ইতালির অন্যতম প্রাচীন এবং শিক্ষাবান্ধব শহর ব্লোনিয়ার সিটি সরকারের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়, জানতে চাই- মুহাম্মদ ইউনূসকে আপনারা কেন নাগরিকত্ব প্রদান করলেন? তিনি একগাল হেসে উত্তর দেন, বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস এখন বিশ্ব নাগরিক। তিনি গোটা দুনিয়ার অমূল্য সম্পদ। তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করতে পেরে মূলত আমরা নিজেদের সম্মানিত করেছি। তিনি আমাদের সম্মান গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করেছেন। মোহাম্মদ ইউনূস যে কত বড় মাপের মানুষ, বর্তমান বিশ্বে যে তার কতটা প্রয়োজন, তা বলে শেষ করা যাবে না।
মারিও উজেনিয় নামের ওই কর্মকর্তা তার শেষ কথায় বলেন, বাংলাদেশিদের সৌভাগ্য যে প্রফেসর ইউনূসের মতো একজন বড় মাপের মানুষ ওই দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমরা যুগযুগ ধরে অপেক্ষায় আছি একজন প্রফেসর ইউনূসের জন্য। বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক অস্থিরতায় তার মতো একজন ইউনূস আমাদের খুব প্রয়োজন।
গত ৮ জুলাই বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর ইতালির ব্লোনিয়া সিটি হলে এক জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাড়ে তিন’শ জন বিশেষ নাগরিকের উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে ব্লোনিয়ার মেয়র ভিরজিনিয় মেরোলা বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ব নাগরিক নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইতালির সংসদের স্পিকার লাউরা বোলদ্রিনি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদি, সিটি কাউন্সিলের সভাপতি এবং রোমানো প্রদির স্ত্রী সিমোনা লেমবি।
প্রফেসর ইউনূসকে ইতালির নাগরিকত্ব প্রদানের ওই অনুষ্ঠানে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির বেশ ক’জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তারা সেখানে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বখশির হাটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ করেন। ব্যুরো অব ইকোনমিক্সে গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে সে দেশে পড়তে যান। ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেন। সে সময় অনেক আধুনিক জীবন যাপনের হাতছানি থাকলেও তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে হাত দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জোবরা গ্রামের হতদরিদ্র নারীদের মধ্যে তিনি ক্ষুদ্রঋণ চালু করেন। এর সফল ধারাবাহিকতায় তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে আনেন। তার উদ্ভাবিত দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ‘সামাজিক ব্যবসা’ এখন বিশ্বনন্দিত।
গত ১ থেকে ৩ জুলাই ২০১৫ ইতালির বাণিজ্যিপ্রধান শহর মিলানোয় মুহাম্মদ ইউনূস সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ওয়ার্ল্ড ফোরামের অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত এক হাজার প্রতিনিধির সঙ্গে তিনি বিশ্বব্যাপী সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি এবং কর্মপদ্ধতি নিয়ে মতবিনিময় করেন।
অনুষ্ঠানে ইতালির কৃষি, খাদ্য ও বনবিষয়ক মন্ত্রী মাউরিসিয় মারতিনা, ইতালির সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী ও হিউম্যান ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট জোভান্নি মেলানদ্রি এবং ইতালির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপীয় নারী অধিকার কর্মী এম্মা বোনিনো প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে প্যানেল আলোচনায় যোগ দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ইতালির ব্যাংক ফাউন্ডেশন (কারিপলো ফাউন্ডেশন) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তৃতা করেন এবং ইতালিতে সামাজিক ব্যবসার জন্য ফান্ড গড়ে তোলার বিষয়ে ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট জুসেপ্পে গুজ্জেত্তি’র সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। তিনি সামাজিক ব্যবসাকে সমাজ বদলের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেন।
একজন বিশ্বনন্দিত মানুষকে নিন্দিত করে তোলা কী কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি হতে পারে? উত্তর হলো, পারে। আর সেই নিদারুণ ‘পারা’ দেশটি হলো আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমাদের সরকারের অনেক কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম এক কর্মসূচি হলো ড. ইউনূসের বিরোধিতা করা। তাকে নানা উপায়ে নিন্দিত করার চেষ্টা করা।
মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্মান করতে সরকারের পদক্ষেপ লজ্জাকর। এই লজ্জার মাত্রা যে কতখানি তা হয়তো দেশে বসে পুরোপুরি বোঝা যায় না। বোঝার জন্য বিদেশে আসা দরকার। আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা বুঝি ড. ইউনূস আমাদের কতটা সম্মানিত করেছেন। কতোভাবে সম্মানিত করেছেন। অথচ আমাদের সরকার তার অহেতুক এবং অযৌক্তিক বিরোধিতা করে বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাদের ছোট করছে। প্রতি পদে পদে আমাদের হেয় করছে। এ পরিস্থিতি খুব সচেতনভাবে সৃষ্টি করেছে আমাদের সরকার। ব্লোনিয়া সিটি সরকারের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি খুব কৌশলে সে কথা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশিদের সৌভাগ্য যে প্রফেসর ইউনূসের মতো একজন বড় মাপের মানুষ ওই দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমরা যুগ যুগ ধরে অপেক্ষায় আছি একজন প্রফেসর ইউনূসের জন্য’।
৭ জুলাই ইতালির মিলানো শহরের বিশ্ব বাণিজ্য মেলা এক্সপো ২০১৫ তে মূল বক্তা হিসেবে যোগ দেন প্রফেসর ইউনূস। তিনি বলেন, পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমান সুযোগ পেলে ভালো দক্ষতা দেখাতে পারে। এ সময় তিনি বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এক্সপো ২০১৫ তে ড. ইউনূসের সঙ্গে বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করেন ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো জেনতিলোনি।
মিলানোর সাবেক মেয়র লেতিজিয়া মোরাত্তি আয়োজন করেন ‘ব্যবসায় নারী’ শীর্ষক এক সেমিনারের। সেখানেও মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও ড্যানোন কমিউনিটি আয়োজিত সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড বিষয়ক এক কনফারেন্সে তিনি প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন।
মুহাম্মদ ইউনূসকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৫০টিরও বেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দেয়া হয়েছে। ১০ দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার দেয়া হয়েছে। প্রায় দেড়’শ বিভিন্ন পুরস্কারে তাকে ভূষিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ৩৪টি কমিশন এবং ৩৬টি উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য তিনি। কয়েকটি দেশের পাঠ্যবইতে ড. ইউনূসের জীবনী পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইউনূস চেয়ার’ স্থাপন করা হয়েছে। তাকে করা হয়েছে সম্মানজনক চ্যান্সেলর। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার এবং ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয় মুহাম্মদ ইউনূসকে।
মোহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন ২৮ জুনকে এখন বিশ্বজুড়ে অঘোষিতভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। হয়তো সে দিন বেশি দূরে নয়, জাতিসংঘ থেকে ২৮ জুনকে বিশ্ব সামাজিক ব্যবসা দিবস ঘোষণা করা হবে। তখন বিশ্বের সব দেশ একযোগে এই দিন পালন করবে।
প্রফেসর ইউনূসকে কেন্দ্র করে ইতালিয়ানদের আগ্রহ এবং সম্মান দেখানোর ব্যাকুলতা দেখলে সত্যিই মনের মধ্যে এক অন্যরকম ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। গর্বে বুক ভরে ওঠে। তারা এমন একজন মানুষকে সম্মান দেখাতে অস্থির, যে মানুষটার দেশ আর আমার দেশ অভিন্নÑ বাংলাদেশ। আমার গায়ের রং আর তার গায়ের রং একই রকম। আমার মায়ের ভাষা আর তার মায়ের ভাষা প্রিয় বাংলা ভাষা। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে!
মুহাম্মদ ইউনূসের ইতালি সফরকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মিডিয়ায় বিশেষ প্রস্তুতি লক্ষ করা যায়। পত্রপত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনসহ সব জায়গায় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তার খবর প্রচার করা হয়। প্রফেসর ইউনূসের কর্মজীবনভিত্তিক বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। কোনো কোনো মিডিয়া তাদের প্রতিবেদনের ফাঁকে ছোট করে মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশে প্রফেসর ইউনূস রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
বরাবরের মতো এবারও মুহাম্মদ ইউনূসের ইতালি সফরের দৃশ্যমান কোনো খবর রাখেনি আমাদের দূতাবাস। তবে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ইউনূস সাহেব কোথায় যান, কী করেন, বিশেষ করে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে কতটা মেশেন, সেসব খবর সংগ্রহ করে ঢাকার পাঠানোর নির্দেশ দেয়া ছিল উচ্চ মহল থেকে।
মুহাম্মদ ইউনূসের ইতালি সফরকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তবে সরকার সমর্থক একটা অংশ তাদের নেতাদের ভাষায় কথা বলে, গালিগালাজ করে। মজার বিষয় হলো, এই গালিবাজদের কেউ কেউ গোপনে সুযোগ খোঁজে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য।
এবারের ইতালি সফরে মোহাম্মদ ইউনূস উত্তর ইতালি থেকে দক্ষিণ ইতালির নাপলি শহরে এক দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় অংশ নেন। বিশেষ ওই ট্রেন যাত্রায় ইতালির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও ৫০ জন তরুণ তার সাথি হয়। এ সময় প্রফেসর ইউনূস বর্তমান বিশ্বে তারুণ্যের করণীয় বিষয়ে আলোচনা করেন। নাপলিতে মুহাম্মদ ইউনূস স্কামপিয়া পরিদর্শন করেন এবং লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল সমাবেশে বেকারত্ব, মাদক ও সন্ত্রাস বিষয়ে বক্তৃতা করেন। তিনি এসব সংকট সমাধানে তারুণ্যের করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:০৮