শুরু
সময় তখন কত আমি দেখিনি। তবে ব্যাপারটা কতক্ষণ স্থায়ী ছিলো তার একটা আন্দাজ করা যেতে পারে। তিন সেকেন্ড। অথবা তিনহাজার মিলি সেকেন্ড। অথবা ত্রিশ লক্ষ মাইক্রো সেকেন্ড। ভিড় ঠেলে মেয়েটি কোনমতে বাসে উঠলো।
শেষ
ষণ্ডাগুন্ডা সুযোগসন্ধানী লোকজন আর পড়ুয়া কলেজছাত্রদের ঠেলে সে মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে বসল। ক্লান্তির কালিমা মুছে তার ঠোঁটে স্বস্তির একটা হাসি ফুটে উঠলো।
________________*___________________ (সমাপ্ত)
আমার নাছোর চক্ষু ক্যামেরা, এবং মনোটোমাস মন
বাঁধ সাধলো আমার সতৃষ্ণ চোখ আর আমার খেয়ালী মস্তিষ্ক। সময়ের হাইওয়েতে দূরন্ত বেগে ছুটে চলা আমাদের জীবনগাড়ির মরচে ধরা ইঞ্জিনে লুব্রিক্যান্ট লাগিয়ে, ঝাঁ চকচকে করে থেমে মেয়েটিকে অনন্তকাল ধরে দেখতে চায় ওরা।
তার শ্রান্তি, কপালে লেপটে থাকা এলোচুল, প্রসাধন বিবর্জিত কিন্তু স্নিগ্ধ গাল... একজন বিশালদেহী লোক কর্তৃক আড়াল হবার আগপর্যন্ত তিন সেকেন্ডে চক্ষুক্যামেরা ঝটপট ছবি তুলে নেয় বেশ কিছু, বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে।
ছুটির দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় মিনিবাস ছুটে চলেছে, আমাকে নামতে হবে সামনের স্টপেজে। আমাকে পুড়তে হবে রোদ্দুরের পেট্রলে। সেই স্নিগ্ধ শ্রান্তির ছায়া থেকে আমি চলে যাচ্ছি দূরে...
কিন্তু চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়! যাত্রী ছাউনির বেঞ্চিতে বসার পর আমার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা পাশে রাখতে গিয়ে কিছুটা ভারি লাগলো সেটা। খুলে দেখি একটা ক্যামেরা আর একটা বই।
শট ডিভিশন
চলচ্চিত্রের নাম- তিনটি মহার্ঘ্য সেকেন্ড
দৈর্ঘ্য- তিন সেকেন্ড
পরিচালক-চক্ষু
অভিনয়ে- একটি অজানা মেয়ে
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
ক্যামেরার মেমরিতে সংরক্ষিত চলচ্চিত্রগুলো দেখতে থাকি আমি। একটি চলচ্চিত্রই বিভিন্ন ভঙ্গীমায় ধারণ করা। কখনও লং শট, কখনও মিড শট, কখনও ক্লোজ আপ, কখনও এক্সট্রিম ক্লোজ আপ।
আমি দূর থেকে দেখি সে বাসে উঠছে, হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ে।
মেয়েটি আরো নিকটবর্তী হয় মিড শটে। তার অবয়ব দেখা যায় কিন্তু শ্রান্তি দেখা যায়না। এই অভাব পূরণ হয় ক্লোজ শটে। এক্সট্রিম ক্লোজ শটে পরিচালকের কুশলতা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। ডিটেইলিং এর কাজ অদ্ভুত ভালো হয়েছে। আমি পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো দেখতে থাকি। ক্যামেরা এ্যাঙ্গেল নিয়েও ভালো কাজ করেছে পরিচালক। কখনও বার্ডস আই ভিউয়ের চিলচোখে, কখনও অবলিক ভিউ এর নড়বড়ে স্থায়িত্ব এবং ভারসাম্য, হাই এ্যাঙ্গেলের আধো পাখি আধো মানব দৃষ্টি, লো এ্যাঙ্গেলে ছোট্ট অবয়বটার বিভ্রম বিবর্ধন, অতঃপর আই লেভেলে প্রশান্তিতে শ্রান্তি অবলোকন।
-দেখলেতো কতভাবে দেখা যায়? দেখার শিল্প জেনেছো কি তুমি?
পরিচালক আমাকে প্রশ্ন করে।
-এতসব এ্যাঙ্গেল এবং শটের পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে কতগুলো দৃশ্য তৈরী করা যাবে তাই ভাবছি।
-অসংখ্য! আমিতো শুধুমাত্র প্রাথমিক কিছু কৌশল ব্যবহার করেছি। সুন্দরকে যদি ধারণ করতে না পারো তবে কিসের চক্ষুষ্মান হয়েছো!
আমার ভালো লাগে সে চলে যায়নি বলে। তাকে ধারণ করা হয়েছে বলে। আমি জানিনা সে কে, কারও বাগদত্তা নাকি কারও প্রেমিকা, নাকি চিরকুমারী হবার দৃঢ় সিদ্ধান্তে অনড় কেউ। শুধু জানি সে ভিড় ঠেলে সামনে এসেছিলো, শুধু জানি তার ক্লান্তিতে শহুরে রোদ নকশী বুনছিলো।
আর এটুকু জানাই যথেষ্ঠ।
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমি আবার হাঁটা শুরু করি। কিন্তু ব্যাগটা হালকা লাগছে কেন এমন? মুফতে পাওয়া ক্যামেরাটা কি ফেলে এসেছি? এখন গেলে কি আর পাওয়া যাবে?
অসীমবাস্তব,অলীকবাস্তব
নেই। বাসস্টপে এক বুড়ো ছাড়া আর কেউ বসে নেই। কেউ নেই, কিছু নেই। আমি বুড়োকে বয়সজনিত সম্ভ্রমের তোয়াক্কা না করে কড়া কন্ঠে বলি,
-এখানে একটা ক্যামেরা ছিলো আপনি দেখেছেন?
বুড়ো কিছু না বলে হাসে দাঁড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে।
- কী হল কথা বলছেন না কেন?
-ক্যামেরা ছিলো কিনা জানিনা। তবে একটা বই ছিলো। সেটা কি তোমার?
ওহ! বইটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কি লেখা ছিলো খুলে দেখাই হয়নি। ক্যামেরার শোক ভুলতে আমি বইটি পাবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ি।
-দিন আমার বই!
-আরে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? রোসো! বোসো। কিছু কথাবার্তা বলি। আমি কিন্তু অনেক প্রাচীন এক মানুষ। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি। এ যুগের ছোকড়ারা দেখছি বেজায় বেয়াদব!
বুড়োর কথা চালবাজি মনে হলেও ভদ্রতার খাতিরে আমি বসি। চোখ কোণাচে করে বইটার নাম পড়ার চেষ্টা করি। কী ভীষণ খটোমটো নাম! ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস, জেনোর ধাঁধা এবং আরো কী সব! অংক বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছি। ঐ বই নেবার কোন দরকার নেই আমার।
-আমি যাই।
তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ি আমি।
-যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায়? তুমি, আমি এবং আমরা সবাই যে এক অসম্ভব এবং অবাস্তব জগতে বাস করছি এটা জানো? এখান থেকে ঐ ল্যাম্পপোস্টটার কাছে যাওয়া তোমার পক্ষে কখনই সম্ভব না।
কী বাজে বকছে বুড়োটা! আমি দ্রুত হাঁটা শুরু করি।
-সংক্ষেপে তোমাকে বলি কেন যেতে পারবেনা, কেন যাওয়া সম্ভব না তোমার পক্ষে। এখান থেকে ল্যাম্পপোস্টটার দূরত্ব কত হবে বলত?
-দশ মিটারের মত!
-ঠিক আছে। তোমাকে এই দশ মিটার পাড়ি দিতে হলে তার অন্তত অর্ধেক তো আগে যেতে হবে, তাই না?
-তা তো বটেই!
-তার আগে তোমাকে সেই দূরত্বের অর্ধেক পেরুতে হবে, তার আগে তার অর্ধেক, তার অর্ধেক, তার অর্ধেক...
-অর্থাৎ অসীম সংখ্যক অর্ধেক?
-ঠিক ধরেছো।
-অসীমকে পেরুনো কি সম্ভব?
-না!
-তার মানে...
-হ্যাঁ, তুমি একটা অসীম জগতের অসম্ভব অস্তিত্ব!
আমি চলৎশক্তিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
-আমার নাম 'জেনো'। আমি একজন গ্রীক দার্শনিক। এই প্যারাডক্সটা আমার তৈরী করা।
-কেন বানালেন এ ভয়ংকর প্যারাডক্স?
আমি আতঙ্ক এবং আড়ষ্ট বোধ করি।
-তোমরা শুধু সবকিছুর নেতিবাচক দিকটাই দেখো। যেখানে দাঁড়িয়ে আছো আড়ষ্ট বেকুবের মত, সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে মগজের ধুসর কোষগুলোকে একটু খাটাও! আমি কি এই নশ্বর জীবনের মধ্যে অসীমের বীজ রোপিত করে দেইনি? আজকে তোমার তিন সেকেন্ডের বিহবল অনুভূতিকে তিন হাজার মিলি সেকেন্ড, ত্রিশ লক্ষ মাইক্রো সেকেন্ড...হু আপাতত এটুকুই ভাবো, এতগুলো অংশে ভাগ করে দেইনি? তিন সেকেন্ডে ত্রিশ লক্ষবার মেয়েটিকে দেখার কৌশল শিখিয়ে দেইনি? বোকা ছেলে!
-কিন্তু সেটাতো বাস্তবে সম্ভব না!
-বাস্তব? কোনটা বাস্তব? এই যে আমি হাজার বছর দূরত্ব অতিক্রম করে তোমার কাছে এসেছি এটা কি বাস্তব? বাস্তব জগতের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে মনের স্থিতিস্থাপকতা বাড়িয়ে অসীমের কথা ভাবতে পারো না কেন তোমরা? সময়ের পেটুক পাকস্থলীর তেজী অম্লে গলে যেতে দেবে তিন সেকেন্ডের সেই সুন্দর অনুভবের শরীর?
-না স্যার! কখনই না!
-আমাকে স্যার ডাকবেনা। আমি মহামতি 'জেনো'।
গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন মহামতি জেনো।
আমি তখন অলীক বাস্তবের শেকল থেকে নিজের স্থবিরতাকে মুক্ত করে হেঁটে চলেছি মন্থর। সময়ের আগ্রাসী থাবা থেকে বিপন্ন অনুভবকে ছিনিয়ে এনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছি আকাশে, বায়ূস্তরে, মনফোনে, ডাকবাক্সে, মাটিতে, সবুজে!
অসীম সংখ্যক অনুভব! তিন সেকেন্ড থেকে তিনশরকম ক্লান্তি, তিন লক্ষ সৌন্দর্য, পাঁচলক্ষ এলোচুল, চুরাশি কোটি স্মিত হাসি, এক বিলিওন স্নিগ্ধতা- একজন শ্রান্ত মানবীর কাছ থেকে! থ্যাংকস মহামতি জেনো!
যোগজীকরণ
জেনো রেখে গেছে বইটি। আমি আরো কিছু জানার প্রত্যাশায় বইটি নিয়ে ওল্টাতে থাকি।
-ওহে রোমান্টিক বালক! তোমার আনন্দ দেখে ভালো লাগছে। সেই সাথে কিছুটা বিষাদও অনুভব করছি।
আমি তাকিয়ে দেখি আমার পাশে বসে আছেন লম্বা চুলের উদাস এক মানুষ। পরনে পুরোনো দিনের ইংরেজদের পোষাক। এবার আমার চিনতে ভুল হলনা। স্যার আইজ্যাক নিউটন! যদিও আমি অংক অনেক ভয় পাই, সবসময় কোনমতে পাস করে এসেছি, কিন্তু আমি জানি এই মহান গণিতবিদ আজকে এসেছেন সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা করতে তার নিজস্ব ভঙ্গীমায়, তাই আমার ভয় হয়না। আমি সাগ্রহে তাকিয়ে থাকি তার পরবর্তী আচরণের অপেক্ষায়।
-গণিতের মধ্যে আমি সারাজীবন আনন্দ খুঁজে ফিরেছি, পেয়েছিও, তবে তোমার মত রোমান্টিক আবেগের ক্ষেত্রে সবসময়ই ব্যর্থ। আমি এবং আমার প্রেমিকা সম্পর্কিত প্রচলিত গল্পটি জানো তো নিশ্চয়ই? সে যাক, তোমাকে অফুরান হাবুডুবু খেতে দেখে একটু খারাপই লাগলো। ভাবলাম, আমার কাছে তো সমাধান আছে। তুমি তিন সেকেন্ডকে অসীমে ভাগ করে অসম্ভব জগতে ঘুরপাক খাচ্ছো, সেখান থেকে তোমাকে বাস্তব জগতে নামিয়ে এনে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অনুভূতি দেয়ার কথা মনে এলো।
-সেটা কেমন?
- আচ্ছা, মনে কর তুমি বিন্দু ১ এ দাঁড়িয়ে আছো, সেখান থেকে বিন্দু ২ তে যেতে, এখানে ধরা যাক তিন সেকেন্ডের ব্যাপারটা, জেনোর প্যারাডক্স মানলে এক থেকে তিনে যাওয়া অসম্ভব, কিন্তু যদি ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস ব্যবহার কর, তাহলে এক্স ফাংশন ব্যবহার করে যাওয়া সম্ভব...
নিউটন আমাকে গ্রাফ পেপারে কার্ভ একে সব বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।
-এই যে দেখছো অধিবৃত্তাকার আকৃতি, এখানেও কিন্তু সৌন্দর্য আছে।
-হু, নারীদেহের সব আকর্ষণীয় বাঁকই তো কার্ভ, প্যারাবোলা। নারীদেহের সৌন্দর্য প্যারাবলিক সামেশন দ্বারাই পূর্ণতা পায়!
আমি বেশ খোশমেজাজে বললাম। তবে মধ্যযুগীয় ভিক্টোরিয়ান পিউরিটান নিউটনের তা পছন্দ হলনা। তিনি রোষকষায়িত লোচনে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন!
বিদায়পর্বটা ভালো হলনা! দুঃখিত মহামতি নিউটন। আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা গ্রহণ করুন!
মহান চলচ্চিত্র
আমি এখন অসীমের জগতের যোগজীকরণ নিয়ে ব্যস্ত। মুহুর্তগুলো জোড়া দিয়ে একটা আদর্শ পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্য সমীকরণ তৈরী করছি। রাতের নীরব রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে আমি হারানো ক্যামেরাটাও খুঁজে পাই। এতক্ষণে সুদক্ষ পরিচালক চোখ এবং গণিতবিদ মস্তিষ্ক মিলে সম্ভাব্য সমস্ত শট নিয়ে এবং পারমুটেশন-কম্বিনেশনের যাবতীয় সুত্র প্রয়োগ করে তৈরী করেছে এক মহান চলচ্চিত্র, দীর্ঘ। দৈর্ঘ্য? অসীম অথবা অনির্ণেয়। মহান দার্শনিক, গণিতবিদ এবং চলচ্চিত্রকারদের সংস্পর্শে এসে আমি অভাবনীয় এক বোধের মুখোমুখি আজ...
শেষের শুরু
- ঘুম থেকে উঠবিনা?
মা ডাকেন আমাকে স্নেহার্দ্র কন্ঠে। আমার দিনটা খুব সুন্দরভাবে শুরু হয়। সামনে কাঠফাটা রোদ, ঘর্মাক্ত মানুষ, দাপ্তরিক জটিলতা এসবের সম্মিলনে একটা ক্লান্তিকর দিন যাবে।
কিন্তু আমি যে শিখেছি ভালোবাসার যোগজীকরণ এবং সীমার মধ্যে অসীমকে খুঁজে পাওয়ার কৌশল! ৮৬৪০০ সেকেন্ডের মধ্য থেকে তিন সেকেন্ড বের করে নিয়ে বাকি ৮৬৩৯৭ সেকেন্ডকে অবজ্ঞা করে এভাবেই এগিয়ে যাবো আমি সবাইকে সাথে করে। এ আমার স্পর্ধিত উচ্চাভিলাস বা গর্ব সে যাই বলেন না কেন!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ৮:১৭