১: প্রকৃতির নিয়মে দিন অনেক ছোট এখন । মাগরিবের নামাজ এখন সারে তিনটায় , ছয়টা সাতটায় অনেক রাত। অবশ্য স্কুল কলেজ, অফিস আদালত সময় ধরেই চলে, তাই সকালে অন্ধাকারই ঘর থেকে বের হয়ে আবার অন্ধকারেই ঘরে ফিরে।সুইডেনের এই সময়ের ওয়েদার খুবই বাজে, না আছে সূর্য আর না স্নো সারাদিন কেমন মেঘলা মেঘলা সাথে বাতাস, মাঝে মাঝে বৃষ্টি, রাস্তা ঘাট ভেজা ভেজা থাকে। বাজে ওয়েদারও এখানে জন জীবনে প্রভাব ফেলে না সব কিছুই স্বাভাবিক মতই চলে।
দুইদিন আগে ওয়েদারটা ছিল ভীষন খারাপ , প্রচন্ড বাতাস সাথে হাল্কা হাল্কা বৃষ্টি আমি সন্ধ্যা ছয়টার ( আসলে তখন রাত ) দিকে হাঁটতে বের হয়েছি , প্রায় তিন কিলোমিটার যেয়ে ব্যাক করেছি বাসার দিকে । অন্ধকারটা আরো একটু গভীর হয়েছে বৃষ্টিটা আরো একটু বেড়েছে তবে বাতাস আগের মতই আছে আমি হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছেই চলে এসেছি মানে বাসা দেখা যাচ্ছে ।
পাশেই গাড়ির রাস্তা থেকে হঠাৎ হ্যা—-লো ডাকে তাকিয়ে দেখি একলোক গাড়ি থামিয়ে জানালার গ্লাস নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মানে সে আমাকেই হ্যালো বলেছে, আমি তার দিকে তাকানোর পর ,
- আমি তোমাকে ড্রাইভ দিতে পারি ।
- লোকটার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে একটু উচ্চ আর রাগী সুরেই বলি,এই তুমি আমাকে কই ড্রাইভ দিবা!! ( হাত দিয়ে দেখিয়ে বলি) ঐ তো আমাদের বাসা ।
- লোকটা ওকে ওকে বলে দ্রত গাড়ি চালিয়ে চলে যায় ।
পরে অবশ্য আমার খারাপ লেগেছে লোকটা এভাবে কেন বল্লাম।
২: এই ঘটনাটা অনেক আগের,তখন খুব বেশীদিন হয়নি সুইডেনে আমাদের । আমাদের পাশে একটা ফ্যামেলী ছিল। মা ও দুই মেয়ে, উনারাও নতুন। আমার সঠিক মনে নেই তবে খুব সম্ভবত লেবানীজ। ওখানে আমরা অল্পদিন ছিলাম কিন্ত আমার ভাবীর সাথে মহিলার বেশ ভাব হয়েছিল।একদিন উনি আমাদের দাওয়াত করেন ।
আমরা যাই , উনি অনেক কিছু রান্না করে টেবিল সাজিয়েছেন। পোলাও ( ভাত রান্না করে তেলে ভাজা ) চিকেন ফ্রাই , বড় চিংড়ী ফ্রাই , সবজী সিদ্ধ , গরুর গোস্ত মিষ্টি জাতীয়ও কিছু ছিল কিন্ত টেবিলে কোন প্লেট নেই ।
আমরা তিনজন উনারাও তিনজন মোট ছয়জন টেবিলের চারপাশে বসলাম উনি সবার হাতে একটা করে চামচ দিয়ে আমাদের তাগাদা দিলেন নেন নেন শুরু করেন। আমি তো ছোট ভাইয়া ভাবী কেউই বুঝতে পারছেনা কি ভাবে শুরু করবে। আমার ভাবী খুব বুদ্ধিমত্বার সাথে বলেন, আসিয়া তুমি কত কষ্ট করে রান্না করেছ তুমিই প্রথম শুরু করে। আসিয়া খুশীতে গদ গদ হয়ে শুরু করলেন, সাথে উনার মেয়েরাও, ভাতের ডিস থেকে এক চামচ ভাত মুখে দেয়, এর পর একটু মুরগী, আবার রুটি , আবার সবজীর প্লেট থেকে সবজী এভাবে যার যেটা পছন্দ সে সেটা নিয়ে খাচ্ছে। আমার ভাইয়া , ভাবীও উনাদের মত খাওয়া শুরু করলেন। আমি আর কোন স্যার আমি একপিচ মুরগী নিয়ে শুরু করলাম।কি মজা এক প্লেট থেকে সবাই খাবার নিয়ে খাচ্ছে।
৩: এখানে সমাজ সেবামূলক ছোট বড় অনেক সংস্থা আছে , এরা বিনা পয়সায় মানুষকে বিভিন্ন রকম সেবা দিয়ে থাকে । যে কেউ চাইলে ফ্রীতে সেবা দিতে পারে আবার কারো প্রয়োজন হলে সেবা নিতেও পারে । কলেজে পড়ার সময় আমরা কয়েক জন এরকমই একটা সংস্থাতে নাম লিখেছিলাম , নিজের পুরানো কাপড়, জুতো ছাড়া অন্য কোন সেবা দিতে পারিনি। করোনার জন্য এই বছর সামারে কোন জব করিনি, তাই মনে হল অলস বসে বসে সময়টা পার করবো! নাহ্ ! তা কি করে হয় একটা কিছু করা দরকার এটা ভেবে উনাদের সাথে যোগাযোগ করে জানালাম, আমি তোমাদের এই সামারে কিছু সময় দিতে চাই যদি তোমাদের দরকার হয় তাহলে আমাকে ডেকো । কয়েকদিন পর ওনারা ফোন দিয়ে জানালেন আমাদের দুইটা অপশন আছে (১)একজনকে কিছু বাজার করে দিতে হবে (২) একজনকে কিছুটা সময় সংগ দিতে হবে । আমি দ্বিত্বীয়টাই বেছে নিলাম কারন বাজার টাজার আমি ভালো বুঝি না ।
আমার এক পাকিস্তানি বান্ধবীও এখানকার সদস্য তাকে নিয়ে আমরা ঐ মহিলার বাসায় গেলাম। এটা আমাদের এলাকা থেকে বেশ দুরে সুন্দর ও নিরিবিলি এলাকা।
দরজায় নক করার পর এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা দরজা খুলেন, আমাদের পরিচয় জানার পর ভদ্র মহিলা হাসিমুখে আমাদের ভিতরে ওয়েলকাম করলেন ও জানালেন উনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন ।
সাজানো গুছানো পরিপাটি লিভিং রুম দেখে উনার সুরুচি ও অভিজাত সম্পর্কে একটা ভালো ধারনা নিয়ে আমরা বসলাম । উনার বয়স ৮৬ বছর কিন্ত এখনো বেশ শক্তি সামর্থ আছে ।
ভদ্র মহিলা আমাদের কফির অফার করলে আমি ইয়েস, আর আমার বান্ধবী নো বলাতে উনি কিচেন থেকে দুই মগ কফি নিয়ে আসলেন , তার নিজের জন্য ও আমার জন্য ।
ভদ্র মহিলাই প্রথমে কথা শুরু করলেন তার নিজেই নাম বয়স দিয়ে কিন্ত উনি কথা শুরু করতে না করতেই আমার বান্ধবী , আমি কি কফি পেতে পারি ? ভদ্র মহিলা অবশ্যই বলে কিচেন গেলেন ।
-আমি বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলি, কি ব্যাপার !!
-আরে আমি কি জানি নাকি উনি দুই মগই আনবেন ।
-অনেক বছর তো হল এখনো সুইডিশ ক্যালচার জানোনা!!
আসলে আমি অন্যদের সাথে যেই ব্যাবহার করি, অন্যদের কাছেও সেই ব্যবহার প্রত্যাশা করি।
এই বান্ধবী খুব ভালো মনের একটা মানুষ তার কিছু ভালো অভ্যাস আছে কিন্ত আমার কাছে এটা খুবই বিরক্তিকর ।যখন সে কিছু খাবে আশে পাশের লোকদের এত বার সাধাসাধি করবে রীতিমত ভয়ংকর । আমরা একই কলেজে তিন বছর পড়াশুনা করেছি তার সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল কিন্ত হাতে খাবার কিছু দেখলেই আমি চুপ করে সরে যেতাম । অবশ্য শুধু খাবার না এমনিতেও তার মন টা বেশ উদার তার কোন জিনিস কেউ সুন্দর বল্লেই সে সেটা তাকে দিয়ে দেয়।
যাই হোক ভদ্র মহিলার সাথে সেদিন আমরা প্রায় চার ঘন্টা ছিলাম । ভদ্র মহিলা আমাদের খুব পছন্দ করেন, আমাদেরও ভালো লাগে। মহিলা আমাদের অনুরোধ করেন যদি তোমাদের সময় হয় মাঝে মাঝে যদি আমাকে দুই এক ঘন্টা সময় দেও আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব । এর পর সারা সামারে বেশ কয়েক বারই গিয়েছি ।
তার ব্যক্তিগত পারিবারিক লাইফ সম্পর্কে জেনেছি, সুইডিস ক্যালচার ও আমাদের ক্যালচার নিয়েও অনেক আলোচনা হয় । (সেসব নিয়ে একটা লিখা লিখার আমার ইচ্ছা আছে। (তাই আজকে আর বিস্তারিত লিখলাম না )
ওনার উনার একটা কথা আমার মনকে খুব ভাবায় ,” বৃদ্ধ জীবনে কোন আনন্দ নেই,কোন আশা নেই, কোন স্বপ্ন নেই। তবু নিজের মত নিজে ছিলাম কিন্ত কভিড আমাকে অর্থব বৃদ্ধ বানিয়ে দিল, এই জীবনে হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই এমন জীবন আমি চাইনি,এমন অর্থব বৃদ্ধ হবো কখনো ভাবিনি ।
“ alla vill till leva längre - men ingen vill bli gammal”
“ সবাই দীর্ঘ জীবন চায় কিন্ত কেউ বৃদ্ধ হতে চায় না “
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪২