কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়:
“আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়,
সিংহল তার নাম হল বাঙালি শৌর্য বীর্যের পরিচয়।”
আজ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে বাংলা অঞ্চলের রাজ্য পরিচালনায় ছিল মহাবংশ, আর বিজয় ছিলো রাজপুত্র।বিজয় সিংহ শৈশব থেকেই ছিলেন বখে যাওয়া রাজকুমার। সংযত জীবনযাপন তাঁর ধাতে সইতো না। রাঢ়ের যুবরাজ তিনি। রাজার অবর্তমানে রাজ্য শাসন তাঁর ঘাড়ে পড়বে। এগুলো জানার পরেও নিজেকে তৈরি করার কোনো চেষ্টা তাঁর মধ্যে ছিল না। দলবল নিয়ে সারাদিন চারিদিকে উপদ্রব আর উৎপাত করে বেড়ানোই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। প্রতিকারের আশায় প্রজারা মাঝে মাঝে রাজদরবারে অভিযোগ জানতো। কিন্তু সিংহবাহুরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন সবকিছু। শুরুতে উপদেশ, পরে তিরষ্কার, তারও পরে তিনি উত্তরাধিকার হরণের ভয় দেখালেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আর নয়। একে রাজ্য থেকে তাড়ানো ছাড়া রাজ্যে শান্তি আসবে না।
তবে অনেকে বলে জনপ্রিয় যুবরাজের বিপক্ষে এসব ছিলো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অংশ ,যা অনেকটাই সার্থক হয়েছিলো।
তাম্রলিপ্ত বন্দরে প্রস্তুত হলো তিনখানা বিশাল অর্ণবপোত ।প্রত্যেকটা জাহাজের কাপ্তান ছিলেন নৌ-বিদ্যায় পারদর্শী। কিন্তু আচমকা ঝড়ে বিজদের নৌরথের চলে যায় সিংহলের দিকে তার আগে তারা অন্য দুটি জাহাজ হায়ায়।বাংলার বিজয় যেদিন প্রথম শ্রীলঙ্কার মাটিতে পদার্পণ করলেন সেটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন । ভারতবর্ষের অন্য এক প্রান্তে দুটি শালতরুর মাঝখানে শাক্যচূঢ়ামণি তথাগত বুদ্ধ সেদিন তাঁর নির্ব্বাণ শয্যায় শায়িত। বিজয়ের অনুচরেরা কুবন্না নামে এক মায়াবী যক্ষীর খপ্পরে পড়লে বিজয় তাকে হারিয়ে নিজের সঙ্গীদের মুক্ত করলেন । তারপরে তার সাহায্যে আবার যক্ষরাজ কালসেনকে তার কন্যার বিবাহের সময়ে বধ করে তার পোষাক গায়ে দিলেন ।
অর্থাৎ স্থানীয় যে আদি জনগোষ্ঠী ছিল বোধহয় তাদেরই একাংশের সাহায্যে তাদের রাজাকে সমূলে ধ্বংস করে বিজয় রাজা হয়ে বসলেন। অতপর এই সম্রাজ্য সিংহল শাসন করে প্রায় ৬০০ বছর। এই হলো মহাবীর বিজয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
১৯৮৪ সালে শ্রীলঙ্কার লেখক কলিন ডি সিলভা ৭০১ পৃষ্ঠা জুড়ে ইংরেজীতে ‘দি ফাউন্টস অব সিংহল’ শীর্ষক সর্বকালের বঙ্গবীর বিজয়সিংহের জীবনী উপন্যাস রচনা করেছেন।
ঈশা খাঁ
বার ভূইয়াদের অন্যতম নেতা মহাবীর ঈশা খাঁ ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্ধে বিবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায় রাজা কালিদাস গজদানী সিংহ নামান্তরে সোলায়মান খাঁর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।১৫৪৫ সালে শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর সুলাইমান খাঁ দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করলে কৌশলে তাঁকে হত্যা করে তাঁর দুই নাবালক পুত্র ঈসা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে একদল তুরানী বণিকের নিকট বিক্রি করা হয়। ১৫৬৩ সালে ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্তি লাভ করে বহু অনুসন্ধানের পর সুদূর তুরান দেশের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ২ ভ্রাতুস্পুত্রকে উদ্ধার করেন।
এ সময় ঈসা খাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর।সুলতান তাজ খাঁ কররানী (১৫৬৪-৬৫) সিংহাসনে আরোহণ করে ঈসা খাঁকে তাঁর পিতার জায়গীরদারী ফেরত দেন। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খাঁ কররানীর রাজত্বকালে (১৫৭২-৭৬) ঈসা খাঁ বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন অসাধারণ বীরত্বের জন্যে।
১৫৭৫ সালের অক্টোবর মাসে বাংলার সুবাদার মুনিম খাঁর মৃত্যু হলে আফগান নেতা দাউদ খাঁ কররানী স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে বাংলা ও বিহারে খুতবা পাঠ করান। স্বাধীন ভূঁইয়ারাও তাঁকে অনুসরণ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।এরপর অনেক বীরত্বগাথাঁ রচিত হয়।
সর্বশেষ ১৫৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর হতে ১২ মাইল দূরে ঈসা খাঁ, মাসুম খাঁ কাবুলীর সম্মিলিত বাহিনী দুর্জন সিংহকে (মানসিংহের ছেলে) বাধা দিলে দুর্জন সিংহ বহু মুঘল সৈন্যসহ নিহত হন। অনেকে বন্দী হন। কিন্তু সুচতুর ঈসা খাঁ মুঘলদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা উচিত বলে মনে করে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তিনি বন্দীদের মুক্তি দেন এবং মানসিংহের সাথে আগ্রায় গিয়ে সম্রাট আকবরের সাথে সাক্ষাত করেন। সম্রাট এ বীর পুরুষকে দেওয়ান ও মসনদ-ই-আলা উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর মৃত্যু হয়।
সুবে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ের অধিপতি বার ভূইয়াদের অন্যতম নেতা মহাবীর ঈশা খাঁ বিচক্ষণ ও দুরদর্শী রাজনীতিবীদ হলেও বর্তমান রাজনীতিবীদসহ সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে কারও কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ঈশা খার ইতিহাস ঐতিহ্য ও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত স্থান গুলো সংরক্ষণের নেই কোনো উদ্যোগ। ফলে আগামী প্রজন্ম তাঁর বীরত্বগাঁথা ইতিহাস সম্পর্কে জানার বাহিরে থেকে যাচ্ছে।
সিধু-কানু
সিধু ও কানু ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম দিকের সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সিধু গ্রেপ্তার হন। পরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।কানু মাঝি ছিলেন তাঁর অনুজ এবং অপর বীরদ্বয় চাঁদ ও ভৈরব তাঁর অপর দুজন অনুজ ভ্রাতা। বীরভূম জেলার ওপারে সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর গুলিতে কানু মাঝির মৃত্যু হয়। ভৈরব ও চাঁদ ভাগলপুরের কাছে এক ভয়ংকর যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন করেন।
এছাড়াও কলিয়ান হরাম ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসের লিপিকার এবং সাঁওতালদের গুরু। তিনি তাঁর "হরকোরেন মারে হাপরাম্বো রিয়াক কথা" শীর্ষক একটি রচনায় সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত রেখে গেছেন। এই ইতিবৃত্তে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু ও কানুর সংগ্রাম-ধ্বনি, যথাঃ "রাজা-মহারাজাদের খতম করো", "দিকুদের (বাঙালি মহাজনদের) গঙ্গা পার করে দাও", "আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই" প্রভৃতি লিপিবদ্ধ আছে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। তাদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সিধু, কানু, চাঁদ প্রমুখ। ১৮৫২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ফলে তাদের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা সোচ্চার হয়েছিল।
(চলব...)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:০০