আজকাল আমি রোজ বিকেলে সিদ্দিকা কবিরের বই দেখে দেখে ডালপুরি, সিঙ্গাড়া, সামুচা বানাই। বাবার বাড়িতে আমি কিছুই রান্না শিখিনি, এমনকি ভাতও টিপ দিয়ে বুঝতে শিখিনি সিদ্ধ হলো নাকি হলো না এই নিয়ে আমার শ্বাশুড়ি তার বোন, মানে আমার খালাশ্বাশুড়ি, মামী শ্বাশুড়ি এবং তার এক দঙ্গল ক্লাবের বন্ধুদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক কিছুই বলেন। আমি এ সবে কিছুই মনে করি না। আরে সত্যিই তো পারি না আমি এসব রান্না-বান্না। শুধু আমার শ্বাশুড়ি আম্মা এটাই জানে না আমি চাইলে মানুষের মাথার মুড়িঘন্টও বানিয়ে ফেলতে পারবো। ভাগ্যিস জানেন না।
যাইহোক বাসায় এতগুলো কাজের মানুষ থাকতেও আমার শ্বাশুড়িআম্মা বলে দিয়েছেন যে তার ছেলে অফিস থেকে ফিরলে যে বিকেলের নাস্তাটা দিতে হয় এখন থেকে সেটাই দিতে হবে আমাকে। কোনো কাজের লোক জন আর সেসব দেবে না। কখনই কোনো কাজেই অনুৎসাহ নেই আমার। কাজেই আমিও খুলে বসলাম সিদ্দিকা কবির। কিন্তু আমি তো তেলের ক্যানটাই তুলে ধরে তেল ঢালতে পারিনা। বই এ তো লেখা নেই তেল কেমনে ঢালে কাজেই প্রথমদিনই সিঙ্গাড়া ভাঁজতে গিয়ে দুড়মুড় করে ঢেলে ফেললাম ৫ লিটার তেলের ক্যানের আধা ক্যান তেল। হায় হায় কি করবো এখন! পানি পড়ে গেলে কাপড়ে শুষে নেয় এই বদমাইশ তেল তো কোনোভাবেই শুষে নেওয়া তো দূরের কথা আমার শ্বাশুড়ির কিচেনের সুসজ্জিত মার্বেল পাথরের টপটার উপর যতই মুছি ততই লেপটে যায়। এমন সময় কমলা ও বাড়ির হেড বাবুর্চি আমাকে বাঁচিয়ে দিলো। ফিসফিস করে এসে বললো,
-ভাবী সরেন। আমি মুছে দিচ্ছি।
খুব ছোট থেকেই সকল কাজেই উৎসাহী আমি মেতে উঠলাম ৫ লিটার তেলের ক্যান থেকে ঠিক কোন কায়দায় তেল ঢাললে তেল গড়িয়ে পড়ে না, ঠিক কোনভাবে ফ্রাইপ্যানের হ্যান্ডেলটা ধরলে হাতে তাপ লাগে না, কি করে গরম তেলে আস্তে করে মাছ ছাড়তে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে হত আমার শ্বাশুড়ি রান্না-বান্নাকে জীবনের সবচাইতে কঠিন কাজটাই মনে করেন তাই তিনি জীবনেও কিচেনে আসতেন না আর শিক্ষা দিতে গেলে প্রথমেই এই শিক্ষাটাই মেয়েদেরকে দেওয়া উচিৎ মনে করেন তাই তিনি আমাকে এই শিক্ষা দিচ্ছেন তবে নিজের মেয়েকে অশিক্ষিত রেখে।
কয়েকদিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় হয়ে উঠলাম আমি একজন ঝানু রাঁধুনী। তাই একটা দুটো নাস্তা থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি ভুরি ভুরি নাস্তা বানাতে শুরু করলাম। প্রথম দিন দুদ্দাড় তেল ফেলেছিলাম না জেনে। এখন আধা ক্যান তেল শেষ করি এক বিকালে। আমার সেই দ্রুত শিক্ষন আর তেল পেঁয়াজ ময়দা ঘি চিনির খরচান দেখে আমার শ্বাশুড়ি আম্মার তো চক্ষু স্থির। হা হা হা তিনি তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
যাইহোক তার চক্ষুর যা ইচ্ছা তাই হোক কিন্তু আমার এই রন্ধন পটিয়সী বিদ্যায় আমার শ্বশুর আর তার ছেলে মহা মুগ্ধ হয়ে উঠলো। আমি রোজ বিকেলে যখন সাজিয়ে গুছিয়ে আমার পতিদেবকে খানা পরিবেশন করি আর তার সাথে সারাদিনের নানা মানুষের নানা কর্মকান্ডের গল্প শুনাই সে তখন মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার দিকে চেয়ে বসে থাকে। আমার পতিসেবা নাকি নতুন জীবনের নানা উদ্যোগ উদ্দম আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো নাকি যে কোনো কিছুতেই ইতিবাচক আমি বাঁচার অনুপ্রেরনা খুঁজে নিতাম জানিনা আমি। শুধু জানি আমার প্রতি আমার পতিদেবের মন্ত্রমুগ্ধ আচরণ আর কেউ না বুঝলেও আমার শ্বাশুড়ি আম্মা ঠিকই বুঝতেন এবং যার পরনাই বিরক্ত হতেন।
আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে বা সামনেই উনার আত্মীয় স্বজন, কাজের লোকজনদেরকে বলতেন। আজকালকার মেয়েরা বিয়ে হয়েই স্বামীকে ভেড়া বানিয়ে ফেলে। আর ছেলেরাও তেমন বিয়ে করেই হয়ে যান সব বউ ভেড়ুয়া। কাজের লোকজনও সায় দিত।
-হ ঠিক কইছেন খালাম্মা। আমাদের যুগে এইসব আছিলো না। আমার শ্বাশুড়ি তো বাড়ির হগ্গলের খাওনের পর খাওন দিত আমারে। হগ্গলের খাওনের পর আমার পাতে থাকতো মুরগীর সালুনের গলা কিংবা ডানার আড্ডি। তবুও আমি মাইঝরাইত পর্যন্ত তার পাওত তেল মালিশ কইরে দিতাম।
আমার শ্বাশুড়ির মুখে প্রছন্ন এক হাসি ফুটে উঠতো। সেই হাসিটাকে ভয় পেতাম আমি। অমন ক্রুঢ় হাসি আমি কখনও কাউকে হাসতে দেখিনি। কিন্তু কি আর করা? আমাদের ঐ একান্নবর্তী বাড়িতেও শাসন বারণে থেকে অভ্যস্ত হয়েছিলাম আমরা। মানিয়ে নেওয়াই জীবনের মূল মন্ত্রনা এমনই শিখেছিলাম আমরা। তাই মানিয়ে নিতাম। মনে হত আমার আনন্দ আমার সুখ শান্তি, আমার হাসিমুখ এটাই আমার শ্বাশুড়ির ভালো লাগতো না। উনার সংসারে আরেক জনের আগমন ব্যপারটা উনি ঠিকঠাক মানতে পারতেন না বোধ হয়।
প্রায়ই ফোন করতো মা। জানতে চাইতো কেমন আছি। রুনি পিন্টু সবাই ফোন করতো। সবাই জানতো আমি খুব ভালো আছি। আনন্দে আছি আমি। সবার কথা জানতে চাইলেও আমি কখনই খোকাভায়ের কথা জানতে চাইতাম না। এমনকি বড় চাচীর কথাও জানতে চাইতাম না। ওরাও কখনও ভুলেও বড়চাচী বা খোকাভায়ের নাম মুখে আনতো না। আমি নতুন এই জীবনের নানা নিয়মে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম বেশ। আমার শ্বশুরমশাই, ভ্রু কুঁচকানো শ্বাশুড়ি আম্মা, আহলাদী পুতুলখেলা ননদিনী এই ছোট্ট সংসারে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছিলাম আমি সেই একান্নবর্তী এক গাদা লোকজনের হাঁট বাজারের মত বাড়ি ছেড়ে এসেও।
আজকালকার ছোট ছোট নাটকের যেমন এপিসোড থাকে তেমনই প্রতিদিনই আমার জীবনের নাটকেও ঘটছিলো নানান এপিসোড। সেদিন আমার শ্বাশুড়ির জন্মদিনে এক তোড়া ফুল নিয়ে এলেন তার বান্ধবী রুষা। রুমা নামে আমার কাজিন আছে রুনি নামেও আছে কিন্তু রুষা নামটি আমি পড়েছি শুধুই মাধুকরী উপন্যাসে। এই মহিলাটিও ঠিক আমার কল্পনার রুষা বৌদির মতই আলট্রা মর্ডাণ। উপন্যাসের রুষা বৌদিও অমন আলট্রা মর্ডাণই ছিলো। তাই বলে সে স্মোক করতো কিনা আমার মনে নেই। আমার শ্বাশুড়ির এই আলট্রা মর্ডাণ বান্ধবী রুষা কথায় কথায় শুধু সিগারেটের রিং ছাড়ে। এই ব্যপারটা আমার খুবই অবাক লাগে। ধোঁয়া দিয়ে রিং বানানো ? হায় হায় এটা তো প্রাকটিস করতেই হবে আমাকে। সেই প্রাকটিস করার কথা পরে বলেওছিলাম আমার পতিকে। উনি তো শুনে প্রথমে চক্ষু ছানাবড়া করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে আর তারপর এই ইচ্ছের কারণ জেনে হাসতে হাসতে অজ্ঞান হন আর কি।
যাইহোক বলছিলাম আমার শ্বাশুড়ির বান্ধবী রুষা আর তার ফুলের কথা। ফুলগুলো নিয়ে আমার শ্বাশুড়ি বললেন, যাও এগুলো ঐ বড় ফুলদানীটার মধ্যে পানি ভরে সাজিয়ে রাখো। আমিও জে আজ্ঞা বলে সেই ফুলদানী আর ফুল নিয়ে বাথরুমের বেসিনে পানি ভরতে গেলাম। ওম্মা হঠাৎ তাকিয়ে দেখি পানিগুলো তলিয়ে যাচ্ছে আর ফুলদানীটার তলা খুলে আমার হাতে। এখন উপায়! আমার শ্বাশুড়ির ভ্রু তো আজ শুধু কুচকেই থাকবে তা না, আরও যে কি যে হবে আল্লাহই জানে। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোন দিলাম আমার পতিকে। কান্না কান্না গলায় অনুনয় করে বললাম,
-জানো! সর্বনাশ হয়েছে! শিঘ্রী আসো বাসায়! আমাকে বাঁচাও। আমার পতি দেবতা তো আমার এই কান্না কান্না গলা শুনে আৎকে উঠলেন। বললেন,
- কি হয়েছে নিরুপমা? বলো আমাকে।
আমি আরও কান্না কান্না গলায় ফিসফিস করে বললাম সর্বনাশ হয়েছে! শিঘ্রী আসো। আর আসার সময় একটা স্যুপারগ্লু এনো সাথে করে। আমাকে বাঁচাও প্লিজ!!
আমার পতি দেবতা মনে হয় আকাশ থেকে পাতালে পড়েছিলেন। আমার বাঁচা মরার সাথে স্যুপারগ্লু এর কি সম্পর্ক এটা মনে হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। যাইহোক আমাকে তাড়াতাড়ি আশস্ত করলেন তিনি। বললেন খুব তাড়াতাড়ি আসছেন তিনি। আর এদিকে আমার শ্বাশুড়ির হাকডাক শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে।
- কি হল নীরু? কি করো এতক্ষন বাথরুমে?
আমার তড়িৎ উত্তর-
- গোসল করি আম্মা।
আর একটু পরে আবার উনি দরজা ধাক্কিয়ে জানতে চান,
- কি হলো গোসল করতে এত সময় লাগে? বের হও বাসায় লোকজন। আমার উত্তর,
- বাথরুম ধুই আম্মা।
আমার শ্বাশুড়ি মনে হয় বিস্মিত হয়ে কথাই বলতে ভুলে গেছিলেন।
যাইহোক কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার পতিদেবতা এসে হাজির। তিনি দরজা ধাক্কাতে আমি নিশ্চিৎ হয়েই দরজা খুলেই তড়িঘড়ি তাকে হাত ধরে টেনে ভেতরে আনলাম। আর তারপর আমার কান্না কান্না চোখ আর বেসিনে পড়ে থাকা দু'টুকরো ফুলদানী আর ফুল দেখেই বুঝে নিলেন উনি। হো হো করে হেসে উঠতে গেছিলেন। তার আগেই আমি তার মুখ চেপে ধরলাম। বললাম,
- আমাকে বাঁচাও। তোমার মা আমাকে আর আস্ত রাখবেন না আজ।
সেই কথা শুনে আমার পতিদেবতা নিশব্দে ফুলদানীর টুকরো দুটি মুছে স্যুপারগ্লু লাগিয়ে কিছুক্ষন চেপে ধরে রইলেন। তারপর পানি ভরে চেক করে তাতে ফুলগুলো ভরে বেসিনের সেল্ফে রাখলেন। তারপর আমার চোখ মুছিয়ে দিলেন। আমার কৃত অত বড় অপরাধের শাস্তি থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দেওয়ায় কৃতজ্ঞতায় আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। প্রায় সাথে সাথেই দরজায় করাঘাত আবার শ্বাশুড়ি আম্মার।
- নীরু তাড়াতাড়ি বের হও। সবাই এসে গেছে।
আমি হাসিমুখে হাতে ফুলদানী নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
উনি কিছুটা বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে বললেন,
- কি গোসল করলে চুল ভেজাওনি? আর কেমন আক্কেল তোমার বাড়িতে এক গাদা মেহমান আর তোমার বাথরুম ধোয়া লাগে!
বকবক করতে করতে চলে গেলেন উনি আর আমি অনেক কষ্টে মুখ টিপে হাসি সামলালাম।
আগের পর্ব
ডেঙ্গুজ্বরে সাবধানতা
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:৩৫