আমাদের বাড়িটাতে ঠিক আমার বয়সী তেমন কেউ ছিলো না। চাচাতো ফুপাতো ভাইবোনগুলি হয় সব আমার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড় নয় কয়েক বছরের ছোট ছিলো। তাই চাচাত ফুপাতো ভাইবোনদের মাঝে বন্ধুসুলভ যে ব্যপারটা জন্মে তা ঠিক জন্মেনি আমার। মীরা আপু আমার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড় ছিলেন। গুরু গম্ভীর চুপচাপ স্বভাবের হবার কারণে তার কাছে তেমন পাত্তা পেতাম না আমরা। তবে তিনি বড়বোনের মতই এ বাড়ির সকল ছেলেমেয়েদেরকে ভালোবেসেছিলেন। বিশেষ করে ঈদের আগের রাতে সবাইকে মেহেদী লাগিয়ে দেওয়া। ঈদের দিন টিপ পরিয়ে দেওয়া। যে কোনো উৎসবে চাচীমাদের সাথে তোড়জোড়ে মীরা আপুই ছিলেন অগ্রগামী। সেই মীরা আপুর এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আমার ঘাড়ে অটোমেটিক এসে পড়লো এ সকল কিছু দায় দায়িত্ব ও সকলের এক্সপেকটেশন। কিন্তু আমার সেদিকে কোনো মন ছিলো না, আমি শুধু খোকাভায়ের দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম নিজ দায়িত্বে সকলের অলক্ষ্যে। তাই মা চাচীমা দাদীমার গঞ্জনা লাঞ্ছনা শুনবার সময় ছিলো না আমার এত। আমার মন তখন সারাক্ষনই পড়ে থাকতো চিলেকোঠার ঘরে, খোকাভায়ের কাছে।
খোকাভাই যাই করতো তাই আমার কাছে তখন সুন্দর। শুধু এ বাড়ির মানুষগুলোই নয় খোকাভাই এ পাড়ার বা তার নতুন ভর্তি করিয়ে দেওয়া কলেজের কারো সাথেই তেমন মিশতো না। সব দিন ঠিক মত কলেজেও যেত না খোকা ভাই। তাতে এ বাড়ির এবং স্বয়ং তার মা আমার বড় চাচীমারও তেমন কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। অথচ অন্যান্য চাচাদের ছেলেমেয়েরা কেউ পরীক্ষায় খারাপ করলে তাদের পিঠে বড় বড় তাল নারকেল ফেলতে কার্পন্য করতেন না তাদের বাবা মায়েরা। এই দিক দিয়ে খোকাভাই ছাড় পেয়েছিলো। তার জীবন যেন ইচ্ছা স্বাধীন। এক মুখ দাঁড়িগোফ থাকলেও কেউ কিছু বলে না, না খেলেও বলে না, কলেজে না গেলেও কেউ কিছু বলার নেই। তাকে যেন দায় সারা কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে। এখন পাস করুক কি ফেইল করুক কারো কিছুই যায় আসে না। ঐ শাসন বারনের বাড়াবাড়ির বাড়িতে এই দিক দিয়ে খোকাভাই সুখে ছিলো।
একদিন বিকেলে বড় ফুপুআম্মা তার শ্বাশুড়ি শ্বশুরকে নিয়ে তার যেন কোন এক আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াৎ দিতে এসেছিলো। বাড়ির মুরব্বীরা তাদেরকে আপ্যায়নে তটস্থ ছিলো। এই রকম দিনগুলো আমার বড় আনন্দের ছিলো। মেহমান আত্মীয়-স্বজন বা বড়বড় মানুষের আপ্যায়ন আয়োজনে বাড়ির লোকজন এমনই ব্যতিব্যস্ত থাকতো তো আমাদের দিকে বিশেষ করে আমার দিকে এক চোখ লাগিয়ে রাখা মা কোনো চোখ কান দিয়ে রাখতে পারতো না। নইলে সারাক্ষনই ছিলো, নীরু, এ্যই নীরু কোথায় তুই? কোনো সাড়া শব্দ নেই কেনো? আবার কি দূরাভিসন্ধি হচ্ছে। কেমনটা লাগে! আমি কি সারাক্ষন হই হট্টগোল করে জানান দিয়ে বেড়াবো নাকি বাড়ির মধ্যে যে আমি আছি? যাইহোক সেসব দিনে একটু আমার হদিস না পেলেই মায়ের এই চিৎকার চেচামেচি আমার মোটেও ভালো লাগতো না। এ্যই যে কই ছিলি? কোথায় ছিলি? কি করতেসিলি শুনি? যদি বলতাম মা কিচ্ছু করছিলাম না। ওমনি দ্বিগুন জোরে মা চিল্লাতো, হ্যাঁ কিচ্ছু করছিলাম না না? শুদ্ধভাষা ঝাড়া হচ্ছে! কিচ্ছু না করে এক সেকেন্ডও থাকার বান্দা তুমি না! বল কি করতেছিলি? মা কখনও আমাকে এক মুহুর্তও বিশ্বাস করতো না।
কিন্তু ঐ যে আমি ছিলাম ডোন্ট মাইন্ড টাইপ। কারো বিশ্বাস অবিশ্বাসের ধার না ধেরেই আমার মন যা চাইতো তাই করেই চলতাম। সোজা কথায় মা থাকতো ডালে ডালে আর আমি পাতায় পাতায়। আরেক ছোট গোয়েন্দা ছিলো রুমা। এমনই শয়তান মেয়ে। মা যখন আমাকে সন্দেহের চোখে পুলিশি জেরা করতেন আর আমি আমতা আমতা কিচ্ছু জানিনা কিচ্ছু করিনি তখন ঐ ঘরের শত্রু বিভিষন ফোড়ন কাটত, চাচীমা নীরু আপু মিথ্যা কথা বলছে, নীরু আপু না ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তাও আবার চুল ছেড়ে। আমাদের ছোটবেলায় চুল ছেড়ে ঘোরা মানেই মহা অপরাধ ছিলো। সন্ধ্যা হতেই টাইট করে দুই বেনী বেঁধে দিতেন ছোট চাচী। এক এক করে ৭ জন মেয়ে ছিলো বাড়িতে একদম ছোট দুইটা ছাড়া সব কটিকেই সেই বেনী বাঁধতেই হত। শুধু কি টাইট করে বেনীই? সেই বেনী এবং প্রত্যেক সপ্তাহে নিয়ম করে তেল দিতে হ্ত চুলে একবার করে। সেই তেল আবার যেন তেন তেল না। আমার দাদীমার হাতে বানানো গাছের নারকেল কেটে শুকিয়ে তারপর সেই নারকেল টুকরা দিয়ে বানানো তেল।
উফ বলতে গেলাম এক কথা। বলতে বলতে চলে গেলাম আরেক কথায়। বলছিলাম বড় ফুপু আম্মা আর তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির আগমনে সারা বাড়ি তখন তটস্থ। আমার দিকে মায়ের মনই নেই। সকল চাচীমা তাদের দেহ মন আত্মা দিয়ে সেই অতিথি সেবায় মগ্ন।সে সুযোগে আমি আবার এক দৌড়ে ছাদের ঘরে। তখন মনে হয় শরৎকাল ছিলো। ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কেউ ছিলো না ছাদে। শুধু চাচীমাদের রোদে শুকুতে দেওয়া লাল নীল শাড়িগুলি সেই শারদীয়া বাতাসে উড়ছিলো। আমি ছাদে উঠে দেখলাম খোকাভাই এক বিশাল বড় নাটাই হাতে। আর আকাশে উড়ছে এক আশ্চর্য্য বিশাল বাজপাখি। বাঁজপাখিটা পাখি নয় সেটা একটা ঘুড়ি। আমি আনন্দে তালি দিয়ে উঠলাম। দৌড়ে গেলাম খোকাভায়ের কাছে। বললাম, আমিও উড়াবো আমিও!! আমার স্বভাবসিদ্ধ মাতব্বরীতে হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলাম আমি নাটাইটা আর ওমনি ঘুড়িটা পড়তে শুরু করলো। খোকাভাই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সেই ঘুড়ি বাঁচাতে টান দিল। খোকা ভায়ের সেই ঘুড়ি বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা দেখে ঘাবড়ে গেলাম আমি কিন্তু ঘুড়ি তখন কার আকাশে না উড়ে নীচে পড়তে পড়তে লটকে গেলো বেশ খানিক দূরে এক বিশাল তাল গাছের মাথায়। খুব রাগ করলো খোকাভাই। কি করলি তুই নীরু হ্যাঁ! কত্ত কষ্ট করে বানিয়েছি সারা রাত জেগে আর তুই সেই ঘুড়ি ফেলে দিলি! এখন যা ঐ তাল গাছের মাথায় উঠে ঘুড়ি নিয়ে আয় পেত্নী। নাইলে কান ধরে দাঁড়ায় থাক। খোকাভাই তখন ঘুড়ি হারাবার দুঃখে ভৎসনা করছিলো আর আমি খোকাভায়ের দুঃখে।

আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার দুচোখে তখন অঝর ধারা শ্রাবন বরিষন। আর সেই বাজপাখি ঘুড়ি ভচকে গিয়ে তখনও ঐ তালগাছের মাথায় লটপট করছে। আমি মন খারাপ করে ছাদের নীচু পানির ট্যাংকটার উপর গিয়ে বসে রইলাম।এই পানির ট্যাংক কেনো যেন আমার খুব প্রিয় ছিলো। যেন আমার মন খারাপের গোস্যা ঘর। আগের দিনে রাজা বাদশাহ দের বাড়ির মেয়েরা নাকি রাগ বা অভিমান করলে গোস্যা ঘরে গিয়ে ঢুকতো আর আমি মায়ের বকা খেলেই এই পানির ট্যাংকের উপর বসে থাকতাম আমার গোস্যা পানির ট্যাংকে। কতক্ষন বসে ছিলাম জানিনা। একটু পরে দেখি খোকাভাই সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাতে আরও বড় এক বিশাল কমলা রঙের পাখি। মানে পাখি ঘুড়ি। একটু আগে রাগের চিহ্নমাত্র নেই মুখে। বললো,
- গাধী মেয়ে। হুট করে কি ঘুড়ি ধরলেই উড়ানো যায়?
- তাইলে কেমনে উড়ানো যায়?
- আরে শিখতে হবে তো। ঘুড়ি উড়ানোরও তো নিয়ম আছে তাই না?
- ছাই আছে। এটা কোনো নিয়ম হলো?
- তাই নাকি? সব কিছু কি তোর গায়ের জোরে হবে?
আমি জেদ করে বললাম- হ্যাঁ হবে।
খোকাভাই আমার হাত ধরে বললো,
- চল তোকে শিখায় দেই কেমনে ঘুড়ি উড়াতে হয়।
আমি সাথে সাথেই সকল রাগ দুঃখ আর অভিমান ভুলে এক লাফে উঠা দাঁড়ালাম।
খোকাভাইই শিখিয়েছিলো আমাকে নাটাই ধরা বা কি করে ঘুড়িটা ঠিক ঠাক উড়াতে হয় আকাশে। খোকাভাই বলতে গেলে এক ঘুড়ি শিল্পী ছিলো পাখি থেকে শুরু করে বাঘ ভালুক সবই উড়াতে পারতো সে আকাশে ঘুড়ির কাগজ আঠা আর কাঁঠি দিয়ে। এই ঘুড়ি উড়ানোর পাগলামীটা খোকাভাইকে এনে দিলো আমার আরও কাছে।রোজ রোজ ছাদে ঘুড়ি উড়াবার সময় অসময়ে আমি চুপিসারে উঠে যেতাম ছাদে। আমার তখন শয়নে স্বপনে খোকাভাই আর খোকাভাই। ঐ একবাড়ি লোকের চোখে ধুলো দেওয়া কম ছিলো না। হয় আমরা অতীব চালাকীতে সেটা লুকাতে পেরেছিলাম নয় আমাদের দিকে আসলে কারো খেয়ালই ছিলো না।
সে সময়টাতে একটা রেওয়াজ ছিলো মানে বলতে গেলে সেটা সে যুগের এক ট্রেন্ড ছিলো আমাদের স্কুলের বেঞ্চে, ঘর বাড়ি পাঁচিলের দেওয়ালে এমনকি মোটা গাছের গুড়িতেও পেন পেনসিল বা গাছের গা কেটে কেটে ব্লেড দিয়ে লোকজন লিখে রাখতো লীনা + পলাশ,
বকুল+ শিমুল। এমন সব গাইয়া টাইপ খে্ত্তু কারবার। মানে এখনকার ছেলেমেয়েরা তেমনই বলবে আর কি। তবে সে সময় এমন লেখা এবং তা বাবা মায়ের চোখে পড়া ভীষন অপরাধ ছিলো। কিন্তু আমার খুব লিখতে ইচ্ছা হত খোকাভায়ের নামের সাথে আমার নিজের নামটাও।
আর তাই একদিন খেলাছলে এক পড়ন্ত বিকেলে ইটের টুকরো কুড়িয়ে ছাদের দেওয়ালে এক কোনে, লাল লাল হরফে লিখলাম,
"খোকা+ নিরু " কি ছেলেমানুষী কান্ড। সত্যি সে কথা ভাবলে বড্ড হাসি পায় এখন আমার। হাসি পাবার কারণটা অবশ্য শুধু সেই খেত্তু টাইপ কাজটাই না। সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখা খোকাভাইকে পরদিন চাচীমা যেভাবে কান ধরে হিড় হিড় করে ছাদে টেনে নিয়ে গেছিলেন সেই দৃশ্যটাও মনে পড়া। ছাঁদে আচার রোদে দিতে এসে চোখ পড়েছিলো তার ঐ লেখায়। তারপর তিনি রাগে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। আমাকেও ডেকেছিলেন তার আগেই তবে খোকাভাই না আসা পর্যন্ত কিছুই বলেননি। আমাকে দাঁড়া করিয়ে রেখেই অজস্র বাক্যবানে জর্জরিত করেছিলেন তিনি খোকাভইকে। আমাকে একটা কথাও বলেনি। বেচারা খোকাভাই সেই লেখা লেখেনি। লিখেছিলাম আমিই। অথচ আমার জন্য তাকে এত বকা খেতে হলো।
চাচীমা উন্মাদের মত খোকাভায়ের এই বোকামীর চিহ্ন মুছে ফেলতে চাইছিলেন ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে। ছোট একটি শলার ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দিয়ে, ঘষে ডলে উঠাতে চাইছিলেন সেই চিহ্ন। চাপা আক্রোশে ভৎসনা করছিলেন তিনি খোকা ভাইকে। এই আশ্রয়টুকু হারাবার সু পরিকলি্পিত বন্দোবস্তের যোগাড় দেখে রাগে পাগল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আসলে আজ বুঝি সেটা শুধু রাগ ছিলো না, ছিলো শেষ আশ্রয়টুকু হারাবার ভয়। চাচীমার আর কোথাও যাবার জায়গা ছিলো না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো তার। সেই অজস্র বকুনি আর ঘড়া ঘড়া জলে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন উনি আমাদের সেই ভয়ংকর ছেলেখেলার স্মৃতি।
কিন্তু তাতে কি লাভ?
ঐ যে ঐ গানটার মত- আমার হাত বান্ধিবি, পাও বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে.....
আগের পর্ব