স্পষ্ট নয়, খুব ধোঁয়াশাভাবে মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে মিরপুর ১২ নম্বরের মুসলিম বাজারে নূরী মসজিদ বাড়ানোর সময় মাটির নিচ থেকে হলুদ সোয়েটার- সাদা শার্ট, সাথে মাথার খুলি আর অনেক অস্থি বেরিয়ে আসে। এলাকার মানুষ জড়ো হয়েছিল দেখতে, খবর শুনে ছোট্ট আমি আব্বুর হাত ধরে গেলাম...। এর বেশি কিছু মনে নাই, বড় হয়ে জানলাম সেদিনের মুসলিম বাজারের ওই ঘটনায় প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার জহির রায়হান এর ছেলে অনল রায়হান কাপড় দেখে শনাক্ত করেন এসব তার বাবার!
১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়, উদ্যেশ্য ২১শে ফেব্রুয়ারীর হরতালকে পন্ড করা। ছাত্ররা সেদিন রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার ষড়যন্ত্রকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। ২০শে ফেব্রুয়ারীর রাতেই ফজলুল হক হল, ঢাকা হল ও সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররা মিটিং করে জানিয়ে দিলো যে সরকার রক্ত চক্ষু দেখিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে তারা একতিলও ছাড় দিতে রাজী নয়, তারাও গর্জে উঠতে জানে, চেলেঞ্জ ছুড়ে দিলো "তবে হয়ে যাক ফয়সালা"। মুসলীম লীগের পান্ডারা ও একালার সর্দারেরা মহল্লায় মহল্লার স্কুলে স্কুলে গিয়ে ভয় দেখিয়ে এলেও একুশে ফেব্রুয়ারী সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ অমান্য করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাস্তায় মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বপ্রথম যেই দশ জন ছাত্র মিছিল বের করেছিলেন তাদের একজনের নাম "জহির রায়হান"।
স্বাধীনতার পর ৩০শে জানুয়ারী ১৯৭২, জহির রায়হান মিরপুরে এসছিলেন তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার- এর সন্ধানে। সেদিন সকালে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অবঃ) বীরবিক্রম, লেঃ সেলিমকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ঊদ্যান থেকে ১২নং সেক্টরে যান। লেঃ সেলিম, হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে থেকে যান এবং মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী (অবঃ) বীরবিক্রম, সোহরাওয়ার্দী ঊদ্যানে ফিরে আসেন। সেদিন যারা মিরপুরে এসেছিলেন তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া দোসর বিহারীরা। মিরপুরে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানী সৈন্য ও বিহারীদের আক্রমনে এইদিন শুধু জহির রায়হান’ নয়, লেঃ সেলিম, নায়েব সুবেদার আবদুল মুমিন সহ ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪০ জন সৈন্য নিহত হন।
মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্যঃ স্বাধীনতার প্রথম দশক’ নামক গ্রন্থে (পৃ ২৬-৩৪) লিখেছেন-
“সেদিন বিহারিদের আক্রমনের মুখে বেঁচে যাওয়া সেনাসদস্যদের কাছ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনি। বিশেষ করে ডি কম্পানির অধিনায়ক হেলাল মোর্শেদ ও প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার ওয়াজেদ আলি মিয়া বারকী ঘটনার বিস্তারিত জানান”। তিনি আরো লিখেছেন, “ওই সময় আমাদের সৈন্যদের কোন মৃতদেহ দেখতে পাইনি। পরিস্থিতির কারনে তাৎক্ষনিকভাবে ভেতরের দিকে খোঁজাখুঁজি করা সম্ভব হয়নি। নিহতদের মধ্যে লে সেলিমসহ মাত্র কয়েকজনের মৃতদেহ দিন দুয়েক পর পাওয়া যায়। পুরো এলাকা জনশূন্য করার পরও বাকিদের মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। ৩০ জানুয়ারি রাতেই সম্ভবত বিহারিরা সেগুলো সরিয়ে ফেলে”।
'আরেক ফাল্গুন', 'হাজার বছর ধরে', 'বরফ গলা নদী' - উপন্যাসগুলো কিংবা 'জীবন থেকে নেয়া' , 'কাঁচের দেয়াল' নামক বাংলা ফিল্মগুলো সবগুলোই একেকটা মাস্টার পিস। আফসোস এর বিষয় বহু প্রতিভাসম্পন্ন একজন 'জহির রায়হান' কে আমরা সময়ের অনেক আগেই হারিয়েছি। আজ ১৯ আগস্ট, ২০১৫, জহির রায়হান এর জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জন্মেছিলেন তিনি, বেঁচে থাকলে তার বয়স হত ৮০ বছর। অথচ ১৯৭২ এর ৩০ জানুয়ারীর পর তিনি কেবলই ইতিহাস, আর সময়ের প্রাচীরে ইতিহাস আটকে থাকে মুখ থুবড়ে ...
#শুভ_জন্মদিন_জহির_রায়হান
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৩১