বিশ্বজিতের বাবা বা সহোদর সাহস পান না মামলা করতে। তাঁরা বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছেন পরকালের বিচারকের হাতে। তাঁরা তবু ভাগ্যবান, বিশ্বজিৎ বশির বা বায়েজিদ হয়ে জন্ম নেননি। নিলে বিশ্বজিৎকে নির্ঘাত জামায়াত-শিবির বানিয়ে দেওয়া হতো। বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের বানানো হতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীরসেনানী। মন্ত্রী আর নেতারা গর্বে বুক ফুলিয়ে বলতেন, জনগণ প্রতিরোধ করেছে হরতালকারীদের। কিছু লেখক, আলোচক, বুদ্ধিজীবী গণপিটুনিকে স্বাগত জানাতেন। বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা দ্রুতই বড় নেতা হয়ে উঠতেন। কোনোমতে পড়াশোনা শেষ করতে পারলে কোনো মন্ত্রীর এপিএস হতেন। কোনো দিন এই রাষ্ট্রের মন্ত্রীই হয়তো!
বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের কপাল খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুবকর হত্যা থেকে শুরু করে জাহাঙ্গীরনগরে জুবায়ের হত্যা পর্যন্ত বহু নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের সহকর্মীরা। কারও শাস্তি হয়নি এখনো। কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের রেহাই নেই। টিভি আর পত্রিকার ক্যামেরায় লাইভ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তাঁরা, কীভাবে এখন রক্ষা পাবেন! নাহিদ-লিমন, রাজন-রফিকুল—যিনিই হোন না কেন তিনি, তাঁকে এবার ধরা পড়তে হবেই। যেভাবে পত্রপত্রিকা ছেঁকে ধরেছে, খুব দ্রুত জামিনও তাঁরা পাবেন না হয়তো।
তবে বিশ্বজিতের খুনিদের বেশি ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একদিন যখন আরও বিশ্বজিৎ খুন হবেন, আরও ভয়াবহ কোনো তাণ্ডব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন সাংবাদিকেরা, সবার অলক্ষ্যে তাঁরাও জামিন পেয়ে বের হয়ে আসবেন। তারপর যদি বিচার হয়, সাজাও হয়, বিশ্বজিতের খুনি বীরসেনানীর হতোদ্যম হওয়ার কারণ নেই। এই রাষ্ট্রে খুনের আসামি হাইকোর্টের বিচারক হন, শততম ধর্ষণ উদ্যাপনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান, বাথরুমে বেঁধে জীবন্ত মানুষকে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা নরপশু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা লাভ করেন। কাজেই বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদেরও সুদিন আসবে একদিন। তাঁরা তো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই না রাজপথে বিএনপি আর জামায়াত-শিবির প্রতিরোধ করতে গিয়েছিলেন। মির্জা ফখরুলের ‘নির্দেশে’ তো আবর্জনাবাহী গাড়ির চালককে মারতে যাননি! মির্জা ফখরুল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৩৭টি মামলার আসামি হয়েছেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের অন্তত এতটা ভোগান্তি সইতে হবে না। বিরোধী দলের মহাসচিবের চেয়ে নিজ দলের খুনির মর্যাদা এখনো বেশি আছে এই রাষ্ট্রে! ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে হয়তো একই রকম ঘটনা ঘটবে।
দুঃখ শুধু হয় বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পরিবারদের জন্য। তাঁরা আসলেই মানুষ করতে চেয়েছিলেন সন্তানদের, পশু বানাতে নয়। এখন তাঁরা কে জামায়াত-শিবির; হত্যাকারীদের বাবা, ভাই, মামা ও চাচা কে কোন মাদ্রাসায় পড়তেন, কে কখন জামায়াত-শিবির বা বিএনপি করতেন—এসব শুনতে হচ্ছে তাঁদের। সেও আবার খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। তাঁরা সাধারণ মানুষ। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। বৈবাহিক সূত্রে হোক, জন্মসূত্রে হোক, এই রাষ্ট্রের অধীশ্বর আর তাঁর পারিষদের পরিবারে কি রাজাকার নেই? জামায়াত-শিবির নেই? তাঁদের প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, হত্যাকারীরা নিজেরা কোন ছাত্রসংগঠন করতেন? কেন নানা অপরাধে তাঁদের আগে কোনো বিচার করেনি সরকার? কেন তাঁদের কেউ কেউ আগেই বহিষ্কৃত হওয়ার পরও ছাত্রলীগের বড় নেতারা মিছিলের সামনে তাঁদের রেখে বীরদর্পে স্লোগান দিয়ে গেছেন এত দিন? কেন পত্রপত্রিকা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাঁদের গ্রেপ্তার করার কোনো আগ্রহ দেখায়নি সরকার? তাঁদের মামা-চাচারা জামায়াত বলে?
আমরা আমজনতা এসব প্রশ্ন বাদ রাখলেই অবশ্য ভালো। আমরা বরং পশুদের বিচার নিয়ে ব্যস্ত থাকি। প্রত্যক্ষদৃষ্ট খুনিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বিচারও হবে। আমরা বরং মুগ্ধ হয়ে তার উদ্যাপন করি। কী অসাধারণ রাষ্ট্র! কী অসাধারণ রাজনীতি! এই রাজনীতি হলে সিট পেতে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল করতে শেখায়, হলে সিট অব্যাহত রাখতে জোর করে মিছিলে গিয়ে দুই নেত্রীর বন্দনা করতে শেখায়, চাকরি-ব্যবসা পেতে হলে বা বড় নেতা হতে হলে লুটেরা বা খুনি হতে শেখায়। এই রাজনীতি ক্লাসরুম বাদ দিয়ে রাজপথ শেখায়, বই বাদ দিয়ে দরপত্র পড়া শেখায়, প্রেমিক না হয়ে ধর্ষক হতে শেখায়! মানুষ না, পশু বানানোর দীক্ষা দেয়!
মূল