আমি ইতালির ভেনিসে থাকি। অনেক বছর যাবৎ থাকি। সবসময় ভাড়া বাসায় থেকে এসেছি, এখনও থাকছি। গেল সপ্তাহে আমার বাড়িওয়ালা এসেছিলেন প্রায় চার মাস পর। তিনি আমার ভাড়া নেয়া বাসা থেকে মিনিট দশেকের দূরত্বে অন্য বাসায় থাকেন। ইচ্ছা করলে প্রতিদিনই আসতে পারেন, কিন্তু আসেন না। কোনো প্রয়োজনে যদি ফোন করি অথবা বিশেষ কোনো দরকার থাকে শুধু তখনই আসেন। আমার বাসা থেকে একঘর পরেই থাকে বাড়িওয়ালার মেয়ে লোরেনা। সেও কোনো দিন উঁকি দিয়ে দেখে না। বাড়িওয়ালা নিজে লোরেনার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছেন, কোনো সমস্যা হলে বিনাসংকোচে যেন তার কাছে যাই। লোরেনাও একই কথা বলেছে। আমি যাই না। কাউকে অহেতুক বিরক্ত করা আমার ধাতে সয় না। চলতে ফিরতে দেখা হলে কুশল বিনিময় করা, সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নেয়া এই পর্যন্তই।
গেল সপ্তাহে আমি লোরেনার কাছে গিয়েছিলাম। কারণ হলো বাড়িওয়ালাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তিন/চার দিন তার বাসায় ফোন করেছি, কেউ ফোন ধরে না। লোরেনা জানালো, তার বাবা পাহাড়ে গিয়েছেন, গ্রীষ্মকালীন অবকাশে। ফিরবেন দু’দিন পর। বিশেষ কোনো দরকার হলে আমি তাকেই বলতে পারি। আমি বললাম, বাসায় কিছু কাজ করানো দরকার। তোমার বাবা’র সাথে এ বিষয়ে আগে আমার কথা হয়েছিল। সে বলল, বাবা দু’দিন পর আসবে। দু’দিন পর তাকে পাওয়া যাবে। এই দু’দিনে কি তোমার খুব বেশি অসুবিধা হবে? আমি হেসে বললাম, দু’মাসেও কোনো অসুবিধা হবে না। সেও হাসলো। বলল, তবে দু’মাস পরেই বাবাকে আসতে বলবো।
আমি ভেবেছিলাম বাড়িওয়ালা অবকাশ থেকে ফেরার দু’চার দিন পরে ফোন করব। কিন্তু আমাকে আর ফোন করতে হলো না। দু’দিন পরেই, অর্থাৎ তিনি যেদিন অবকাশ থেকে ফিরেছেন সেদিনই এসে হাজির। প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আমি অবকাশে যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যেতে পারিনি। আমার মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম তুমি আমাকে খুঁজেছো। তিনি দরজায় দাঁড়িয়েই খোঁজার কারণ জানতে চাইলেন। বাসায় কাজ করার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে ভেতরে আহ্বান করলাম। তিনি ঘরের ভেতরে আসলেন না। বললেন, এখন ভেতরে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং আমি একজন মিস্ত্রি নিয়ে আসব। আমাদের সংস্কৃতি মতো আমি তাকে হালকা পিড়াপিড়ি করলাম, কাজ হলো না। তিনি আসলেন না। বললেন, হুটহাট কারও ঘরে ঢুকতে হয় না, এতে প্রাইভেসি নষ্ট হয়। বললাম, এটা তো তোমারই বাসা। তিনি হাসি দিয়ে বললেন, না, যত দিন তুমি ভাড়া নিয়েছো ততদিন এটা তোমার বাসা। যেদিন ছেড়ে যাবে সেদিন আমারটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে।
বাড়িওয়ালা যে আমার ঘরে ঢুকবেন না তা ধরে নিয়েই হালকা পিড়াপিড়ি করেছিলাম। কারণ আমাদের সংস্কৃতির যতগুলো উত্তম দিক আছে এর মধ্যে অন্যতম হলো আতিথেয়তা এবং সম্মান দেখানো। যা ইউরোপীয়দের মধ্যেও আছে, কিন্তু আমাদের মতো প্রাকৃতিক নয়। কেমন যেন খসখসে, ফরমালিন দেয়া।
একদিন পরেই বাড়িওয়ালা ফোন করলেন, মিস্ত্রি নিয়ে কখন আসবেন সে সময় জানাতে। আমি থাকতে পারব কিনা জানতে চাইলেন। যথাসময়ে তিনি মিস্ত্রি নিয়ে হাজির হলেন। কোথায় কোথায় কী কাজ করতে হবে আমি তাদের দেখালাম। একদিন পর কাজ শুরু করার কথা বলে তারা বিদায় হলেন। সময়মতো কাজ শুরু হলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম বাড়িওয়ালা নিজেই মিস্ত্রির সাথে কাজ করলেন। সত্তুরোর্ধ্ব মানুষটা সারাদিন মিস্ত্রির যোগালে হিসেবে কাজ করলেন। তাদের কাজ শেষ হওয়ার অগেই আমাকে বেরুতে হলো। আমার কর্মস্থলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। আমি বাসার চাবি বাড়িওয়ালার কাছে রেখে গেলাম। তিনি বললেন, কাজ শেষ হলে চাবি তার মেয়ের কাছে রেখে যাবেন, আমি যেন লোরেনার কাছ থেকে নিয়ে নিই।
ইতালিতে অভিবাসীদের কাছে অনেক বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে চায় না। বিশেষ করে এশিয়ান অভিবাসীদের কাছে। এর প্রধান কারণ হলো এশিয়ানরা বাসা নোংড়া করে ফেলে। ইউরোপীয়দের মতো করে আমরা বাসা পরিষ্কার পরিপাটি রাখি না। ব্যাচেলররা অনেক সময় দু’জন থাকার কথা বলে ৫/৬ জন থাকে। অনেক অভিবাসী ভাড়া না দিয়ে ঝামেলা করে। অবশেষে আইন আদালত করতে হয়। তাছাড়া এশিয়ানদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে ইউরোপীয়দের খাদ্যাভ্যাসে কোনো মিল নেই। আমাদের ভাজি, ভর্তা আর মসলার গন্ধে প্রতিবেশীরা অনেক সময় বিরক্ত হয়। তারা অভিযোগ করে। এসব কারণে অনেক বাড়ির মালিক এশিয়ান অভিবাসীদের একটু এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। কিন্তু তারা তা কোনো দিনই মুখ ফুটে বলে না, বলতে পারে না। ‘অভিবাসীদের বাসা ভাড়া দেয়া হয় না’ সাইবোর্ড লিখে ঝুলিয়ে রাখা তো অনেক দূরের কথা। এখানেই ইউরোপীয়দের সাথে আমাদের পার্থক্য, তাদের ভদ্রতাবোধ এবং আমাদের ভদ্রতাবোধের ফারাক। ইতালীয় আইনে বলা আছে- যদি কোনো বাসার মালিক কোনো অভিবাসীকে ‘অভিবাসী’ হিসাবে ছোট করে দেখে, তিরস্কার করে, বাসা ভাড়া দিতে না চায় বা যে কোনো প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় তবে তার বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগ করার সুযোগ আছে। আর এদেশের আইন তো সত্যিই অন্ধ। কে দেশি, কে বিদেশি, কার গায়ের রং কেমন তা দেখতে পায় না। আইন নিজস্ব গতিতে চলে। আইন তার শাসন কায়েম করতে বড়ই নিষ্ঠুর। সুতরাং আইনের প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধা রেখেই ইউরোপীয়রা জীবনযাপন করে, করতে বাধ্য হয়।
যেসব বাড়িওয়ালা বিদেশিদের কাছে বাসা ভাড়া দিতে চায় না তারা বাসা ভাড়া দেয়ার এজেন্সিদের কাছে চুপি চুপি বলে রাখে। এজেন্সিগুলো ওই সব বাসা অভিবাসীদের দেখায় না। অন্য মারফত কেউ খোঁজ নিয়ে গেলে ভিন্ন কোনো সমস্যা দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। এমন একটা সমস্যা দেখায় যা শুনে অভিবাসীরা এমনিতেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অন্য বাসা খুঁজতে শুরু করে। যদি কেউ বাসা খুঁজে না পায় বা বাসা সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়ে তবে পৌরসভার নির্দিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করতে পারে। দাতব্য সংস্থাগুলোয় যোগাযোগ করতে পারে। তারা সমস্যার সমাধানে সহযোগিতা করে। প্রয়োজনে কম ভাড়ায় বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (দুই, তিন মাস) বসবাসের ব্যবস্থা করে।
ইতালিতে অধিকাংশ বাসা ভাড়া হয় এজেন্সির মাধ্যমে। সরাসরিও হয়, কিন্তু তার সংখ্যা কম। এজেন্সি বা সরাসরি যেভাবেই হোক বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটা লিখিত কন্ট্রাক হয়। ওই কন্ট্রাকে বাসার ভাড়াসহ যাবতীয় বিষয় উল্লেখ থাকে। কেউ যদি বাসা ভাড়া না দেয়, বাসার কোনো ক্ষয়ক্ষতি করে, কোনো অপরাধমূলক কাজ করে তবে এর সমাধান বা শাস্তি কি তার আইনি ধারা উল্লেখসহ ওই কন্ট্রাক সরকারের নির্দিষ্ট দপ্তর থেকে রেজিট্রেশন করতে হয়। রেজিট্রেশনের একটা কপি থাকে বাড়িওয়ালা বা এজেন্সির কাছে, আরেকটা থাকে ভাড়াটিয়ার কাছে। পরবর্তীতে যদি কোনো সমস্যা হয় তবে বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটিয়া যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারে। এ সংক্রান্ত মামলা ফয়সালার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল আছে। বিচারক কন্ট্রাক পেপারে উল্লিখিত আইনের ধারা এবং শর্ত মোতাবেক বিচার করে দেন। বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটিয়া যদি কারও বিচার পছন্দ না হয় সে আপিল করতে পারে, তবে আপিলে ঠকে গেলে ওই মামলা পরিচালনায় আদালতের যত খরচ হয়েছে সব খরচ তাকেই গুনতে হয়।
ইতালিতে যদি কোনো ভাড়াটিয়া বাসার ভেতরে বা বাইরে কোনো অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত থাকে তার দায় কোনোভাবেই বাড়িওয়ালার উপর বর্তায় না। বাড়িওয়ালাকে গ্রেফতার করা হয় না, হয়রানি করা হয় না। কে ভালো মানুষ, কে অপরাধী তা বিবেচনা করা বাড়িওয়ালার কাজ নয়। অপরাধ প্রতিরোধ করা, অপরাধীকে প্রতিহত করা পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব, বাড়িওয়ালা বা সাধারণ জনগণের নয়। জনগণ সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে, প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে পারে, কিন্তু এসব করতে কেউ বাধ্য নয়। কোনো আদর্শ রাষ্ট্রে কাউকে বাধ্য করা হয় না। বাধ্য করলে সামাজিক প্রতিহিংসা সৃষ্টি হয়। সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হয়। নাগরিকের অধিকার বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং সম্মান খর্ব হয়।
বাড়ির ভেতরে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ প্রথমে দেখে বাসার মালিক রেজিট্রেশন করে বাসা ভাড়া দিয়েছিল কিনা। এর বেশি কোনো দায় বাড়িওয়ালার নেই, যদি সে নিজে সংঘটিত অপরাধের সাথে জড়িত না থাকে।
ইউরোপীয় জনগণ ভোট দেয়, ট্যাক্স দেয় শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য। নিজের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। পুলিশ বা অন্য কারও দায়িত্ব পালন করার জন্য নয়। কারও সাথে চোর পুলিশ খেলার জন্য নয়। অকারণে হয়রানির শিকার হওয়ার জন্য নয়।