গোলকধাঁধার নিলাম
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ভদ্রলোকের আর কিছু থাকলো না একটা শ্যাওলা ধরা পুরোনো আমলের বাড়ি ছাড়া! দীর্ঘদিন রোগে ভুগে রোগা স্ত্রীটি মারা যাবার কিছুক্ষণ পরে তিনি বাড়িটির সাথে তার সম্পর্কের নিবিড়তার ব্যাপারে সচেতন হলেন। এই বিলম্বিত অনুধাবনে অনুতপ্ত হবার ফলে তার চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো। জলের কণাগুলো গড়িয়ে পড়বে কী পড়বে না এ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলো, তবে সদ্যমৃত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে স্বয়ংক্রিয় প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় ভদ্রলোকের সদ্যজীবিত আবেগ গা ঝাড়া দিয়ে উঠলে অশ্রুকণাগুলো টপটপ করে গাল বেয়ে পড়তে থাকে ঘরের ভাঙা মেঝের ওপর। স্ত্রীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান চালাবার মত যথেষ্ঠ টাকা ছিলোনা তার কাছে। তাই তিনি ঠিক করলেন বাড়িটা বিক্রী করে দেবেন। বাড়িটির সাথে সদ্যলদ্ধ সম্পর্কটিও টিকে থাকছে না, এই হতাশায় ভদ্রলোক আরেক প্রস্থ কেঁদে নিলেন, আর তখন যেন সহমর্মিতা অথবা রাগে বাড়ি থেকে বেশ কিছু ইট সুড়কি খসে পড়ল। কত কষ্টের টাকায় তার ঊর্ধ্বতন কততম যেন পূর্বপুরুষ এই বাসস্থান তৈরি করেছিলেন! তখন সেটা ছিলো অট্টালিকাস্বরূপ। সে কত আগেকার কথা! ভদ্রলোক দেখেননি এসব, শুধু শুনেছেনই। এরপর বাড়িটার কী যেন রোগ হল, ইট সুড়কি খসে পরতে শুরু করল, মরচে ধরল ছিটকিনিতে, ফাটল ধরতে শুরু করল ছাদে আর মেঝেতে। ভালো রাজমিস্তিরি না দেখিয়ে সবাই যার যার মত করে পিঠটান দিলো, খুঁজে নিলো নতুন আবাস। ছোট্ট, ঘুপচি ফ্ল্যাটে গাদাগাদি করে থাকতে লাগলো, আবার কেউ কাগজপত্রের নানা কায়দাকানুন করে, কিছুটা বা অনেকটাই এধার-ওধার করে গ্রামের বিশাল জমিজমা বানিয়ে বেচে, শহরে এক খন্ড জমি কিনে বাড়ি বানানোর সংগ্রামে দিনানিপাত করতে লাগলো। তো শেষমেষ বিশাল বাড়িটার ভঙ্গুর অবয়বের সাথে জোড় বেঁধেই কী না, কেবল উল্লেখিত ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী থেকে গেলেন। একবার অবশ্য এক রাজমিস্ত্রীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো বাড়িটির পুনঃনির্মাণকাজে, কিন্তু অসতর্ক অবস্থায় ভদ্রমহিলার রুগ্ন শক্ত হাতকে কাঠখন্ড মনে করে হাতুড়ি দিয়ে পেড়েক গাঁথতে গেলে তার মজুরী বাকি রেখেই তাকে বিদায় করে দেয়া হয়। বিদায়ের সময় ভদ্রলোক ভুল করে মিস্তিরিকে আবার আসতে আহবান জানিয়ে ফেলায় তার ইস্তিরি তখন থেকে আতঙ্কে স্নায়ুবৈকল্য রোগে ভোগা শুরু করেন, এবং আজ তার মৃত্যুর কারণও সম্ভবত এই। ভদ্রলোক আজ বড় একা। একাকীত্বের সাগরে ডুবে যেতে চাইলেও বৈষয়িক ভাবনারা গভীর থেকে বুদবুদ হয়ে ভেসে উঠছে। বেচারার কাছে অর্থকড়ি কিছু নেই। স্ত্রী সৎকার কীভাবে করবে? গভীর বিরাগে চোখ উল্টানো, জিভ বের করে মটকা মেরে মরে পড়ে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে একবার তাকিয়েই আবার ভয় পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। দৃশ্যটা খুব সুখকর না। আর মরা এভাবে ফেলে রাখাটা স্বাস্থ্যকরও না, আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসা দরকার! বাড়িটা বিক্রী করার যোগাড়যন্ত্র করতে হবে। স্ত্রীর মত তিনি বাড়িটাকেও বিশ্বাস করেন না। অবশ্য স্ত্রীকে অবিশ্বাস করার কারণ বললে সাধারণত যা মনে আসে, ব্যাপারটা সেরকম কিছু না। চিররুগ্না এই মহিলার অন্য পুরুষের সাথে ছেনালী করার অবকাশই ছিলো না, ঠিক যেমন ভদ্রলোকের ছিলো না উত্থিত করার ক্ষমতা (এটা সে হারিয়েছিলো বিয়ের কিছুদিন আগে, তার শিশ্নের ওপর ছাদ থেকে একটা ইট খসে পড়ার ফলে) । তাই বলা যায় তাদের একে অপরের সাথে মানিয়েছিলো ভালো। পারস্পরিক খবরদারির কোন প্রয়োজন ছিলো না। ভদ্রলোকের অবিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আসলে শ্বাসের সাথে জড়িত। সারাক্ষণ হাপড়ের মত ওঠানামা করছে স্ত্রীর বুক। কন্ঠনালী থেকে বয়লার ইঞ্জিনের মত শব্দ। নিস্তরঙ্গ বাড়িতে, অচন্দ্রচেতন শরীরে এই অসুস্থ অর্কেস্ট্রাই তার কাছে মায়ার অবলম্বন অথবা জীবনঅভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো। শ্বাসটুকু থেমে গেলে কেউ আছে তার পাশে, এই আশ্বাস থেকে সে বঞ্চিত হত। এখন, এই একলা বাড়িতে মরা পাশে নিয়ে থাকাটা মোটেও নিরাপদ না, ভদ্রলোক ভাবেন। রুগ্ন স্ত্রী'র সুকালপ্রয়াণ কিছুটা ব্যথাতুর ঘটনা হলেও, বাড়িটা টেঁসে যাবার উপক্রম করলে সেটা হবে আরো ভয়াবহ। বাড়িটাকে বিশ্বেস নেই। তবে বাড়িটা ছাড়া তার এই মুহূর্তে কেউ নেইও। একে বেচে দিলে একটা জাঁকালো সৎকার অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ঘরঘর করে নিজের শ্বাসনালীর সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় ভদ্রলোকের গোপন অক্ষমতা কাউকে বলতে পারেনি বলে ভদ্রমহিলার এ সম্মানটুকু প্রাপ্য! তারপরেও অনেক টাকা বেঁচে যাবে, সেটা দিয়ে নতুন বাসস্থানে বদলি হওয়া যাবে কী? বাড়িটা কতদামে বিকোবে? ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতে ভদ্রলোক উত্তপ্ত হয়ে ওঠা মগজটাকে একটু বিশ্রাম দেবার সিদ্ধান্ত নেন। তখনই নীচতলায় একদল মানুষের সোরগোলে সচকিত হয়ে ওঠেন তিনি। এত হল্লা হচ্ছে কীসের? তার স্ত্রীর অনন্তনিদ্রার খবর কী ইতিমধ্যে জেনে গেছে পাড়ার মানুষজন? ব্যাপারটা দেখার জন্যে তড়িঘড়ি করে নীচে নেমে তিনি আবিস্কার করেন, সদরদরজা এবং প্রাচীরের কড়ি-বর্গা খুলে নীচে পড়ে পথচারীদের চলাফেরার অসুবিধে করছে বলেই এত গোলমাল।
-বাড়িটা মাগনা পায়া তো লাটের বাট হয়া গেছেন মিয়া। একটু তদারকি করতে পারেন না? নিজে তো মরবেন আমাগোরেও মারবেন।
-কী তদারকি করব? আর না করলেই বা কী? আপনারা কোন খোঁজখবর রাখেন আমাদের? আমার স্ত্রী আজকে মারা গেলো, অনেক আগেই যেতে পারতো, কই কেউ তো কোন খবর নিতে আসে নি!
-ইন্নালিল্লাহি...
-কখন?
-কেমনে?
-আহারে বড় ভালা মানুষ আছিলো। কারো সাতে পাঁচে নাই, এমুন মানুষ এই যুগে বিরল।
প্রতিবেশীদের নানাবেশী ভন্ডকথায় লোকটা বেশ আমোদ পায়। সেইসাথে উৎকন্ঠিত হয় মৃত্যুসংবাদের বাতাসের সাথে সখ্যতা এবং দ্রুতগতির বহমানতার কথা ভেবে। আত্মীয় স্বজনরা সব ছুটে আসবে এখন। তারা কী বাড়ি বিক্রীর টাকায় ভাগ না বসিয়ে পারবে? চাইলেই কী পারা যায়! এটা হল গিয়ে অটোমেটিক রিফ্লেক্স, মানুষের চোখের মধ্যে পোকা উড়ে বসতে গেলে যেমন হুট করেই চোখের পাঁপড়ি বন্ধ হয়ে যায়, তেমন এই বাড়িটা বিক্রী করতে গেলেও এমন ঘটনাই ঘটবে। শহরের অভিজাত প্রান্তে যার সুদৃশ্য, সুরম্য এ্যাপার্টমেন্ট আছে, রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা আছে, সেই সুদূরতম ধনী আত্মীয়ও বাড়ি বেচার কথা উঠলে তার নিজের অংশের অতি ক্ষুদ্র দশমিকাংশের দাবী না তুলে পারবে না। সেই অটো-রিফ্লেক্সের জোরেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল প্রতিবেশীরা। ছোট্ট মফস্বঃলী পাড়াটায় সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। আদেশপ্রাপ্ত হয়ে অনুজদের একদল বাঁইবাঁই করে ছুটছে ভদ্রলোকের নিকটতম আত্মীয়কে খবর দিতে। খুব শীঘ্রই বার্তাচক্র সম্পন্ন হওয়ায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাড়িটা মানুষের ভীড়ে গিজগিজ করতে থাকে। এত মানুষ দেখে বাড়িটা থেকে আরো কিছু ইট-সুড়কি-কড়ি-বর্গা খসে পড়ে হয়তোবা অটোমেটিক রিফ্লেক্সেই। এই রিফ্লেক্সের কারণ বলা মুশকিল, বাড়িরা স্মৃতিকাতর হয় কী না কে জানে! পুরোনো স্মৃতি,ক্ষোভ অথবা ক্ষয়িষ্ণুতা যেকোনটাই কারন হতে পারে। এই প্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ভদ্রলোকের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে সমবেত লোকসকলের আলোচনার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে দেয়, এবং তারা পছন্দের বিষয়বস্তু পেয়ে গোপন স্বস্তি অপ্রকাশ্য রাখতে পারে না।
-বাড়িটার যা অবস্থা, বেচে দেয়াই ভালো।
-আরে, এই বাড়ি কিনবে কে? এইটা কি থাকার মত? প্রমোটরদের দিয়া দেন। মাল্টিস্টোরেড শপিং মল বানায়া দিবে। কাজটা অবশ্য আমিই করতে পারি। লোকসান দিয়া হইলেও কইরা দিমু। নিজেদের সম্পত্তি বলে কথা!
নারীমহলের সাবেকী একজন নাকি কন্ঠে গেয়ে কেঁদে ওঠে,
-এঁ তোঁদের সাতপুরুষের ভিঁটে, এঁ বেঁচিস না!
সবাই কড়া চোখে তাকায় মহিলার দিকে। তার ছেলে ফিসফিসিয়ে ভর্ৎসনা করে ওঠে,
-মা, ইদানিং তুমি খুব বেশি বাংলা সিনেমা দেখছো!
মহিলার তখন আজ রাতের দূরদর্শনসূচীর কথা মনে পড়ে যাওয়ায়, এবং অনুষ্ঠান প্রচারের সময় সন্নিকট হওয়ায় একইরকম একঘেয়ে সুরে কৌশলে প্রস্থানের আহবান জানায়,
-ওঁরে, আঁমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আঁমাকে নিঁয়ে চল তোরা।
-আহ! কেবল এলে, এখনই চলে যাওয়াটা কেমন দেখায়!
পুনর্বার ছেলের ধমক খেয়ে সে বিমর্ষ মুখে মৌন হয়ে থাকে।
প্রতিবেশীরাও বেশ কৌতুহলী চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলো বাড়ির মালিকানদের আলোচনা। যুৎমত সময় পেয়ে তারাও সৎকারকার্য পিছিয়ে দিয়ে সোৎসাহে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।
-কনস্ট্রাকশনের কোন কাজ হইলে আমারে বইলেন। দোকান থিকা কম দামে রড বিক্রী করুম।
আজ যা কিছু ভেঙে পড়ল কেউ খেয়াল করার আগেই নিয়ে সঁটকে পড়তে হবে। ভবঘুরেদের দল একযোগে ভাবে। এসব আলাপচারিতা এবং কূটকাচালির মধ্যে ভদ্রলোক বড় বিপন্ন বোধ করেন। কত আশা ছিলো বাড়িটা তড়িঘড়ি করে বেচে দিয়ে যা পাবেন তাই দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন! স্বার্থপরেরা তা হতে দেবে কেন! দুনিয়ার বে-ইনসাফির কথা ভেবে সে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও সামলে নেন, বাড়িটাকে বিশ্বেস নেই। দেখা যাবে এইটুকু বাতাসেই আরো আরো খসে পড়ছে সরঞ্জামাদি, বিক্রী-বাট্টা বা পুনর্নির্মাণ বিষয়ক আলোচনাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতে। কিন্তু এই তীব্র হাহাকারে ভরা দীর্ঘশ্বাসের সাথে কী আপোষ করা যায়! আচ্ছা, সে না হয় তার মৃত স্ত্রীর জন্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই গেলো, যাক!
-ভাইজান কী একটু প্রাইভেটে কথা বলবেন আমার সাথে?
ভদ্রলোক বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকান অনাহুত বক্তার দিকে। কে আবার কোন ফন্দীতে এসেছে বলা দুস্কর! আরে, এ যে সেই বেখেয়াল রাজমিস্ত্রীটা! যে একবার তার স্ত্রীর হাতে ভুল করে পেড়েক গাঁথতে গিয়েছিলো। এসব লোক থেকে খুব সাবধান! নিজেকে বলল সে। ভালো করে খোঁজ না নিয়েই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। তাকে পাড়ার কেউ চিনতো না। তাড়িয়ে দেয়ার পর আর কখনও দেখাও যায়নি। এরা থাকেই সবসময় ধান্দাবাজীতে।
-আপনে কিন্তু আমারে আবার আইতে কইছিলেন, মনে আছে?
হ্যাঁ, সেটা একটা গাধার মত কাজ হয়েছিলো। বিপদজনক লোকটা ঠিকই মনে রেখেছিলো, তক্বে তক্বে ছিলো, এখন উপলক্ষ্য পেয়ে চলে এসেছে।
-কী চাই তোমার?
-দেখেন, আমি আপনার একটা বড় ক্ষতি কইরা ফালাইসি। সেইদিন আমি আরেকটু হৈলেই একটা দুর্ঘটনা ঘটায় ফালাইসিলাম। যদিও কিছু হয় নাই, আবার একেবারেই কিছু হয় নাই এইডাও কওন যায় না। ভাবীসাবে তো সেই আতঙ্কেই এত তাড়াতাড়ি বিদায় নিল...
-ফ্যাচফ্যাচ বন্ধ করে কী চাও বলে ফেলো।
-আইচ্ছা, হুনেন। আমি কিন্তু এলাকা ছাইড়া কোথাও যাই নাই। আপনাদের দেইখা রাখতাম। কখন কী বিপদ-আপদ হয়। আপনারা একলা মানুষ। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা তো সব সাপের মত। চান্স পাইলেই ছোবল দিবে। আইজকা দেখতাসি তো কী অবস্থা। এইরকম কিছু একটা হবে, আগেই আঁচ করতে পার্সিলাম। আমি চাই আপনার একটা উপকার করতে। বিনা পয়সায় কইরা দিমু...
-তোমার কাছ থেকে আর উপকার নিচ্ছি! এর আগেরবার হাতে পেড়েক গাঁথতে গিয়েছিলে, এইবার তো বুকে গজাল গাঁথবে!
-আমার ওপর ভরসা রাখেন। আমি এই কয়েক বছরে অনেক শিখসি-জানসি। আমি অন্যদের মত আপনার বাড়িরে মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং বানায় দিতে পারমু না, আমার প্ল্যানটা ভিন্ন। পেরাইভেটে বলা লাগবো।
কথা বলতে বলতে তারা ততক্ষণে যথেষ্ট পরিমাণ প্রাইভেসি অর্জন করে ফেলেছে!
-কী প্ল্যান বলে ফেল!
ভদ্রলোকের কন্ঠে অকৃত্রিম কৌতূহল।
-আমি এই বাড়িটারে একটা গোলকধাঁধা বানামু।
-মানে! তাতে লাভ কী! কেনই বা বানাবে?
-আমার গোলকধাঁধা জটিল জিনিস। হাত মশক কৈরা দেখসি। এখন কাজে লাগামু। আপনার যতসব ধান্ধাবাজ আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী, তারা সবাই গোলকধাঁধার চক্করে পৈড়া খালি ঘুরবো আর ঘুরবো। আপনে যতক্ষণ চান ঘুরামু।
-প্ল্যানটা অভিনব, কিন্তু তাতে লাভটা কী হবে আমার?
-ভাইজান, লাভের কথা আমারে জিগায়েন না। আপনার জন্যে এই যে কাজটা করতাছি, আমার কী লাভ হৈবো কন? এইখানে লাভ লোকসানের কিছু নাই। আর্থিক লাভ হৈবো না আপনার, ঐসব ভাইবেনও না। তয় আপনার এইসব সাপ-শকুন পরিচিত মানুষজনের একটা ভালো শিক্ষা হইব, এইডা যদি বিবেচনা করেন, তাইলে কাজ শুরু কৈরা দেই।
ভদ্রলোক এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ! ওদের শিক্ষা দেয়া দরকার। স্বার্থপিশাচ সব একেকটা। তুমি কাজ শুরু করে দাও!
-আপনে তাইলে ধীরে ধীরে বাইরের দিকে আগাইতে থাকেন। সদর দরজার ঐখানে দাঁড়ায়া মজা দেখেন। আমি কাম শুরু করি। শেষ কইরা আমিও চইলা আসুম আপনার কাছে।
বেখেয়ালী রাজমিস্ত্রী নিপুন হাতে তার কাজ শুরু করে।
একেকজন বৈষয়িক জ্ঞানাধারের অধিকারী পরস্পরের সাথে নানারকম তর্ক-বিতর্ক, কিছু মিমাংসা কিছু রিরংসা কিছু জিঘাংসা শেষে যাবার উপক্রম করে।
-তাহলে ঐ কথাই রইলো। আমরা এটাকে একটা মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং বানাবো।
যেন মামলার রায় দিচ্ছেন এমন রাশভারী কন্ঠে একজন আলোচনার সমাপ্তি টানার প্রয়াস নেন।
-কথা কিছুই ফাইনাল হয়নাই। তবে আরো কথা হবে। বহুৎ কথা বাকি আছে। এখন যাই। এই আমার স্যান্ডেলটা কই রাখলাম রে?
তিনি স্যান্ডেলের খোঁজে ঘুরপাক খেতে থাকেন।
কী সমস্যা! বাড়িটার ডিজাইন চেঞ্জ হয়ে গেলো নাকি? বের হবার দরজাটা কই? রাশভারী ব্যক্তিটি বেভুলো মনকে বয়সের দোষ দিয়ে প্রবোধ দেন। কিন্তু ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে একটা ভৌতিক অনুভূতি আচ্ছন্ন করে তাকে, বিচ্ছিন্ন করে বৈষয়িক পৃথিবী থেকে।
যারা অবশিষ্ট ছিলো এসব মহাপরিকল্পনায় অংশ নিতে-অল্প কয়েকজনই, বেশিরভাগই কুলোতে না পেরে চলে গেছে। বাকি কজনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনায় কেউ কাউকে হুমকি ধামকি দেয়নি, কিন্তু শীতল চাহনি দিয়ে তারা একে অপরকে জানান দিয়েছিলো, এই মহাসম্পদ কুক্ষিগত করার জন্যে যেকোন কিছু করে ফেলতে দ্বিধা করবে না কেউ। এখন তাদের বরফ শীতল মুখের পেশীগুলো বেমক্কা ভয় পেয়ে গলে পড়ছে যেন। ঘামছে সবাই। প্রথমদিকে কেউ কাউকে পাত্তা দিচ্ছিলো না। বেরুবার পথ খুঁজতে গিয়ে বারবার একে অপরের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটাকে অনভ্রিপেত কাকতাল বলে অবজ্ঞা করছিলো। এখন ঘেমে-নেয়ে, ভয়ের শরবৎ পান করে তারা আবারও পরস্পরের কাছাকাছি হয়। পাকা মাথা তাদের। সবাই মিলে বসলে একটা উপায় বের হবেই। তাদেরকে বোকা বানানো কী যা তা ব্যাপার? তারা ঠান্ডা মাথায় পর্যালোচনা করে নিখুঁত একটি মানচিত্র তৈরি করে সময় নিয়ে। এই প্রথম কোন ব্যাপার তাদের কাছ থেকে সর্বসম্মতি পায়! দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে বেরুবার রাস্তার দিকে এগোয়।
-হ্যাঁ, মানচিত্র অনুযায়ী, সামনে, বায়ে-ডানে-আবার বায়ে এইতো এসে গেছি!
কয়েকজোড়া চোখ সাগ্রহে তাকিয়ে দেখে একটা খাটে তাদের দিকেই যেন বিকট ভেংচি কেটে শুয়ে আছে অদ্যমৃত ভদ্রমহিলা!
-ভাইজান কেমুন মজা পাইলেন।
-খুব ভালো! তুমি একটা কাজের কাজ করেছো! উচিৎ শিক্ষা হয়েছে ব্যাটাদের!
-এখন যান, ভাবীজানের লাশটার একটা ব্যবস্থা করেন। এই ব্যাপারে আমি আর হেল্প করতে পারুম না। খোদাপেজ।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, করছি যাও যাও!
ভদ্রলোক টিকিট কাউন্টার খুলে বসেছেন। এবং কীভাবে যেন ক্যানভাসারদের ভাষা রপ্ত করে দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্যে অনর্গল বকে চলেছেন তার নবনির্মিত গোলকধাঁধায় উত্তেজনাময় ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে। টিকেট বিক্রীও হচ্ছে দেদারসে!
-ভাইজান আপনি ভাবীসাবের লাশের ব্যবস্থা না কৈরা এই কাম করতাছেন! তাইলে আর তাগো লগে আপনার পার্থক্য হৈলো কী!
-পার্থক্য থাকা লাগবে না। তুমি পারলে আমাকে আরো হেল্প কর।
দাঁত খিঁচিয়ে বলেন ভদ্রলোক।
-আচ্ছা ভাইজান। যা কন। আমার মাথায় নতুন প্ল্যান আইছে। একটু পেরাইভেটে বলতে চাই।
"পেরাইভেট" এর কথা শুনে ভদ্রলোকের চোখ চকচক করে ওঠে।
-কিক্কিক্কি!
তিনি এগিয়ে যান নতুন প্ল্যান শুনতে।
কিছুক্ষণ পরে ভেঙচি কেটে বিশ্রী ভঙ্গীমায় শুয়ে থাকা লাশটির পাশে জমায়েতদের সংখ্যা একজন বাড়ে।
১২২টি মন্তব্য ১২২টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন