“মা, ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।” মা ভাত নিয়ে গেলেন রমনা থানায়, গিয়ে দেখলেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি। বলছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে এমন অনেক শহীদের মধ্যে অন্যতম “শহীদ আজাদ” এর কথা। ১৯৪৭ এর আগস্টে পাকিস্তান হওয়ার পর আজাদের বাবা ইউনুস চৌধুরী ঢাকায় আসেন এবং স্ত্রী সাফিয়া চৌধুরীর বাবার কাছ থেকে পাওয়া গয়না বিক্রি করা টাকায় ব্যবসা শুরু করে অল্প সময়ে দেশের অন্যতম সেরা বিজনেসম্যান হয়ে যান। তৎকালীন সময়ে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত পরিবারের ছেলে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ। ইস্কাটনে তাদের রাজ প্রাসাদের মত বাড়ি (ডাকে পাখি খোলো আঁখি, এই গানটার শুটিং হয়েছিল তাদের বাড়িতে)। চৌধুরী দম্পতির প্রথম সন্তান বিন্দু বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় আজাদ ছিল তাদের সাত রাজার ধন।
১৯৬০ এর দশক, আজাদ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেসময় আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করলে প্রতিবাদ করে আজাদের মা। অবশেষে অভিমানী মা ছেলেকে নিয়ে ঐ বিশাল প্রাসাদ ছেড়ে বের হয়ে আসে, শুরু হয় জীবন যুদ্ধ।
১৯৭১ সাল, উত্তাল দেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে ধরে মারছে অনেক নিরপরাধ মানুষ, জ্বালিয়ে পুরিয়ে দিচ্ছে চারদিক। এ দেশের সন্তানেরা তখন চুপ করে বসে থাকতে পারে নি। এতসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আজাদ তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেছে। তার বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেছে আগরতলা থেকে। বন্ধুরা আজাদকে বলল
-চল আমাদের সাথে, অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পিস্তল চালাতে জানিস। তোর আব্বার তো বন্দুক আছে, পিস্তল আছে, তুই সেগুলো দিয়ে অনেকবার শিকার করেছিস।
আজাদ বলল,
-এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি।
প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর তিনি পেয়েছেন আজাদকে, তার আকাশের একমাত্র চাঁদ এই আজাদ। অনেক কষ্টে তিনি ছেলেকে মানুষ করেছেন। এমন সোনার ছেলেকে কিভাবে মা যুদ্ধে পাঠাতে পারেন? তবুও দেশ ও দশের কথা চিন্তা করে ছেলেকে যুদ্ধে পাঠালেন। ২১ আগস্ট রুমী ও আজাদের মেলাধরের ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে স্পেশাল ট্রেনিং, তাদের মিশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ওড়ানো, ২৫ আগস্ট ঢাকায় তাদের আগুন দিয়ে হোলি খেলাসহ সাহসী সব অপারেশন থেকে জন্ম হল নতুন এক আজাদের, ক্র্যাক প্ল্যাটুনের ক্র্যাক আজাদ।
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। রাতে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। আজাদদের বাড়িতে গোলাগুলি হয়, কাজি কামাল (বীর বিক্রম, ২০১২ সালে মারা গেছেন) গুলি করে পালিয়ে যেতে পারলেন কিন্তু আজাদ, ক্রিকেটার জুয়েলসহ অনেকেই ধরা পড়ল। আজাদকে রাখা হল রমনা থানায়। আজাদের মা আজাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পর আজাদ বলে
- খুব মারে, ভয় হচ্ছে কখন সব স্বীকার করে ফেলি।
মা উত্তর দেয়,
- শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।
- মা, ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
মা ভাত নিয়ে এসে ছেলেকে আর পায়নি। আর কোনদিনও মায়ের বুকে ফিরে আসেনি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আজাদ। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। ঠিক ৩০ আগস্টেই মারা যান তিনি। পুরো ১৪বছর ভাত মুখে তুলেন নি। কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন কারণ তার একমাত্র ছেলে আজাদ ভাত চেয়েও খেতে পারেনি সেদিন। অপেক্ষা করেছেন ১৪ টা বছর ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। ১৪বছর তিনি কোন বিছানায় শোননি, মেঝেতে শুয়েছেন। শীত গ্রীষ্ম কোন কিছুতেই তিনি পাল্টাননি তার এই পাষাণ শয্যা কারণ তার ছেলে রমনা থানার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায়নি।
১৯৪৬ সালে ১১ জুলাই জন্মেছিল আজাদ। আজ ১১ জুলাই , ২০১৫। আমাদের কারই কিছু যায় আসেনা। আমরা আমাদের এসি রুমে বসে দামি স্মার্ট ফোনে থ্রি জি নেট কানেকশন ইউজ করতে করতে ফেসবুকে "লাইফ সাকস" স্ট্যাটাস দেওয়া জেনারেশন, অল্পতেই আমাদের মাথা ক্র্যাক হয়। এইসব ক্র্যাক আজাদদের কথা বলা বড্ড সেকেলে ব্যাপার, জত্তসব ক্ষ্যাত। আমি নাহয় একটু সেকেলে হয়েই বললাম -
#শুভ_জন্মদিন_ক্র্যাক_আজাদ ...
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:৩২