এই পথ চলায় মানবিক বোধে আপ্লুত হইনি কোনোদিন। হওয়ার কথাও ছিলো না। কিন্তু বিধাতার খেয়ালী আচরণে সেটাও সম্ভব হলো! হ্যাঁ, মৃন্ময়ী, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি মৃত্যু, আমার কোনো অনুভূতি থাকতে নেই। আমি বসনিয়া, ফিলিস্তিন, সুদানে গিয়ে শিশু, নারী, যুবা সবার প্রাণ সংহার করেছি, গ্রাম থেকে গ্রামে কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে সেখানে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি, ভূমধ্যসাগরে জাহাজডুবির পর ডুবন্ত মানুষের ছটফটানি বন্ধ করে দিয়েছি নিমিষেই। তারা এখন কোন কবরস্থানে কঙ্কাল হয়ে শুয়ে আছে কে জানে! কিন্তু সেদিন তোমাকে কাছে থেকে দেখে আমার ভেতর একটা অন্যরকম অনুরণন তৈরি হয়েছিলো। তুমি ছিলে একটু বেখেয়াল, তোমার দিকে ছুটে আসছিলো দানবট্রাক। আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম ট্রাকটা তোমাকে ধাক্কা দিক। তারপর তুমি মারা গেলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব আমার প্রাসাদে। সেখানে হাড্ডি,চামড়া, মাংসের সংগ্রহ আছে, নেই কোনো সদ্যমৃতা তরুণীর অভিমানব্যাকুল মুখ। তোমাকে দিয়ে আমি সেই ইচ্ছে পূরণ করতে চাইছিলাম। জানি, প্রকৃতি এমন হতে দেবে না। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। আমার কাছে তোমাকে নিয়ে আসবোই। আমি জানি তুমিও সেটাই চাও। তবে দয়া করে আত্মহত্যা করো না। ঈশ্বরের কাছে এসব ফন্দিফিকির চলে না। সে ঠিক বুঝে ফেলবে আর তোমাকে আমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে রাখবে। আমাদের মাঝে অসংখ্য প্রতিকূলতা, আবার দেখা হতে চাইলে আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। ভালো থেকো।
ইতি,
তোমার মৃত্যুমিতা
চিঠি পেয়ে প্রথমে যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, শেষ করার পর ঠিক ততটাই বিষণ্ণতা গ্রাস করলো আমাকে। এত বাধা আমাদের মিলনে! তবে আমিও হাল ছাড়ছি না। পার্থিব প্রেমে আমার অরূচি ধরে গেছে অনেক আগেই। খুব কাছ থেকে দেখেছি প্রেমের আবরণে লোভ, কাম, অবিশ্বস্ততা। দেখেছি ভীড়ের মাঝে সুযোগসন্ধানী যুবক, পাড়ার মাস্তান ছেলেদের লোভী চোখ, কামুক টিউটর, পারভার্ট আঙ্কেল, প্রবঞ্চক প্রেমিক। জীবনকে আমার অনেকভাবে দেখা হয়ে গেছে। তাতে কলুষতা প্রকট। মৃত্যুর মাঝে যে আশ্বস্ততা আছে, তা আর কোথাও নেই। এখন সময় শুধু অপেক্ষার। কবে আমার অসুখ করবে, কবে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে যা মৃত্যুকে নিশ্চিত করবে, অপেক্ষার প্রহর আর ফুরায় না। এই অপেক্ষার সময়টা চিঠি লিখে কাটিয়ে দেয়াই ভালো। আমি আবার তাকে চিঠি লিখতে বসলাম,
প্রিয় মৃত্যুমিতা,
আমার সারাক্ষণ কাটে তোমার ভাবনায়। আমার শুধু ইচ্ছে করে সেই দিনটায় ফিরে যেতে, যেদিন আমি অল্পের জন্যে ট্রাক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাই। বেঁচে থাকার মতো কুৎসিত ব্যাপার আর কিছু নেই। সেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলে ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলে আমাকে প্রপোজ করলো। জবাবে আমি বললাম, স্যরি, আই এ্যাম এনগেজড টু সাম আদার ওয়ান। ডিপার্টমেন্টের সবাই জানতো আমি সিঙ্গল, তাই আমার এনগেজড হবার ঘটনা দ্রুত চাউর হতে লাগলো। সবার মধ্যে কী দুর্দম উৎসাহ আমার জুড়ি কে সেটা জানার জন্যে! তাদেরকে আমি কী বলি বলো তো? তোমার ব্যাপারটা বললে তারা আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জ্বালিয়ে একদম যা-তা একটা অবস্থা করে ফেলবে। তাই আমি মৌনব্রত পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভালো করেছি না বলো? আজকাল খবরের কাগজে মৃত্যুসংবাদগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। বিশেষত তরুণী মেয়েদের মৃত্যুগুলি। তুমি আবার অন্য কারো ভেতর মজে যাবে না তো? সেরকম হলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি! এই দেখো না! আমার কথার ভেতরে কেমন একটা অধিকারবোধের সুর টের পাওয়া যাচ্ছে না? তা অধিকার একটু যদি তোমার ওপর না ফলাই তো কার সাথে ফলাবো বলোতো? জীবনটা কেন যে এত দীর্ঘ! পালানোর সকল পথ রূদ্ধ হয়ে আসছে। ক্রুদ্ধ যন্ত্রণায় কাটে আমার দিন। এর পরের বার তোমার সাথে দেখা হলে তোমার মাথার চুল এলোমেলো করে দেবো আমি। তোমার হাত ধরবো শক্ত করে। খাঁমচে ধরবো কাঁধ। তোমার সবল কাঁধে সওয়ার হয়ে আমরা উড়ে যাবো আমাদের স্বপ্নশহরে...
ভালো থেকো, চুমু নিও
মৃন্ময়ী
আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে কিছু বখাটে ছেলে আমার পিছু নিয়েছিলো। তারা অশ্রাব্য সব খিস্তি করছিলো আমায় দেখে। আমি দ্রূতপায়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু তাদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে। রাস্তাটি ছিলো বেশ নির্জন। তারা আমাকে রাস্তার শেষপ্রান্তে গিয়ে ঘিরে ধরলো। আমার শরীরে হাত দিলো...
-কী খবর মৃন্ময়ী, একা একা কই যাও? আমাদেরও সাথে নাও!
-আমরা তোমাকে অনেক সুখ দিবো, চলো না সেই পোড়োবাড়িটায়! আমাদের যন্ত্রগুলো কিন্তু সেইরকম লম্বা আর মোটা, চলো চলো!
লজ্জায়, অপমানে সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিলো মরে যাই। আমি তখন কাতর হয়ে কার কথা মনে করছিলাম বলোতো? বাবা-মা নয়, ভাই-বোন নয়, উপকারী প্রতিবেশী কিংবা উপযাচক হয়ে এগিয়ে আসা একদল অপরিচিত মানুষ নয়, হ্যাঁ, আমি তোমার কথা ভাবছিলাম। শুধু তোমাকেই ভাবছিলাম। তুমি কেন আসছো না ঘাতক বাস-ট্রাক হয়ে চাপা দিতে, অথবা নির্মানাধীন ভবন থেকে ইট-সুড়কি হয়ে পড়ে আমার মৃত্যু নিশ্চিত করতে? ওরা আমাকে হেনস্থা করছিলো, ওরা আমাকে শ্লীলতাহানি করছিলো, আর আমি কায়মনে তোমাকে ভাবছিলাম। কেন আসছো না তুমি? আমাকে ওরা এইভাবে অসম্মানিত করছে আর তুমি চেয়ে চেয়ে দেখছো? প্লিজ আসো, প্লিজ! হঠাৎ দূর থেকে একটা পুলিশের গাড়ি এখানে চলে আসছে দেখে ওরা কেটে পড়লো। আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু এই বেঁচে থাকা তো আমি চাই নি। ওরা কেন আমাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেললো না? ওরা কেন আমার গলায় ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে একটা সুন্দর রক্তপ্রপাত তৈরি করলো না? কেন তোমার কাছে যেতে এত অপেক্ষা আর প্রতিবন্ধকতা? কেন!
তিনদিন হয়ে গেলো, চিঠির কোনো উত্তর দিলে না। ভালো লাগছে না কিছু।
পাঁচদিন হয়ে গেলো তোমার চিঠি নেই। আমি রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছি।
সাতদিন হয়ে গেলো কোনো খবর নেই তোমার। আমার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। বাড়ির সবাই আমাকে বড়-বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেয়া কত্তরকম টেস্ট! সবকিছুই নাকি ঠিক আছে। এসব দেখে এই এত দুর্বল শরীরেও আমার হাসি পায়। কী বোকা ওরা সবাই! ওরা যদি জানতো আমার অসুস্থ হবার আসল কারণ, তাহলে যে কী করতো আমি তাই ভাবছি!
দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো তোমার চিঠি নেই। আমার শরীর খুব খারাপের দিকে। আমার নাকে নল বসিয়ে ওরা খাইয়ে দিচ্ছে আমায়। সবরকম চিকিৎসাই বিফলে যাচ্ছে। এই কদিনে আমি জেনেছি, মন যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে মারা যাবে, তখন কোনো ঔষধ-পথ্যেই কাজ হয় না। হঠাৎ করে আমি তোমার এই অবহেলার আসল কারণ বের করে ফেললাম! এটা তোমার এক সূক্ষ্ণ চাল! তুমি জানতে, যদি আমায় চিঠি না দাও, তবে আমার এই পরিণতি হবে, আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবো মৃত্যুর দিকে। তারপর তোমার আমার দেখা হবে, আর কোনো বাধা থাকবে না।
তিন সপ্তাহ কেটে গেলো। হাসপাতালের বেডে প্রায় মিশে গিয়ে শুয়ে আছি আমি। হঠাৎ বালিসের নিচে একটা ছোট্ট চিরকূট আবিষ্কার করলাম। "সে" লিখেছে।
মৃন্ময়ী,
ওরে বোকা, গাধী মেয়ে, তোর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। মৃত্যু আর সাপকে কখনও বিশ্বাস করবি না। তুই হাবলার মতো বিশ্বাস করেছিলি যে আমি তোর সেই উদ্ভট সম্পর্কের কল্পনায় মিশে রবো? অনেক হয়েছে, আর না। যেদিন ট্রাকের নীচে চাপা পড়ে তুই মরতে নিয়েছিলি, সেদিন আমার সুন্দর, আকর্ষণীয় চেহারা এবং ভাবভঙ্গি দেখে তুই আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলি। হাহাহা! আমি একটু ফ্লার্ট করেছিলাম আর কী তোর সাথে। একটা চিঠিও দিয়েছিলাম তোকে বিভ্রান্ত করতে, একটু পরীক্ষা করে দেখতে। তোর মতন ভাবনাবিলাসী কিম্ভূত মেয়ে, যারা কিছু হলেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তারা আমার কাছে অবর্ননীয় রকম হাস্যকর এক বস্তু। মৃত্যুকে নিয়ে রোমান্টিসিজমে ভোগা, না? সবকিছু থাকা স্বত্ত্বেও জীবনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা আয়েশী মৃত্যুবিলাসিতায় ভোগে, তাদের জন্যে বিন্দুমাত্র অনুকম্পা নেই আমার। তুই মরতে চেয়েছিলি, না? মৃত্যুকে দেখতে চেয়েছিলি, না? তবে তাই হোক! তাকা তোর বিছানার পাশে।
ইতি,
মৃত্যু।
অকল্পনীয় রকম নিষ্ঠুর এবং অবজ্ঞা করা লেখাটা পড়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। বিছানার পাশে তাকিয়ে দেখি, একজন বুড়ো থুত্থুরে, শকুনচোখা, নোংরা একজন লোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে ক্রুর হাসি হেসে। হঠাৎ করে আমার ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না আমি, হৃৎপিণ্ডটা বাচ্চা খরগোশের মতো লাফাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি এটাই মৃত্যু। আমি বুঝতে পারছি আর বেশিক্ষণ আমার দম নেই। একটু নিঃশ্বাসের জন্যে আমি হাঁচড়-পাঁচড় করতে থাকি। আশেপাশে তাকিয়ে কোনো প্রিয়মুখের খোঁজ করতে থাকি, যে আমাকে রক্ষা করবে মরণের হাত থেকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভয়ংকর চেহারার বৃদ্ধের রূপে আসা মৃত্যু আমার দিকে তাকিয়ে হাহা করে হাসে। হাসতেই থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১০