সুইডেনে প্রতিটা শিশুকে ঠিক ততটাই গুরুত্ব দেয়া হয় ঠিক যতটা গুরুত্ব একটা শিশুর প্রাপ্য । এখানে অনেক বাবা,মা আছে যারা এখানে পার্মানেন্ট না ( জব বা পড়াশুনার জন্য কিছুদিন বা কয়েক বছর থেকে চলে যাবে), অনেক বাবা,মা এখানে অবৈধ ভাবে আছেন কিন্ত এসবের জন্য তাদের শিশুদের প্রতি কোন বৈষম্য করা হয় না I প্রতিটি শিশুর জন্য রয়েছে একই সমান সুযোগ সুবিধা। শিশু নির্যাতনের ব্যাপারে সুইডেনের জিরোটলারেন্স নীতি কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি মনে হলেও পর ক্ষনে মনে হয় ওরাই ঠিক। শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। এরাই গড়ে তুলবে এক নতুন বিশ্ব কিন্ত যদি সঠিক ভাবে তাদের বিকশিত হবার সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে তারা হবে জাতির জন্য বোঝা। এখানে কোন শিক্ষক কোন ছাত্র - ছাত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন এমন কথা শুনিনি আমি নিজেও ক্লাস ফোর থেকে এখানে পড়াশুনা করছি এমন কোন শিক্ষকের দেখা পাইনি । বরং দেখেছি, শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতা,আন্তরিকতা I কোন স্টুডেন্ট যদি পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়, কেন ? এই কেনটাকে খুঁজে বের করার জন্য কত চেষ্টাই না করেন। শুধু পড়াশুনাই না কোন স্টুডেন্ট মানসিক বা শারিরীক দিয়ে দূর্বল থাকলে সেই দূর্বলতা কি ভাবে কাটানো যায় সে ব্যাপারে এরা চেষ্টা করে। পড়াশুনাকে ভীতিকর না করে কি ভাবে আনন্দদায়ক যায় তাই এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ঠ্য। তবে শাসন যে করে না তা কিন্ত নয় তবে সেটা পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে নয়।এরা মনে করে প্রতিটা শিশুর জীবন বিকাশের অধিকার রয়েছে। এর জন্য বাহিরের সহিংসতা থেকে যেমন,তেমনি পারিবারিক সহিংসতা থেকেও শিশুকে রক্ষা করতে হবে। পিতা মাতা তার সন্তানকে অবশ্যই বড় করবে,একটা শিশুর অধিকার রয়েছে সুন্দর শৈশবের। তাই বাবা মাকে সন্তানকে ঘরে সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে যাতে তার সন্তানের শারিরীক মানসিক বিকাশ সুন্দর ভাবে হতে পারে ।
কোন ঘরে যদি পারিবারিক সংঘাত বিরাজ করে,সন্তানের সঠিক ভাবে যত্ন নেয়া না হয়, শিশু বলে যদি তার মতামতের গুরুত্ব না দেয়া হয়, তার গোপনীয়তা রক্ষা করা না নয় (তার বিনা অনুমতিতে তার ডায়রী বা চিঠি পড়া হয়) এগুলো শিশুনির্যাতনের মাঝে পরে। আর এব্যাপারে কোন বাচ্চা যদি স্কুলে অভিযোগ করে তাহলে বাবা,মায়ের অবস্থা শোচনীয়। প্রয়োজনে অভিভাবকের কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে নেয়া হবে ।আর এই সমস্ত সিদ্ধান্ত একটা শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে নেয়া হয়। কারন শিশু নির্যাতনের বৈশিষ্ট্যটি হ'ল সহিংসতা যা শিশুর জন্য মারাত্মক মানসিক পরিণতি ঘটাতে পারে। তাই সুইডেন সরকার চায় এই রকম নির্যাতিত শিশুদেরকে একটি ভালো পরিবেশ তৈরী করে দিতে যাতে শিশুর শারীরিক মানষিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত না হয় তাই তাদের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। এতো বল্লাম আধুনিক সুইডেনের কথা।
আমরা যদি সারে চৌদ্দ শত বছর আগে আমাদের নবী,রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সময়ে ফিরে দেখি , উনি কি রকম আচরন করেছেন শিশুদের সাথে আর কি বলেছেন শিশুদের সম্পর্কে।শিশুর প্রতি আচরণ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যেব্যক্তি শিশুকে স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান দেখায় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ১৯২১) I আবুহুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একবার রাসুল (সাঃ) নিজ নাতিহাসান (রা.)-কে চুমু খেলেন। সে সময় তার কাছে আকরা বিনহারেস উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি দশ সন্তানেরজনক। কিন্তু আমি কখনও তাদের আদর করে চুমু খাইনি।তখন মহানবী (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করেনা, তার প্রতিও দয়া করা হয় না’ (বোখারি, হাদিস নং:৫৬৫১) I আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার এক ব্যক্তিমহানবী (সা.)-এর কাছে হাজির হয়ে বলল, আমার হৃদয় খুবকঠিন। তিনি বললেন, তুমি কি তোমার অন্তর কোমল করতে চাও? সে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন, তাহলে এতিমবাচ্চাদের আদর করো, স্নেহ-ভালোবাসা প্রদান করো, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, তাদের খাবার দাও। তবেই তোমার অন্তর কোমল হবে।”উনি তো পৃথিবী এসেছিলেন একজন শিক্ষক হিসাবে। তিনি নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয় আমি শিক্ষক রূপে প্রেরিত হয়েছি’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৯)। তার অনুপম শিক্ষানীতি ও পদ্ধতিতে মুগ্ধ ছিলেন তার সাহাবি ও শিষ্যগণ। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘তার জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তারপূর্বে ও পরে তার চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি’(সহিহ মুসলিম)I তারপর রাসুল ( সাঃ) এর সাহাবী-তাবেয়ীন-তাবে-তাবেয়ীনদের যুগেবাচ্চাদেরকে মারধর করিয়ে পড়ানো হতো, এমন কোন কিছু আমি এখনো কোন বইয়ে পাইনি, আপনারা কেউ কি পেয়েছেন ?
স্কুলের সব পর্যায়েই (ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রেতো বলাই বাহুল্য) শারীরিক শাস্তির ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা দরকার ।আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার নামে(মাদ্রাসা আর স্কুল ব্যবস্থা) বাচ্চাদেরকে মারধর করার এইকালচারটির জন্য শুধু একশ্রেণীর শিক্ষকই দায়ী তা কিন্ত না। এর জন্য আমাদের দেশের কালচার আর শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশেই দায়ী আর কিছু বাবা-মাও দায়ী।
আমার আম্মুর কাছে শুনেছি, আমাদের এক আত্বীয় তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে যাচ্ছে সাথে বাঁশ ঝাড় থেকে চিকন বাঁশ নিয়ে I সেটা টিচারের হাতে দিয়ে বলে, আজকে থেকে এর শরীরের গোস্ত আপনার হারগুলো আমার। আমার এক কাজিন বর্তমানে সে কানাডাতে আছে। সে যখন ফিফ্থ গ্রেডে পড়তো তখন একদিন স্কুলে (মাদ্রাসায় না কিন্তু) না যাওয়াতে টিচার তাকে বেত দিয়ে এমন করে মেরে ছিল যে কয়েকটা আঘাত হাতের একই জায়গায় পরাতে তার হাত ফেটে গিয়েছিল I সে বাড়িতে এসে তার বাবা,মাকে জানালে উনারা উল্টো তাকেই বকে ছিল। তার সেই দাগ এখনো আছে। এমন অনেক বাবা,মা-ই আছেন যারা মনে করে স্কুলের/ মাদ্রাসার কঠিন শাসন বাচ্চাদের জন্য কল্যাণকর।এটা আামাদের দেশের একটা ব্যাড ক্যালচার। সিস্টেমের প্রশ্নটা আসে এজন্যই আমাদের দেশে শিক্ষা সিস্টেম স্টুডেন্ট বা টিচার কারো জন্যই আনন্দদায়ক না, যেটা আমি এখানে পেয়েছি ( এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বল্লাম আমি ক্লাস নার্সারি থেকে ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়েছি)যেই কাজে আনন্দ পাওয়া যায় না, সেই কাজে কখনো ভালো রেজাল্ট আসে না। যার কারনে স্টুডেন্টরা হয় পড়ার প্রতি অমনোযোগী আর টিচাররা দায়সারা দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে হয়ে যায় রাগী। এছাড়া বাচ্চাদের পড়াশোনার দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে অনেক বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানগত ইস্যু জড়িয়ে আছে । সেটা সব ধরণের পড়াশোনার জন্যই একই রকম সত্যি । একজন নিম্নবৃত্ত ঘরের যে সন্তান মাদ্রাসা শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে তার কি শিক্ষা সম্পর্কিত সেই বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানগত বিষয়গুলো জানা আছে না থাকার কথা ?সরকারকে সব পর্যায়ে শিক্ষা দেবার কারিগর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সমন্বিত একটা কারিকুলার তৈরী করতে হবে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকলে শিক্ষক হয়তো ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি দেবেন না কিন্তু অর্থবহ শিক্ষা দানও করতে সক্ষম হবেন না।
স্কুল বা মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের শারিরীক শাস্তি দেবার এই ব্যাড ক্যালচার থেকে বের হতে হলে বাবা,মা, শিক্ষক , আলেম-উলামা, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুলে, এতিমখানায়, মাদ্রাসায়, ঘরের ভিতরে, রাস্তা-ঘাটে, কোথাও শিশু নির্যাতন কাম্য নয়। একটি শিশুকে যখন নির্যাতন করা হয়,অমানুষিকভাবে পেটানো হয় হোক শিক্ষক বা পিতা-মাতারদ্বারা এই শিশুটি সারা জীবনের জন্য মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়, হয়ে যেতে পারে বড় ধরনের কোন ক্ষতি।হয়ত তার আগামী ভবিষ্যতটাই হয়ে যেতে পারে অন্ধকার। মাদ্রাসার হুজুর মেরেছেন বলেই সেটা ইসলামে অনুমোদন আছে সেটা না । মাদ্রাসা হোক আর স্কুল সব জায়গাতেই বাচ্চাদের শিক্ষা দানের জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিয়ের ব্যাবস্থা থাকা দরকার শিক্ষকদের । একজন শিক্ষকের সমস্যার কারনে পুরো শিক্ষা সিস্টেম বাতিল করে দেবার ক্যানসেল ক্যালচার কারো লাভ হবার সম্ভাবনা নেই বরং তাতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি ।যে কারো মন্দ কাজের প্রতিবাদ আমাদের করা উচিত। তবে মানুষের মন্দ আচরণের প্রতিরোধ করতে হবে উৎকৃষ্ট আচরণ দিয়ে। অথচ আমরা মানুষের মন্দ আচরণে আরো নিকৃষ্টতর মন্দ আচরণ করে থাকি। এটা মোটেই কাম্য নয়।কারন মন্দ আচরন দিয়ে আপনি কখনো ভালো কিছুর প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। শুধু নিজের কুৎসিত চেহারাটাই প্রকাশ হয়ে যাবে সবার কাছে।
ফটো লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:০৯