বিএনপি ইতালি শাখার কাউন্সি নির্বাচন হয় ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন শাহ মো. তাইফুর রহমান ছোটন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার নাসির উদ্দিন। এর পর লম্বা সময় পেরিয়ে যায়, তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেন না। এক পর্যায়ে লন্ডন থেকে শো’কজ নোটিশ করা হয়। নোটিশ পাওয়ার পর তারা একটা কমিটি গঠন করেন। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাহিদুর রহমান এক চিঠির মাধ্যমে ওই কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিত করেন। এর কয়েক মাস পর কাউন্সি নির্বাচনে যারা দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিলেন, সভাপতি প্রার্থী হাজী আবদুর রাজ্জাক এবং সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ঢালি নাসির উদ্দিনসহ ৫ জনকে লন্ডনে ডেকে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। তারা প্রায় ১৭৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন এবং গত ১৭-১০-২০১৬ তারিখে বিএনপির মহাসচিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত (অনুমোদিত) ওই কমিটি প্রকাশ করা হয়।
কাউন্সি নির্বাচনের পর থেকেই রোমের বিএনপিতে টানাপড়েন শুরু হলেও তা প্রকাশ্য রূপ নেয় নির্বাচিত কমিটি স্থগিত হওয়ার পর থেকে। তাইফুর রহমান ছোটনের কমিটি স্থগিত হওয়ার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল আবদুর রাজ্জাক এবং ঢালি নাসিরের নেতৃত্বে নতুন কমিটি আসছে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার মধ্যে গত মাসে অনুমোদিত নতুন কমিটি প্রকাশ করা হয়।
এর পর থেকে রোমের বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে দুই খণ্ড হয়ে যায়। দুই কমিটি আলাদাভাবে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে। সম্প্রতি রোমের স্বেচ্ছাসেবক দলের এক মিটিং-এ দুই কমিটির নেতাকর্মীদের মাঝে তুমুল মারামারি হয়। স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টের মিলনায়তনে চেয়ার তুলে তারা উপযুপরি মারামারি করে। এতে উভয় পক্ষের বেশ ক’জন আহত হয়। মারামারির সময় সেখানে দুই গ্রুপের সভাপতিই উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ ওঠে নির্বাচিত সভাপতি তাইফুর রহমান ছোটনের কথার সূত্র ধরেই সেখানে মারামারি শুরু হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাইফুর রহমান অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভায় আমি তাদের (রাজ্জাক, ঢালি নাসির) কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করি। আমি বলি- এখন তো আমরা নির্বাচিত কমিটিতে আছি, আমাদের সামনে বলছো কেন্দ্র থেকে তোমাদের অনুমোদন দিয়েছে। কই, কোনো কাগজপত্র তো আমাদের সামনে উপস্থাপন করো নাই। এই কথার প্রেক্ষাপটে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। সেখানে দুই পক্ষের লোকই ছিল, ওদের পক্ষের ছেলেরা একটু বেশি উগ্রতা দেখায়।
তিনি বলেন, গত এপ্রিল মাসে চিঠি দিয়ে আমাদের কমিটি স্থগিত করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাহিদুর রহমানের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো সুযোগ তখন আমাদের ছিল না। আমি বাংলাদেশের সেন্ট্রাল কমিটির সাথে যোগাযোগ করি এবং মে মাসে নিজে ঢাকায় যাই। ঢাকায় গিয়ে জানতে পারি কেন্দ্রীয় মহাসচিবসহ কেউ এ বিষয়ে অবহিত নন। উনারা আমাকে একটি লিখিত অভিযোগ করতে বলেন। আমি তাই করি। তখন মহাসচিব এবং দপ্তর সম্পাদক জানান, ২০০৬ সালের পর থেকে দেশের বাইরের কোনো কমিটির অনুমোদন উনারা দিতে পারেন না, গঠনতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা আছে। উনারা আমাকে পরামর্শ দেন, লন্ডনে ভাইস চেয়ারম্যান আছেন, তার সাথে দেখা করে বিষয়টা জানাতে।
তাইফুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় মহাসচিব এবং দপ্তর সম্পাদক সাহেব আমাকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক একটা চিঠি দিয়ে আমাকে অব্যাহতি দিতে পারেন না। এমন এখতিয়ার তার নেই। এ জাতীয় কর্মকাণ্ড করার জন্য তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত নন।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কথা বলে আমি বুঝতে পারলাম, বিষয়টা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মহাসচিবসহ অন্যান্য নেতারা বিষয়টা পছন্দ করেননি। তখন আমি মাহিদুর রহমানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করি। কারণ কেন্দ্র থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, এটা নিয়মবিরোধী কাজ হয়েছে। এরপর দলীয় সহকর্মীরা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং মাহিদুর রহমানের করে দেয়া কমিটির বিপক্ষে সংগঠিত হতে শুরু করে।
রাজ্জাক, ঢালি নাসিরদের কমিটি তালিকায় ফখরুল ইসলাম আলমগীরের যে স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে তা জাল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি ঢাকায় যোগাযোগ করেছি, মহাসচিব সাহেব নিজে আমাকে বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছইু জানেন না এবং গঠনতান্ত্রিকভাবে দেশের বাইরের কোনো কমিটির অনুমোদন তিনি দিতে পারেন না। উল্টো তিনি আমার কাছে ওই কমিটির একটা কপি চেয়েছেন।
নিজেকে এখনো ইতালি বিএনপির সভাপতি দাবি করেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তাইফুর রহমান বলেন, আমি কাউন্সিলরদের দ্বারা নির্বাচিত সভাপতি, আমার তো সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বা আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগও করিনি। আমাদের কমিটি সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যাবে। তবে আমরা চাই- ভাইস চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের ডাকবেন এবং আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করে দিবেন। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন আমাদের কমিটির কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, তাইফুর রহমান ছোটনের একটি ফেসবুক একাউন্ট এবং একটি লাইক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে কোথাও রোম বিএনপির সভাপতি লেখা নেই।
অনুমোদিত কমিটির সভাপতি হাজি আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বিএনপি একটা গণতান্ত্রিক দল। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট হয়েছে, কাউন্সিলররা যাকে ভোট দিয়েছে সেই নির্বাচিত হয়েছে। তাকে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব দেয়ার পরে প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি সাত মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি। এ অবস্থায় কোনো দল বসে থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, লন্ডনের হাইকমান্ড থেকে ওনাদের শো’কজ করা হয়। এরপর ওনারা একটা কমিটি সাবমিট করেন, কিন্তু দলের সর্বোচ্চ হাইকমান্ড ওই কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়ায় উনারা আর কোনো কার্যক্রম করতে পারেননি। নির্বাচনে দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকায় লন্ডনের হাইকমান্ড আমাদের ডাকেন। আমাদের সাথে আলোচনা করে আমাকে এবং ঢালি নাসিরকে দায়িত্ব দেন নতুন কমিটি করার জন্য।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি এবং ঢালিসহ ৫ জনের সাথে তারেক রহমান বসেছেন, আমাদের কথা শুনেছেন এবং দলের সকল কার্যক্রম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর তিন মাস পরে খালেদা জিয়ার সম্মতিতে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়।
ঢাকা থেকে দলের বিদেশি কমিটির অনুমোদন দিতে বিএনপির গঠনতান্ত্রিক কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা জানতে চাইলে হাজি রাজ্জাক কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, গঠনতন্ত্রে কি লিখা আছে তা কি আপনি জানেন? আপনি ওই বিষয়ে কি জানেন? আপনি যে প্রশ্ন করলেন, গঠনতন্ত্রের কত নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা আছে জানেন? অফ যান, এই সাবজেক্টে অফ যান।
তাইফুর রহমানের দাবির কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, দাবি তো করতেই পারে। দাবি সে অনেক কিছুই করতেছে। দাবি করলে লাভ কি হবে? এর একমাত্র ক্ষমতা রাখেন তারেক রহমান সাহেব। তারেক রহমান সাহেব যেটা নিষেধ করে দিয়েছেন সেটা আবার কী?
আবদুর রাজ্জাক বলেন, মহাসচিব উনাকে (তাইফুর রহমান) কি বলেছেন তা আপনিও দেখেননি, আমিও দেখিনি। উনাকে বলেন, একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে তারেক রহমান কি বলেছেন, খালেদা জিয়া কি বলেছেন, মহাসচিব কি বলেছেন তা টেলিকনফারেন্স করে সবাইকে জানিয়ে দিতে। তাহলে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে উনি কার সাথে কথা বলেছেন। এমনি রাস্তায় বেড়ায়ে কথা বলবে, এটা কেমন তরো কথা?
তিনি বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ নেতা তারেক রহমান। উনি উনার দায়িত্বে ইউরোপের কমিটিগুলো ঢাকায় পাঠান। ঢাকা থেকে আবার উনার কাছে আসে। পরে আন্তর্জাতিক সম্পাদকের মাধ্যমে যার যার দেশে যায়। আমারটাও এই প্রক্রিয়ায় এসেছে।
স্বেচ্ছাসেবক দলের মিটিং এ আবদুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে মারামারি হয়েছে, এ প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, আপনি দেখেছেন আমার উপস্থিতিতে হইছে?
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডে দেখা যায় আবদুর রাজ্জাক এবং তাইফুর রহমানের উপস্থিতিতেই মারামারি শুরু হয়। মারামারি শুরু হলে তারা দু’জন এক পাশে সরে যান এবং সাধারণ সম্পাদক ঢালি নাসিরকে শেষ পর্যন্ত মারামারির মাঝে দেখা যায়। মারামারির এক পর্যায়ে হলের আলো নিভিয়ে দেয়া হয়। এর পরেও অনেক সময় তারা চেয়ার ছুড়াছুড়ি করে।
ভিডিও রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দিলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, এই ভাবে বলেন যে ছোটন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। ছোটন সাহেব কি প্রশ্ন করেছিল আপনি শোনেন নাই?
মারামারিতে সাধারণ সম্পাদকের অংশগ্রহণ বিষয়ে জানতে চাইলেন আবদুর রাজ্জাক বলেন, সাধারণ সম্পাদক ওখানে মারামারি করতে যাননি, তিনি উনার (ছোটন) প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েছিলেন। আমি সাধারন সম্পাদককে বলেছিলাম, কমিটির তালিকা দেখান। কিন্তু তার (তাইফুর রহমান) লোকজন মারামারি শুরু করে, তখন আমাদের কর্মীরা তা প্রতিহত কর।
এক পর্যায়ে হাজি রাজ্জাক বলেন, আপনাকে কে বলে এসব কথা? এই প্রশ্নগুলো করবেন না। এমন প্রশ্ন করলে তো আপনার সাথে আর কথা বলব না।
রোমের বাংলাদেশি পাড়ায় গুঞ্জন আছে হাজী আবদুর রাজ্জাক এক সময় আওয়ামী লীগের সাথে সখ্য রেখে চলতেন। আওয়ামী লীগের মিটিং-এ তার উপস্থিতির ছবিও দেখা যায় ফেসবুকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সামাজিক কাজ করি। বহু লোকের সাথে বহু ছবি আছে দীর্ঘ জীবনে। আমিও তো ফটো দিতে পারি- বিএনপির লোকজন আওয়ামী লীগের লোকজনকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে, কিন্তু সেটা কেন দিবো?
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যদি আপনার এলাকার কেউ আসে আপনি কি সেখানে যাবেন না? ওখানে আমি একজন জনপ্রতিনিধি ছিলাম। আমি ছিলাম গ্রেটার নোয়াখালীর সভাপতি। ওখানে ঢাকা সমিতি, ফরিদপুর সমিতিসহ বিভিন্ন সমিতির সভাপতিরা ছিলেন। ওখানে আমি কোনো বক্তৃতাও দেইনি। গিয়েছি আঞ্চলিক নেতা হিসাবে সম্মান জানাতে।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, যারা এসব বলে তাদের প্রশ্ন করেন- আমি যদি আওয়ামী লীগের হই তবে কীভাবে জিয়া পরিষদের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম? ইতালি বিএনপিতে ভোট করলাম কীভাবে? নমিনেশন পেলাম কীভাবে?
তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিএনপি করি। ১৯৯০ সাল থেকে আমি বিএনপির সদস্য। আমি যদি আওয়ামী লীগার হই আমার নমিনেশন বাদ দেয়া হলো না কেন?
হাজী আবদুর রাজ্জাক কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, ওদের প্রশ্ন করেন- এই গাধার বাচ্চা তোরা যে এইসব কথা বলিস- উনি কীভাবে ইলেকশন করল উনি যদি বিএনপির লোক না হয়? আমাকে ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোক না কি বিএনপির লোক?
কেন্দ্র থেকে অনুমোদিত কমিটি থাকার পরেও তাইফুর রহমান তার কমিটির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, এটা আমাদের দলের হাইকমান্ড যে ভাবে নির্দেশ দেয় সে ভাবে করব। তাছাড়া উনি (তাইফুর রহমান) তো আমাদের দলের একজন ভাই, বিএনপির একজন মানুষ। আমরা বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে কোনো দিকে যেতে দিবো না। আমাদের কাছে আটকে রাখার চেষ্টা করব।
রোমের বাংলাদেশ কম্যুনিটিতে গুঞ্জন আছে- সেচ্ছাসেবক দলের মিটিং-এ সাধারণ সম্পাদক ঢালি নাসির উদ্দিন তার লোকজন নিয়ে আগে থেকেই মারামারি করার প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যায় তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাহিদুর রহমানকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কমিটি কিনে এনেছেন। এসব বিষয়ে জানতে তার সাথে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৫২