somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পদোন্নতির বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের রায়! - ফরহাদ মজহার

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পদোন্নতির বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের রায়! - ফরহাদ মজহার

লোককথা : তারিখ: ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২
বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু স্কাইপি আদালতের বাইরে ‘বিধিবহি
র্ভূত’ ভাবে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বিচার-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনার দায় তিনি স্বীকার করেন নি। পদত্যাগের কারণ দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত। ‘বিধিবহির্ভূত’ কথাটা বলার কারণ হচ্ছেÑ যত দূর জানিÑ সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ২০০০ সালে বিচারপতিদের জন্য সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের ল্েয একটি আচরণবিধি (Codes of Conduct) তৈরি করেছিলেন। বিচারপতি নিজামুল হক এই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। গত রাতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একটি টেলিভিশানে বলেছেন, বিচারপতি নিজামুল হক অবশ্যই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। হয়ত জোর দেবার জন্য কথাটা ইংরেজিতে বললেন, ‘হি ডেফিনিটলি ভায়োলেটেড দ্য কনডাক্ট’। আইনজ্ঞ শাহদিন মালিককে যখন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জিজ্ঞাসা করলেনÑ বিচারপতি নিজামুল হক ড. জিয়াউদ্দিনের কাছে পরামর্শ চেয়ে ঠিক করেছেন কি না। তিনি বললেন, আমি একটু ঘুরিয়ে বলব। ঘুরিয়েই বললেন, ‘চেয়ে ভাল কাজ করেন নি’। এতে সাংবিধানিক নির্দেশ অনুযায়ী প্রণীত আচরণবিধির আইনি বিপদ থেকে বিচারপতি নিজামুল হককে বাঁচাবার চেষ্টা আছে। লাঠি তুলেছেন, কিন্তু সাপ মারেন নি। সে যা-ই হোক। বিচারপতি নিজামুল হক যা করেছেন তা অপরাধ। জুডিশিয়াল কাউন্সিল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। পদত্যাগের পর আর কিছু করার আছে কি না সেটা আইনজ্ঞরাই বলতে পারবেন।

পদত্যাগপত্রে বিচারপতি নিজামুল হক ঠিক কী লিখেছেন সেটা দেখি নি, তবে আইন প্রতিমন্ত্রীর সুবাদে তিনি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন, আমরা এটাই জেনেছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি যদি নিজের দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতেন তাহলে তাঁর পদত্যাগের নৈতিক, আইনি ও রাজনৈতিক সুফল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিছুটা পেত। ‘ব্যক্তিগত’ মানে হোলÑ তাঁর পদত্যাগের সঙ্গে তাঁর অপরাধের কোন সম্পর্ক নাই। এতে আপাতত মনে হতে পারে মুখরা হয়েছে। কিন্তু সেটা জোড়াতালি মাত্র। ট্রাইব্যুনাল আসলে তার প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা ও নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছে। মারাত্মক ভাবে। সেটা এখন উদ্ধার করা খুবই কঠিন হবে। নতুন ভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারপ্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করার কথা উঠেছে। এ ছাড়া সহজ কোন পথ আছে বলে মনে হয় না।

বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির কারণে বিচার বিভাগ ভেঙে পড়ছেÑ এই ধরনের অভিযোগ নতুন না, পুরানা। তবে বিচার বিভাগ যে ভেঙে পড়েছে, স্কাইপি সংলাপ হাতেনাতে তার প্রমাণ হয়েই এখন ধরা পড়ল।

কিন্তু একে নিছকই আওয়ামী কেলেঙ্কারি হিশাবে ভাবা ভুল হবে। বিচার বিভাগের দুর্দশা এই আমলে শুরু হয় নি। এই দায়ের ভাগ সব রাজনৈতিক দলেরই আছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি কাল মতায় এলে বিচারব্যবস্থা দৈবক্রমে ঠিক হয়ে যাবে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার আবার আগের মতই ঝুলে থাকবে। আওয়ামী লীগ আবারো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকা তুলে রাজপথ সহিংস করে তুলবে। তারা প্রচার করতে থাকবে জামায়াত-শিবিরের ষড়যন্ত্রের কারণে তারা তাদের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে পারে নি। যুদ্ধাপরাধের ত খুঁচিয়ে আরো বড় করে তোলা হবে।

অথচ এই তের নিরাময় না হলে বাংলাদেশ বারবার খোঁড়াতে থাকবে। প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা। দোষীকে তার দোষ অনুযায়ী শাস্তি, আর যারা নির্দোষ কিন্তু অভিযুক্ত, তাদের নির্দোষ প্রমাণ করবার সুযোগ করে দেওয়া ইনসাফের অন্তর্গত। তের নিরাময়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ অতি দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। এর আর কোন বিকল্প নাই। ত নিরাময়ের প্রক্রিয়া রুদ্ধ করে নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই দুর্দশা বাংলাদেশকে আবার পুরানা গর্তের মধ্যে নিপে করল।



১. পদোন্নতির বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের রায়?

অনেকের ধারণা ট্রাইব্যুনাল থেকে একটা আন্তর্জাতিক মানের রায় দেবার জন্য আদালতের বাইরে একজন বিচারপতির এই কথোপকথন ঠিক আছে। বিচারকদের আচরণবিধি নিয়ে যে কথা আগে বলেছি, সেই বিধি লঙ্ঘনের অপরাধ এতে মোচন হয় না। তর্কের খাতিরে যদি তা মেনেও নেওয়া হয় তবু এটা পরিষ্কার যে, দুই জনের আলোচনা কোন বিমূর্ত অ্যাকাডেমিক আলোচনা ছিল না। তারা চলমান বিচার নিয়েই কথা বলছিলেন। ব্যাপারটা মোটেও ‘আন্তর্জাতিক মানের রায়’ দেবার উদ্দেশ্যে ইনোসেন্ট আলোচনা ছিল না। একটা সুনির্দিষ্ট বিচারালয়ে আসামিপ বাদে আর যারা জড়িয়ে থাকেÑ যেমন, প্রসিকিউটর, নানান বিচারক, উকিল, এমনকি ওই বিচারালয়ের বাইরে অ্যাপিলিয়েট বিভাগ এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মন্ত্রী, সমাজের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিÑ সকলে মিলে পরিকল্পিত ও সমন্বিত ভাবে বিচারের নামে একটা দণ্ড শুনিয়ে দেবার তামাশায় রতÑ স্কাইপির সংলাপের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন কথোপকথন আছে যাতে মনে হয় পদোন্নতির বিনিময়ে ফাঁসির দণ্ড দেবার আয়োজন চলছে। বোঝা যায়, আদালতের শুনানি এবং বিচারের দিক থেকে স্যা-প্রমাণের গুরুত্ব নয়, বরং আগে থেকেই নির্ধারিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের তোড়জোড় চলছে। আইনি পরিভাষায় ‘প্রিজুডিস’ বা আগেই মাথা দূষিত করে রাখা বলে একটা কথা চালু আছে। এই প্রিজুডিস দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাইলেও মাথা হেঁট হয়ে যায়।

কোন আইনি পরামর্শের জন্য কথোপকথন হচ্ছে না। আলোচনায় স্পষ্ট যে, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন শুরু থেকেই অন্যতম একজন পরিকল্পনাকারী হিশাবে কাজ করছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য একটি টিম কাজ করছে। এই টিমের কাছে আন্তর্জাতিক মান রার অর্থ বিচারপ্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ বা সুষ্ঠু করা নয়, বরং কী ভাষায় রায় লিখে বাইরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায়। বিশেষত বিদেশিদের কাছে। মামলা শুনানি, সাী বাছাই, চার্জ গঠন, প্রসিকিউশনকে উপায় বাতলে দেওয়া, আগাম (বিচারের আগেই) রায় নির্ধারণ, মামলার শুনানি শেষে আগেই অন্যকে দিয়ে রায় লেখানো, আদালতের সমস্ত নথিপত্র আদালতের বাইরের একটা পরে সাথে শেয়ার করা। বিশেষত রায়ের একটা স্ট্রাকচার লিখে দেবার জন্য আদালতের বাইরের একজন ব্যক্তিকে বলাÑ এই সবই বিচারাধীন মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচারকের সরাসরি ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং বাইরের ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ ছাড়া আর কিছুই নয়।পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপ (প্রসিকউশন), সরকার, আপিল বিভাগের বিচারক এবং বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তির গোপন যোগাযোগ, উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এই সবই অপরাধ। এটা মিসকনডাক্ট বা আচরণবিধি লঙ্ঘন শুধু নয়, একই সঙ্গে আইন ও ন্যায়বিচারের নীতি লঙ্ঘন। কারণ অভিযুক্তের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করবার ষড়যন্ত্র চলেছে, অভিযুক্তকে বিচার না করে শাস্তি দেবার মত জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারা।



২. শুধু ট্রাইব্যুনাল নয়, পুরা বিচার বিভাগই

মুখথুবড়ে পড়েছে

ট্রাইব্যুনালের মুখথুবড়ে পড়ার মধ্য দিয়ে মূলত পুরা বিচার বিভাগই মুখথুবড়ে পড়েছে। বিচার বিভাগ যে আসলে ভেঙে পড়ছে তার লণ অনেক দিন আগে থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শরীরে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা মারাত্মক ব্যাধি এখন সামনে উপদংশের মত বেরিয়ে পড়ল। আসলে বিচারব্যবস্থার সঙ্কটকে সামগ্রিক ভাবে আমাদের বুঝতে হবে। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা আর বিচার ও ইনসাফ কায়েমের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, তাকেও মনে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের আবেগ সাধারণ মানুষ হিশাবে আমাদের অন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগকে সেই কুয়াশা থকে মুক্ত রাখা দরকার ছিল। সেটা হয় নি। আদালতের দায় শুধু আমাদের প্রতি নয়, বাংলাদেশের নাগরিক হিশাবে অভিযুক্তের প্রতিও রয়েছে।

ট্রাইব্যুনালকে বাংলাদেশের সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেখবার কোন সুযোগ নাই। নাগরিকদের দিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা অবশ্য আদালত অনেক আগেই খুইয়েছে। আদালত দুর্নীতির জায়গা, গরিব এখানে বিচার পায় না। এই অবস্থান থেকে ক্রমে ক্রমে আমরা দেখছি আদালতের কাছে সুবিচার পাবে সেটা সাধারণ মানুষ আর বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাস সমাজে কিভাবে নিষ্ঠুর হত্যার যজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ স্পষ্ট। ছিনতাইকারী বা ডাকাত সন্দেহে প্তি জনগণ এখন মানুষ পিটিয়ে মারে। আদালত বা বিচারের অপো করে না। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। বিচারব্যবস্থার ব্যাধি বা য়ে এখন পুরা সমাজ আক্রান্ত। জনগণের মধ্যে পিটিয়ে হত্যার যে মানসিকতা দেখি, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিও একই মানসিকতা দেখা যায়। যারা গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক নেটওয়ার্ক সফর করেন, তারা জানেন যে ‘বিচার’ কথাটা নিছকই কথার কথা হিশাবে বলা হয়। মূলত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়াকেই ‘বিচার’ বলা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। অভিযুক্ত আদৌ দোষী নাকি নির্দোষ বা দোষী হলেও তার অপরাধের মাত্রা কীÑ এই সব মোটেও বিবেচ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, আদালত ক্ষমতাসীনদেরÑ সেটা নির্বাচিত রাজনৈতিক দল হোক কিংবা হোক সেনাবাহিনীÑ যে যখন আসে তার ভাড়া খেটেছে বিভিন্ন সময়। এই ইতিহাসই প্রতিষ্ঠান হিশাবে আদালতের অন্তর্গত চরিত্র হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন নয় যে, প্রতিষ্ঠান মানে কিছু বিল্ডিং যেখানে বিচারকরা বিচার বসান। এ জন্য পণ্ডিতরা বলেন, আদালত বা বিচারব্যবস্থার ইতিহাসের মধ্যে রাষ্ট্রের আত্মজীবনীর সারাংশ লেখা থাকে।

প্রতিষ্ঠান হিশাবে বিচার বিভাগের চরিত্র সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, বিচার বিভাগ নিজের কর্মকাণ্ড দিয়েই তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। সম্প্রতি বিচারকদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা দ্রুত মন্দ হতে শুরু করেছে। এর কারণ আছে। বিচারকরা নাগরিকদের মৌলিক সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার রা করার পরিবর্তে নিজেরাই তা লঙ্ঘন করতে শুরু করেছেন। যেমন, জামিনযোগ্য অপরাধের জন্য জামিন না দেওয়া, অভিযুক্তকে নির্যাতন করে তার অপরাধের জন্য স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য রিমান্ডে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। পুলিশের নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে বিচারকদের সামনে দাঁড়াবার পরেও আবার রিমান্ডে অভিযুক্তকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার মত অমানবিক কাজ করা, ইত্যাদি। বিচারকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচারব্যবস্থার ভয়াবহ অবয়কেই নির্দেশ করে। আজ বিষফোঁড়ার মত তা ফেটে বেরিয়ে এসেছে মাত্র।

জনগণ দেখেছে বিচার বিভাগ পত্রিকার সম্পাদকদের আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, নাগরিকদের আদালতে এনে তাদের সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেছে। এমনকি ২০০৯ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে আদালত অবমাননার জন্য সাজা দিয়েছে আদালত। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝেছিল কী ঘটছে। আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব জয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ এবং এ দেশের বিচার বিভাগের সার্বিক অবয়ের কাহিনী প্রকাশ করবার কারণেই দৈনিক আমার দেশ সরকারের রোষানলে পড়েছিল। মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দেবার এই অর্থই সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। অর্থাৎ বিচার বিভাগের ভাঙনের লণ দেখা গিয়েছিল দীর্ঘদিন আগে থেকেই। পচন চলছিল অনেক দিন ধরে। এখন সেই পচনের দুর্গন্ধ নিয়েই ট্রাইব্যুনাল মুখথুবড়ে পড়ল।



৩. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোন সমালোচনা আমলে নেয় নি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ দেশে এবং বিদেশে করা হয়েছে তার মূল সুর হচ্ছে ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এই ব্যর্থতার পরিণতি সম্পর্কে বারবার সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু কর্মকাণ্ডে এটাই মনে হয়েছে যে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি ও যুদ্ধাপরাধের বিচার-সংক্রান্ত গতবারের নির্বাচনী ঘোষণা যেকোন ভাবে বাস্তবায়ন করতে ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করছে মতাসীনরা। অভিযোগ হচ্ছে, আসলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারের ছলনা করছে। মতাসীনদের নির্দেশে কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়াই এর কাজ। বিচার নয়। কাউকে ঘৃণা করি বলে তাকে শাস্তি দেওয়া এক জিনিস, আর কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে স্যা-প্রমাণ দেখে সে দোষী না নির্দোষ বিচার করা ভিন্ন জিনিস। এই সকল অভিযোগকে ট্রাইব্যুনাল কখনোই আমলে নেয় নি। মতাসীনরা ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে এসেছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। এই প্রচারের আড়ালে তারা নিজেদের নিরাপদ ভেবেছে।

বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ব্যবস্থার দিক ছাড়াও দুর্নীতিবাজ ও নীতিহীন বিচারকদের সংখ্যাও কম নয়। বিচার বিভাগের দলীয়করণ আরেকটি দিক। এই সব নিয়ে লেখালিখি-কথাবার্তা হয় প্রচুর। কিন্তু সেই সব লেখালিখি কথাবার্তা অধিকাংশই একদেশদর্শী। আওয়ামীবাজ প এর জন্য বিএনপিকে আর বিএনপি মার্কা পত্রিকা ও বুদ্ধিজীবীরা এর জন্য আওয়ামী লীগকে অভিযোগ করে আসছে। আর যারা অতি চতুরÑ নিজেদের নিউট্রাল প্রমাণ করতে ব্যস্তÑ তারা দুই দলকেই দায়ী করে। এই অবস্থান নেবার কারণে তাদের উপসংহার দাঁড়ায়Ñ রাজনীতি মাত্রই খারাপ, একমাত্র সমাধান তখন হয়ে ওঠে দেশকে রাজনীতিমুক্ত করা। দলবাজিতার চেয়ে বিরাজনীতিকরণের এই সুশীলতা আরো ভয়ঙ্কর।



৪. কী করতে হবে : বিচার বিভাগীয় তদন্ত

এটা পরিষ্কার যে মতাসীনরা মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ পত্রিকার ওপর প্তি হয়ে উঠবে। আদালত অবমাননার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা, শাস্তি দেওয়া, আমার দেশ বন্ধ করাÑ ইত্যাদি যেকোন পদপে নিতে তারা দ্বিধা করবে না। ফলে নাগরিক হিশাবে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছেÑ আমার দেশ পত্রিকার ভূমিকা সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা। এই ধরনের হামলা এলে এই পত্রিকার পাশে দাঁড়ানো। আমার দেশ পত্রিকা বিচারব্যবস্থার অধঃপতনের বিরুদ্ধে লড়ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই লড়াই করতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান জেলেও থেকেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। ফলে ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারকের অনৈতিক ও অপরাধমূলক ভূমিকা ফাঁস করে দেওয়া তাঁর লড়াইয়ের ধারাবাহিকতারই অংশ। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ নয়, বরং যেন স্বচ্ছ হয় তার জন্যই এই লড়াই। এই লড়াই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। যে বাংলাদেশে বিচার বিভাগ মতাসীনদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার না হয়ে নাগরিকদের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার রা করবে। মনে রাখা দরকার মতাসীনরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে না, করছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে এমন একটি বিচারব্যবস্থাÑ যা সরকার ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগও জাতীয় সংসদ থেকে ‘পৃথক’ বা ‘আলাদা’ ভাবে কাজ করে। ‘পৃথক’ ও ‘আলাদা’ ভাবে কাজ করার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দুই বিভাগ থেকে পৃথক বা আলাদা ভাবে কাজ করার অর্থ বিচার বিভাগের ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে না। বিচার বিভাগ কখনোই জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ঊর্ধ্বে বা বাইরের ‘স্বাধীন’ কোন প্রতিষ্ঠান নয়। বরং জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অধীন। যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র হিশাবে জনগণ প্রণয়ন করে। বিচার বিভাগের জন্ম বা গঠনও এই দলিলের ভিত্তিতেই ঘটে। জনগণের অধীনস্থতাÑ অর্থাৎ জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রার দায় পালনের মধ্য দিয়েই বিচার বিভাগ নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করে। বিচারক আদালতে বসেন ঠিকই, তিনি নির্বাচিত নন, কিন্তু জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার মধ্য দিয়েই তিনি গণতন্ত্রের পাহারাদার হয়ে ওঠেন। এই পাহারাদারি বাদ দিয়ে বিচারব্যবস্থা যখন মতাসীনদের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়, বিচারকে যখন প্রহসনে পরিণত করা হয়Ñ তখন সেই ব্যবস্থাকে উৎখাত করে বিচার বিভাগকে নতুন গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না। এই সকল মৌলিক প্রশ্ন বাদ দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে বিচারের নামে বিচারকদের স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠা করা। তার কাফফারা এখন আমাদের গুনতে হচ্ছে।

তবে অবিলম্বে যে কাজ করা দরকার তা হচ্ছে এই ঘটনার পূর্ণ বিচার বিভাগীয় তদন্ত। এর সঙ্গে আর কে বা কারা জড়িত আছে তা পুরাপুরি জানা দরকার। বিচারপ্রক্রিয়াকে সত্যিকার অর্থে ‘বিচার’-প্রক্রিয়া করে তুলতে হলে বিচার বিভাগকে অবশ্যই দায়দায়িত্ব নিতে হবে।

পদত্যাগী বিচারক আগামিতে হাইকোর্ট বেঞ্চে কিভাবে বসেন, সেই বিষয়েরও ফয়সালা হওয়া দরকার। পদত্যাগেই ঘটনার ইতি হতে পারে না। এই ধরনের সমস্যা রোধ কিম্বা বিচারপ্রক্রিয়াকে এভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা বন্ধ করবার কার্যকর উপায় খুঁজতে হবে।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×