শুধু রবীন্দ্র সাহিত্য নয়। ইহুদী-নাছারা, মুশরিক ও সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কোন কবি-লেখকের সাহিত্য বাংলাদেশের মুসলমানের সাহিত্য হতে পারে না। এ বিষয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী আবুল মনসুর আহমদ লিখিত বাংলাদেশের ‘কালচার’ নামক বইয়ে লিখেছে,
‘পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। ...তবু এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়, কারণ এটা বাংলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন দান নেই, শুধু তা নয়, মুসলমানের প্রতিও এ সাহিত্যের কোন দান নেই।
অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোন প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে, সে কারণ এই যে, এই সাহিত্যের স্রষ্টা মুসলমান নয়, এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমান নয় এবং এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। প্রথমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথা ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু-মনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করেই তারা সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। ...
কিন্তু সত্য কথা এই যে, ওই সাহিত্যকে মুসলমানরা তাদের জাতীয় সাহিত্য মনে করতে পারে না। কারণ ত্যাগ-বৈরাগ্য-ভক্তি-প্রেম যতই উঁচু দরের আদর্শ হোক, মুসলমানের জীবনাদর্শ তা নয়। হিন্দুর ধর্ম যেমন ত্যাগ-বৈরাগ্য ও মুণি ঋষির ধর্ম। মুসলমানের ধর্ম তেমনি হক-ইনসাফ ও জেহাদ-শহীদের ধর্ম। প্রতীকবাদী সুন্দর পূজারী আর্টবাদী হিন্দু সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মুসলিম সংস্কৃতি তেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। হক-ইনসাফবাদী কল্যাণমুখী, মুসলিম সংস্কৃতি তাই সমাজকেন্দ্রিক।...
এ জন্যই বর্তমান বাংলা সাহিত্য মুসলিম সমাজ মনে কোন প্রেরণার স্পন্দন জাগাতে পারেনি। তাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে প্রতিবেশী হিন্দুকে আনন্দে নৃত্য করতে দেখেও মুসলিম সমাজে নরের একটি তারও ঝনাৎ করে উঠেনি। রবীন্দ্রনাথের ‘মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’র মতো বড় আবেদনে একটি মুসলমানের মাথা এক ইঞ্চি হেঁট হলো না।
তার বদলে যেদিন এক অচেনা-অজানা বালক হঠাৎ জিকির দিয়ে উঠলো : ‘বল বীর উন্নত মম শির’ সেদিন রিক্ত, ক্লান্ত, ঘুমন্ত ও জীবনমৃত মুসলমান ধচমচ করে জেগে উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে হুংকার দিয়ে উঠলো- ‘উন্নত মম শির’। কারণ এ যে তারই অন্তরের ঘুমন্ত শিশুর চিৎকার। এ যে তারই জীবনের কথা। তাই নজরুল ইসলামের আকস্মিক আবির্ভাব মুসলিম সমাজ মনকে এমন করে আলোড়িত করতে পেরেছে।
মুসলমানের বিবেচনায় মানব জীবনের সুখ-দুঃখ আলো-আঁধার, হাসি-কান্না, তাদের মনুষ্যত্ব-পশুত্ব, তাদের হীনতা-ক্ষুদ্রতা, তাদের সংগ্রাম-সাধনা এ সবই সাহিত্যের বুনিয়াদ এবং নজরুল ইসলাম এই জীবনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। শুধু এই কারণেই নজরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় কবি।
সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা যদি আমরা না হলাম, সাহিত্যের পটভূমি যদি আমার কর্মভূমি না হলো, তবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কিভাবে? আমার ঐতিহ্য, আমার ইতিহাস, আমার কিংবদন্তী, আমার উপকথা যে সাহিত্যের উৎস নয়, সে সাহিত্য আমার উৎস হবে কেমন করে। রাম-লক্ষণ, ভীম-অর্জুন, সীতা-সাবিত্রী, রাধা-কৃষ্ণ, মথুরা-অযোধ্যা, উজ্জ্বয়িনী-ইন্দ্রপ্রস্থ, হিন্দুর মনে যে স্মৃতি কল্পনা ও রস সৃষ্টি করে, যে ‘আইডিয়া অব এসোসিয়েশন’ জাগায়, মুসলিম মনে কি তা করতে পারে? তেমনি আবার আলী-হামযা, সোহরাব-রুস্তম, শাহজাহান-আলমগীর, হাযেরা-রাবিয়া-চাঁদ সুলতানা, সিরাজ-কাসেম, ঈশা খাঁ-মুসা খাঁ, গৌড়ি-সোনারগাঁ, মুসলিম মনে যে স্মৃতি-কল্পনা ও রস সৃষ্টি করে বা ‘আইডিয়া অব এসোসিয়েশন’ জাগায় হিন্দুর মনে তা করতে পারে না। এটা শুধু মুসলিমের কথা নয়। তামাম দুনিয়ায় সকল জাতি সম্বন্ধেই এ কথা সত্য। সব জাতির জাতীয় চেতনাই জাগে তার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। যতদিন সে ঐতিহ্যকে বুনিয়াদ করে সাহিত্য রচিত না হবে ততদিন সে সাহিত্য থেকে কোন জাতি প্রেরণা পাবে না।”
বাংলার মুসলমানও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নকল করে বড় হতে পারবে না। তাকে বড় হতে হবে তার স্বকীয়ত্বের উপর দাঁড়িয়ে, নিজের কৃষ্টিকে বুনিয়াদ করে।
রবীন্দ্রনাথ ও তার সতীর্থদের লিখিত সাহিত্য অনুকরণ ও অনুসরণের অনিবার্য পরিণাম বাঙালীত্বের মৃত্যু, একইভাবে উক্ত সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুসরণ বাংলাদেশীত্বের মৃত্যু ঘটাবে।
মূলত: বাংলাদেশী জাতিসত্তার মৃত্যু ঘটাতেই আর্যভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী চক্র এদেশে রবীন্দ্র ভক্তের চাষাবাদে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
(অমিতাভ চৌধুরী, ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ১৩৬-৩৭)।